সময়ের প্রেক্ষিত-জাপান: দুর্যোগের তিন মাস পর by মনজুরুল হক
জাপানের দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি এখন সংবাদমাধ্যমের মূল আলোচ্য বিষয় থেকে সংগতভাবেই সরে দাঁড়িয়েছে। ত্রিমুখী দুর্যোগ আঘাত হানার পরবর্তী দুই সপ্তাহ সংবাদ শিরোনামের অনেকটা জুড়েই ছিল জাপানের খবরাখবর। শুরুতে ভূমিকম্প আর সুনামির ধ্বংসযজ্ঞের ওপর আলোকপাত করা হলেও অল্প দিনেই দৃষ্টি সরে যায় ফুকুশিমা জেলার
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার ওপর, যে দুর্ঘটনার প্রভাব জাপান এখন পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঠিক কী ঘটেছে, তা নিয়ে জাপানেও অনেককেই অনেক দিন ধরে অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকতে হয়েছে। দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি পারমাণবিক চুল্লির সম্পূর্ণ গলে যাওয়া, নাকি চুল্লির আংশিক ক্ষয়ক্ষতিতে সীমিত—সেই বিতর্ক জাপান ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ হলো, বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী কোম্পানি টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার বা টেপকোর সঠিক তথ্য ঢেকে রাখতে চালিয়ে যাওয়া অশুভ তৎপরতা। শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগের ফলেই টেপকোকে ঘটনার ভয়াবহতার সঠিক মাত্রা প্রকাশ করতে হয়, যা থেকে জানা যায়, সুনামি আঘাত হানার এক দিন পরই পারমাণবিক চুল্লির মূল অংশ গলে যাওয়ার মতো ভয়ংকর পরিস্থিতি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সামাল দিতে হয়েছে। দুর্ঘটনা মূলত এখন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া কতটা মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর এখন পর্যন্ত অনেকটাই অনুমাননির্ভর রয়ে গেছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি যাদের হতে হচ্ছে, তারা হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২০ কিলোমিটার পরিসীমার মধ্যে বসবাসরত প্রায় ৮০ হাজার লোক; বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রেই কেবল যাদের এখন বসবাস করতে হচ্ছে না, সেই সঙ্গে কবে তারা নিজ বাসভবনে ফিরে যেতে পারবে কিংবা আদৌ তারা পারবে কি না, সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেও তাদের এখন সময় কাটাতে হচ্ছে।
জাপানের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনগণের জীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করলেও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাভেদে সেই স্বাভাবিকতার ব্যাপক তারতম্য সহজেই লক্ষণীয়। ক্ষতির পরিমাণ ডলারের হিসাবে লক্ষ কোটির অঙ্ক অতিক্রম করে গেছে এবং পরিস্থিতি সার্বিকভাবে সামাল দেওয়া সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়াবে। তবে তার পরও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাজুড়েই এখন চোখে পড়ে। দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি অবলোকন করা, কোন ধরনের পুনরুদ্ধারকাজ দুর্গত এলাকায় চালানো হচ্ছে এবং নতুন কী সমস্যার মুখোমুখি এলাকাবাসীকে হতে হচ্ছে, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য ভূমিকম্প ও সুনামি আঘাত হানার আড়াই মাস পর তোহোকু অঞ্চলের কয়েকটি শহর পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল টোকিওভিত্তিক বিদেশি সাংবাদিকদের ১৫ জনের একটি দলকে। প্রথম আলোর প্রতিনিধি হিসেবে সেই দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল এবং সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরছি দুর্যোগ আঘাত হানার তিন মাস পর কেমন কাটছে সেখানকার জীবন—সে সংক্রান্ত এই প্রতিবেদন।
গত ১১ মার্চের দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সুনামির আঘাতে। জাপানের মূল দ্বীপ হোনশুর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর বিস্তৃত সানরিকু অঞ্চল সুনামিতে আক্ষরিক অর্থেই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি শহর, যেমন—ইশিনোমাকি, মিনামি সানরিকু, কেসেননুমা, রিকুজেন-তাকাতা ও ওৎসুচি পরিণত হয়েছে বিশাল এক ধ্বংসস্তূপে। মূলত মৎস্যজীবীদের বসবাস ওই সব শহরে। বাড়িঘরের পাশাপাশি মাছ ধরার জাহাজ শুরুতে ঢেউয়ের সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে পরবর্তীকালে আবারও তীরে আছড়ে ফেলে দিয়ে গেছে সুনামি। ফলে কাঠের বাড়িঘর স্রোতের সেই ভয়ংকর শক্তির মুখে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং গাড়ি, জাহাজ ও শক্ত ধাতুর তৈরি অন্যান্য সামগ্রী দোমড়ানো-মোচড়ানো অবস্থায় কূলে এসে ঠাঁই নেয়। বিধ্বস্ত সেসব শহরের অনেকটা জুড়েই এখনো চোখে পড়ে প্রকৃতির সেই খামখেয়ালিপনা, যার বিস্তৃতি কয়েক লাখ জনবসতির শহর সেন্দাই পর্যন্ত।
সেন্দাই হচ্ছে জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান শহর। শহরের বিমান ও নৌবন্দর সুনামির আঘাতে প্রায় বিকল হয়ে পড়ে, যা এখন আবার সচল করে তোলা হলেও ধ্বংসের ছাপ চারদিক জুড়ে এখনো স্পষ্ট। কোথাও জড়ো করে রাখা দোমড়ানো-মোচড়ানো গাড়ি, কোথাও বা তীরে এসে উল্টে যাওয়া পুরো জাহাজ এখনো রয়েছে সরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায়। সেন্দাইয়ের মেয়র এমিকো ওকুইয়ামার ভাষ্য অনুযায়ী, শহরের ১২ হাজার বাড়িঘর ভূমিকম্প ও সুনামিতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে এবং প্রাণ হারিয়েছে এক হাজার ৩৬০ জন শহরবাসী। এ ছাড়া আরও তিন শতাধিক এখনো নিখোঁজ রয়েছে। ভূমিকম্প ও সুনামিতে জ্বালানি তেলের ডিপো এবং অনেক গুদামঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে মারাত্মক হয়ে দেখা দিলেও এর অনেকটাই এখন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে এবং নাগরিক জীবনও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। তবে যে এক লাখ নগরবাসী শুরুতে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠে এসেছিল, তাদের মধ্যে বাড়িঘর যাদের অক্ষত রয়েছে, তারা ইতিমধ্যে ফিরে গেলেও ঘরবাড়ি হারানো লোকজনকে দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করতে হচ্ছে। তাদের সমস্যার আশু সমাধান খুঁজে বের করা কেন্দ্রীয় সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়। জাপানের কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ার জন্য চার লাখ কোটি ইয়েনের যে সম্পূরক বাজেট অনুমোদন করেছে, ধ্বংসের ব্যাপকতার আলোকে তা পর্যাপ্ত নয় বলেই ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসন মনে করছে।
দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কেবল প্রাণহানি ও অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ার মধ্যেই সীমিত নেই; উপকূলবর্তী অনেক এলাকায়ই জনগণের পেশাগত জীবনের ওপর মারাত্মক হুমকি দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি ফেলছে, যা কাটিয়ে উঠতে হলে নতুন অবকাঠামো তৈরি করে নেওয়ার বাইরে আরও অনেক কিছু করা দরকার। দুর্যোগ আঘাত হানা অঞ্চলের পর্যটনশিল্প একসময় দেশ-বিদেশের প্রচুরসংখ্যক পর্যটককে নিয়মিতভাবে আকৃষ্ট করে আসছিল। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় হোটেল এবং বিভিন্ন বিনোদনসেবার ব্যবস্থাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে, যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে দেখার প্রয়াস তারা এখন চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যার মুখোমুখি যারা দাঁড়িয়ে, তারা অবশ্যই হচ্ছে সেসব লোকজন, সুনামির ঢেউ যাদের বাড়িঘর এবং সেই সঙ্গে জীবনের যাবতীয় সঞ্চিত সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তারা সবাই এখন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের স্থায়ী অধিবাসী। কবে আবারও আপন নিবাস গড়ে নিতে তারা সক্ষম হবে, তা তাদের জানা নেই। তাদের বড় একটি অংশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করেছিল। সেই বাড়ি সমুদ্রে ভেসে গেলেও ঋণের বোঝা এখনো চেপে আছে তাদের মাথার ওপর। নতুন করে বাড়ি তৈরি করতে হলে আবারও ব্যাংকের শরণাপন্ন তাদের হতে হবে এবং সে রকম অবস্থায় দ্বৈত ঋণের প্যাঁচে তারা হয়তো আটকা পড়ে যাবে। ফলে এসব লোকের দুর্দশা লাঘবে কী করা যায়, তা নিয়ে স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি জাপানের জাতীয় সরকারকেও ভাবতে হচ্ছে।
অন্য যে নতুন সমস্যা বিধ্বস্ত অনেক জনবসতিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে তা হলো, সেসব জনপদ আদৌ টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে দেখা দেওয়া সন্দেহ। সে রকম একটি জনবসতি হচ্ছে ইওয়াতে জেলার সমুদ্র-তীরবর্তী শহর ওৎসুচি। তরুণ প্রজন্ম অনেক আগে থেকেই নগরমুখী হয়ে ওঠায় ওৎসুচি হচ্ছে মূলত বৃদ্ধদের এক জনবসতি, যাঁদের অধিকাংশই সুনামি আঘাত হানার আগ পর্যন্ত মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সুনামির আঘাতে তাঁদের ঘরবাড়ির পাশাপাশি মাছ ধরার জাহাজও সমুদ্রে ভেসে গেছে। ফলে তাঁদের অনেকেই এখন বলছেন, আগের পেশায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁদের আর নেই এবং নতুন করে বাড়ি তৈরি করতে হলে সেখানে নয়, বরং উঁচু কোনো জায়গায় তা তাঁরা করবেন, যেখানে সুনামির ঢেউ পৌঁছাতে পারবে না। ফলে শহর এখন জনশূন্য হয়ে পড়ার নতুন এক হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে।
ভূমিকম্প আর সুনামিতে নিহত ও নিখোঁজ লোকজনের সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ১০ হাজারের বেশি হচ্ছে নিখোঁজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত লোক, যাদের মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়ার তৎপরতা এখনো অব্যাহত আছে। ওকু মাৎসুশিমা শহরের উপকূলে বিধ্বস্ত ঝিনুক চাষের খামার পরিদর্শনে আমাদের যখন স্পিডবোটে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনো উপকূল বরাবর চোখে পড়ছিল নিচু দিয়ে হেলিকপ্টারের উড়ে যাওয়া। দুর্যোগের তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় কারও খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও মৃত্যু সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত না হাওয়া পর্যন্ত সম্ভবত আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে হেলিকপ্টারের এতটা নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়া।
দুর্গত এলাকায় দুই দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে বিষণ্ন্ন এক রেলস্টেশনের দেখা এবার আমি পেয়েছি। ওকু মাৎসুশিমা শহরে সমুদ্রের কূল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সেই রিকুজেন-ওৎসুকা রেলস্টেশনের জনমানবহীন প্ল্যাটফরমে আছে কেবল একটি বেঞ্চ, সমুদ্রের মুখোমুখি দিক করে যেটা বসানো। এর বাইরে আছে স্টেশনের নাম লেখা সাইনবোর্ড। শুধু এটুকুই। আর সেই বিষণ্ন প্রেক্ষাপট মনে করিয়ে দিচ্ছে—এই হচ্ছে সেই রেলপথ, গত ১১ মার্চ দুপুরের পর যে রেলপথ ধরে যাওয়ার সময় সুনামির ঢেউয়ে হারিয়ে গেছে যাত্রী বহনকারী দুটি ট্রেন। রেলপথটি এখনো চালু হয়নি। আবার চালু হবে কি না, এর কোনো নিশ্চয়তা এখন আর নেই। ফলে বেদনাভরা এক স্মৃতি নিয়ে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে বিষণ্ন সেই রেলস্টেশন, যেন বা কী ঘটেছিল সেদিন, তারই এক নীরব সাক্ষী।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঠিক কী ঘটেছে, তা নিয়ে জাপানেও অনেককেই অনেক দিন ধরে অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকতে হয়েছে। দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি পারমাণবিক চুল্লির সম্পূর্ণ গলে যাওয়া, নাকি চুল্লির আংশিক ক্ষয়ক্ষতিতে সীমিত—সেই বিতর্ক জাপান ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ হলো, বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী কোম্পানি টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার বা টেপকোর সঠিক তথ্য ঢেকে রাখতে চালিয়ে যাওয়া অশুভ তৎপরতা। শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগের ফলেই টেপকোকে ঘটনার ভয়াবহতার সঠিক মাত্রা প্রকাশ করতে হয়, যা থেকে জানা যায়, সুনামি আঘাত হানার এক দিন পরই পারমাণবিক চুল্লির মূল অংশ গলে যাওয়ার মতো ভয়ংকর পরিস্থিতি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সামাল দিতে হয়েছে। দুর্ঘটনা মূলত এখন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া কতটা মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর এখন পর্যন্ত অনেকটাই অনুমাননির্ভর রয়ে গেছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি যাদের হতে হচ্ছে, তারা হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২০ কিলোমিটার পরিসীমার মধ্যে বসবাসরত প্রায় ৮০ হাজার লোক; বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রেই কেবল যাদের এখন বসবাস করতে হচ্ছে না, সেই সঙ্গে কবে তারা নিজ বাসভবনে ফিরে যেতে পারবে কিংবা আদৌ তারা পারবে কি না, সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেও তাদের এখন সময় কাটাতে হচ্ছে।
জাপানের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনগণের জীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করলেও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাভেদে সেই স্বাভাবিকতার ব্যাপক তারতম্য সহজেই লক্ষণীয়। ক্ষতির পরিমাণ ডলারের হিসাবে লক্ষ কোটির অঙ্ক অতিক্রম করে গেছে এবং পরিস্থিতি সার্বিকভাবে সামাল দেওয়া সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়াবে। তবে তার পরও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাজুড়েই এখন চোখে পড়ে। দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি অবলোকন করা, কোন ধরনের পুনরুদ্ধারকাজ দুর্গত এলাকায় চালানো হচ্ছে এবং নতুন কী সমস্যার মুখোমুখি এলাকাবাসীকে হতে হচ্ছে, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য ভূমিকম্প ও সুনামি আঘাত হানার আড়াই মাস পর তোহোকু অঞ্চলের কয়েকটি শহর পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল টোকিওভিত্তিক বিদেশি সাংবাদিকদের ১৫ জনের একটি দলকে। প্রথম আলোর প্রতিনিধি হিসেবে সেই দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল এবং সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরছি দুর্যোগ আঘাত হানার তিন মাস পর কেমন কাটছে সেখানকার জীবন—সে সংক্রান্ত এই প্রতিবেদন।
গত ১১ মার্চের দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সুনামির আঘাতে। জাপানের মূল দ্বীপ হোনশুর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর বিস্তৃত সানরিকু অঞ্চল সুনামিতে আক্ষরিক অর্থেই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি শহর, যেমন—ইশিনোমাকি, মিনামি সানরিকু, কেসেননুমা, রিকুজেন-তাকাতা ও ওৎসুচি পরিণত হয়েছে বিশাল এক ধ্বংসস্তূপে। মূলত মৎস্যজীবীদের বসবাস ওই সব শহরে। বাড়িঘরের পাশাপাশি মাছ ধরার জাহাজ শুরুতে ঢেউয়ের সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে পরবর্তীকালে আবারও তীরে আছড়ে ফেলে দিয়ে গেছে সুনামি। ফলে কাঠের বাড়িঘর স্রোতের সেই ভয়ংকর শক্তির মুখে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং গাড়ি, জাহাজ ও শক্ত ধাতুর তৈরি অন্যান্য সামগ্রী দোমড়ানো-মোচড়ানো অবস্থায় কূলে এসে ঠাঁই নেয়। বিধ্বস্ত সেসব শহরের অনেকটা জুড়েই এখনো চোখে পড়ে প্রকৃতির সেই খামখেয়ালিপনা, যার বিস্তৃতি কয়েক লাখ জনবসতির শহর সেন্দাই পর্যন্ত।
সেন্দাই হচ্ছে জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান শহর। শহরের বিমান ও নৌবন্দর সুনামির আঘাতে প্রায় বিকল হয়ে পড়ে, যা এখন আবার সচল করে তোলা হলেও ধ্বংসের ছাপ চারদিক জুড়ে এখনো স্পষ্ট। কোথাও জড়ো করে রাখা দোমড়ানো-মোচড়ানো গাড়ি, কোথাও বা তীরে এসে উল্টে যাওয়া পুরো জাহাজ এখনো রয়েছে সরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায়। সেন্দাইয়ের মেয়র এমিকো ওকুইয়ামার ভাষ্য অনুযায়ী, শহরের ১২ হাজার বাড়িঘর ভূমিকম্প ও সুনামিতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে এবং প্রাণ হারিয়েছে এক হাজার ৩৬০ জন শহরবাসী। এ ছাড়া আরও তিন শতাধিক এখনো নিখোঁজ রয়েছে। ভূমিকম্প ও সুনামিতে জ্বালানি তেলের ডিপো এবং অনেক গুদামঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে মারাত্মক হয়ে দেখা দিলেও এর অনেকটাই এখন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে এবং নাগরিক জীবনও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। তবে যে এক লাখ নগরবাসী শুরুতে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠে এসেছিল, তাদের মধ্যে বাড়িঘর যাদের অক্ষত রয়েছে, তারা ইতিমধ্যে ফিরে গেলেও ঘরবাড়ি হারানো লোকজনকে দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করতে হচ্ছে। তাদের সমস্যার আশু সমাধান খুঁজে বের করা কেন্দ্রীয় সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়। জাপানের কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ার জন্য চার লাখ কোটি ইয়েনের যে সম্পূরক বাজেট অনুমোদন করেছে, ধ্বংসের ব্যাপকতার আলোকে তা পর্যাপ্ত নয় বলেই ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসন মনে করছে।
দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কেবল প্রাণহানি ও অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ার মধ্যেই সীমিত নেই; উপকূলবর্তী অনেক এলাকায়ই জনগণের পেশাগত জীবনের ওপর মারাত্মক হুমকি দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি ফেলছে, যা কাটিয়ে উঠতে হলে নতুন অবকাঠামো তৈরি করে নেওয়ার বাইরে আরও অনেক কিছু করা দরকার। দুর্যোগ আঘাত হানা অঞ্চলের পর্যটনশিল্প একসময় দেশ-বিদেশের প্রচুরসংখ্যক পর্যটককে নিয়মিতভাবে আকৃষ্ট করে আসছিল। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় হোটেল এবং বিভিন্ন বিনোদনসেবার ব্যবস্থাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে, যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে দেখার প্রয়াস তারা এখন চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যার মুখোমুখি যারা দাঁড়িয়ে, তারা অবশ্যই হচ্ছে সেসব লোকজন, সুনামির ঢেউ যাদের বাড়িঘর এবং সেই সঙ্গে জীবনের যাবতীয় সঞ্চিত সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তারা সবাই এখন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের স্থায়ী অধিবাসী। কবে আবারও আপন নিবাস গড়ে নিতে তারা সক্ষম হবে, তা তাদের জানা নেই। তাদের বড় একটি অংশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করেছিল। সেই বাড়ি সমুদ্রে ভেসে গেলেও ঋণের বোঝা এখনো চেপে আছে তাদের মাথার ওপর। নতুন করে বাড়ি তৈরি করতে হলে আবারও ব্যাংকের শরণাপন্ন তাদের হতে হবে এবং সে রকম অবস্থায় দ্বৈত ঋণের প্যাঁচে তারা হয়তো আটকা পড়ে যাবে। ফলে এসব লোকের দুর্দশা লাঘবে কী করা যায়, তা নিয়ে স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি জাপানের জাতীয় সরকারকেও ভাবতে হচ্ছে।
অন্য যে নতুন সমস্যা বিধ্বস্ত অনেক জনবসতিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে তা হলো, সেসব জনপদ আদৌ টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে দেখা দেওয়া সন্দেহ। সে রকম একটি জনবসতি হচ্ছে ইওয়াতে জেলার সমুদ্র-তীরবর্তী শহর ওৎসুচি। তরুণ প্রজন্ম অনেক আগে থেকেই নগরমুখী হয়ে ওঠায় ওৎসুচি হচ্ছে মূলত বৃদ্ধদের এক জনবসতি, যাঁদের অধিকাংশই সুনামি আঘাত হানার আগ পর্যন্ত মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সুনামির আঘাতে তাঁদের ঘরবাড়ির পাশাপাশি মাছ ধরার জাহাজও সমুদ্রে ভেসে গেছে। ফলে তাঁদের অনেকেই এখন বলছেন, আগের পেশায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁদের আর নেই এবং নতুন করে বাড়ি তৈরি করতে হলে সেখানে নয়, বরং উঁচু কোনো জায়গায় তা তাঁরা করবেন, যেখানে সুনামির ঢেউ পৌঁছাতে পারবে না। ফলে শহর এখন জনশূন্য হয়ে পড়ার নতুন এক হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে।
ভূমিকম্প আর সুনামিতে নিহত ও নিখোঁজ লোকজনের সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ১০ হাজারের বেশি হচ্ছে নিখোঁজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত লোক, যাদের মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়ার তৎপরতা এখনো অব্যাহত আছে। ওকু মাৎসুশিমা শহরের উপকূলে বিধ্বস্ত ঝিনুক চাষের খামার পরিদর্শনে আমাদের যখন স্পিডবোটে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনো উপকূল বরাবর চোখে পড়ছিল নিচু দিয়ে হেলিকপ্টারের উড়ে যাওয়া। দুর্যোগের তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় কারও খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও মৃত্যু সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত না হাওয়া পর্যন্ত সম্ভবত আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে হেলিকপ্টারের এতটা নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়া।
দুর্গত এলাকায় দুই দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে বিষণ্ন্ন এক রেলস্টেশনের দেখা এবার আমি পেয়েছি। ওকু মাৎসুশিমা শহরে সমুদ্রের কূল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সেই রিকুজেন-ওৎসুকা রেলস্টেশনের জনমানবহীন প্ল্যাটফরমে আছে কেবল একটি বেঞ্চ, সমুদ্রের মুখোমুখি দিক করে যেটা বসানো। এর বাইরে আছে স্টেশনের নাম লেখা সাইনবোর্ড। শুধু এটুকুই। আর সেই বিষণ্ন প্রেক্ষাপট মনে করিয়ে দিচ্ছে—এই হচ্ছে সেই রেলপথ, গত ১১ মার্চ দুপুরের পর যে রেলপথ ধরে যাওয়ার সময় সুনামির ঢেউয়ে হারিয়ে গেছে যাত্রী বহনকারী দুটি ট্রেন। রেলপথটি এখনো চালু হয়নি। আবার চালু হবে কি না, এর কোনো নিশ্চয়তা এখন আর নেই। ফলে বেদনাভরা এক স্মৃতি নিয়ে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে বিষণ্ন সেই রেলস্টেশন, যেন বা কী ঘটেছিল সেদিন, তারই এক নীরব সাক্ষী।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments