কালের পুরাণ-দুই জোটের মহাসমাবেশ: জনগণ কী পেল? by সোহরাব হাসান
ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় জোটের নেতারা দাবি করেছেন, তাঁদের মহাসমাবেশ সফল হয়েছে। কারও মতে, এই মহাসমাবেশে লক্ষাধিক লোক এসেছে। কারও মতে, ৫০-৬০ হাজারের বেশি হবে না। আওয়ামী লীগের মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বিরোধী দল মহাসমাবেশের নামে কর্মী সমাবেশ করেছে।
আর বিএনপির এক নেতা বলেছেন, ক্ষমতাসীন দল পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করতে গিয়ে ভাড়াটে সমাবেশ করেছে। কর্মী হোক বা ভাড়াটে হোক সমাবেশ করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। কোথা থেকে এই অর্থ এসেছে, কারা অর্থ জুগিয়েছে সেই প্রশ্নটি কম জরুরি নয়। ক্ষমতাসীন দল বিএনপির সমাবেশের অর্থের উৎস জানতে চেয়েছে। বিএনপি কখনো ক্ষমতায় গেলে নিশ্চয়ই তারাও আওয়ামী লীগের কাছে অর্থের উৎস জানতে চাইবে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কখনোই এই অর্থের উৎস জানতে পারবে না।
নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য অনুযায়ী যদি আমরা ধরে নিই দুই জোটের মহাসমাবেশই সফল হয়েছে। অন্তত পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনামে নেতাদের ভাষণ ছাপা হয়েছে, টেলিভিশন চ্যানেলেও প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে খালেদা জিয়ার সমাবেশের সরাসরি প্রচার কেন বন্ধ হলো, সেই প্রশ্নের জবাব তথ্যমন্ত্রী দিতে পারবেন কি? সরকারি দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো পথে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তারা সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করেছে, কিন্তু দুটি জনসভায় সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে কেন ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করা হলো, দেশের মানুষ তা জানতে পারল না। তারা দেখল, শেখ হাসিনার বক্তৃতা সরাসরি বিটিভিসহ বেশ কিছু টিভি চ্যানেল সরাসরি প্রচার করেছে; কিন্তু খালেদা জিয়ার বক্তৃতার সময় টিভি চ্যানেলগুলো স্তব্ধ হয়ে গেল।
তাহলে কি এখন স্তব্ধতার গণতন্ত্র চলছে? সেটাই সাচ্চা গণতন্ত্র হতো যদি সরকার পরিচালিত বিটিভিতে দুই নেত্রীর বক্তৃতা সরাসরি প্রচার করা হতো। বাংলাদেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের কাছে অতটা চাওয়া বোধ হয় আকাশকুসুম কল্পনা। তাই অন্তত বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে দুই নেত্রীর বক্তৃতা প্রচার হলে মানুষ সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে মিল খুঁজে পেত। খালেদা জিয়ার বক্তৃতা সরাসরি প্রচার বন্ধ করে সরকার যেমন মন্দ নজির স্থাপন করেছে, তেমনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটা ব্যাপারে ধন্যবাদ দেব। দেরিতে হলেও তিনি স্বীকার করেছেন, ১২ মার্চের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে জনগণ দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। সেই দুর্ভোগের জন্য তিনি দুঃখও প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, সরকার বিরোধী দলের মহাসমাবেশে লোকজনের আসায় বাধা দেয়নি। নাশকতার আশঙ্কায় জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই কথা সত্য হলে আমাদের দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। তাহলে কি দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে, প্রতিটি জেলা শহরে, প্রতিটি উপজেলা শহরে, প্রতিটি লঞ্চঘাটে, প্রতিটি দূরপাল্লার বাস টার্মিনালে এবং প্রতিটি বাস, মিনিবাস, লঞ্চে নাশকতাকারীরা লুকিয়ে ছিল? আর সে কারণেই নিশ্চয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মহাসমাবেশে আগত লোকদের গতি রোধ করেছে; আসতে বাধা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে বলতে হবে, দেশটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে চারদলীয় জোট তথা বিএনপি। একটি মহাসমাবেশ ঠেকাতে যদি তিন-চার দিন ধরে দেশকে অচল করে রাখতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে? বিরোধী দল আরও কঠিন কর্মসূচি দেবে। সরকার আরও বেপরোয়া হবে। একটি কর্মসূচি ঠেকাতে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে। পাল্টা কর্মসূচির প্রতিবাদে বিএনপি হরতাল ডাকবে। আবার সেই হরতাল ঠেকাতে সরকার পুলিশ-বিজিবির পাশাপাশি ছাত্রলীগের ক্যাডারদের মাঠে নামাবে। এভাবেই দেশ চলবে?
আমাদের মনে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো বিরোধী দলের মহাসমাবেশ ঠেকাতে গিয়ে সরকার জনগণের বিরুদ্ধে কেন যুদ্ধ ঘোষণা করল? কেন প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলল রাজধানী? ঢাকা শহরে এক কোটিরও বেশি লোকের বাস। তার পরও কিন্তু ১২ মার্চের মহাসমাবেশে বাইরে থেকে লোক আনতে হয়েছে। অর্থাৎ এই মহানগরে দুই প্রধান জোটকে মহাসমাবেশ করতে হয়েছে বাইরে থেকে লোক এনে। এই যে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে লোক আনা হলো, কেউ বাসে এসেছেন, কেউ ট্রেনে, বাস-ট্রেন না পেয়ে গাড়িতে, টেম্পোতে, নৌকায় এমনকি হেঁটেও অনেকে মহাসমাবেশে এসেছেন। কেন এসেছেন? তাঁরা মনে করেছেন, এটি তাঁদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। সরকারি দলের মহাসমাবেশেও কিন্তু বিভিন্ন জেলার ব্যানার দেখা গেছে। অর্থাৎ তাদেরও একাংশ বাইরে থেকে এসেছে। কারা তাঁদের সংগঠিত করেছেন? কারা খরচ জুগিয়েছেন? অর্থের উৎস কোথায়? সরকারি দলের নেতা বিরোধী দলের সমাবেশে যে ব্যয় হয়েছে, তার উৎস জানতে চান। তার আগে নিজেদের অর্থের উৎসটি জনগণের সামনে প্রকাশ করা উচিত। এটি তাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও। নির্বাচনের আগে তাঁরা বলেছিলেন, প্রত্যেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন। কিন্তু গত তিন বছরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া কেউই হিসাব জনগণকে জানাননি। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের মন্ত্রীদের, সাংসদদের সবকিছুতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন। সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা জনসমক্ষে তাঁদের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করলে বিরোধী দলের কাছেও তা দেওয়ার দাবি করতে পারতেন। কেবল এখনকার নয়, আগের সরকারের আমলেরও। কিন্তু তাঁরা তা করেননি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো ফারাক নেই। ফারাক নেই শুল্কমুক্ত গাড়ি নেওয়ার বেলায়। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ছাড়া নাকি সবাই শুল্কমুক্ত গাড়ি নিয়েছেন। শুল্কমুক্ত গাড়ি না হলে আমাদের ‘গরিব মন্ত্রী’ ও ‘গরিব সাংসদে’রা কীভাবে জনসেবা করবেন?
আমাদের আজকের আলোচনা দুই মহাসমাবেশের মধ্যেই সীমিত রাখতে চাই। বিরোধী দলের নেতাদের একটি সফল সমাবেশ করে অনেক বেশি আস্থাশীল মনে হচ্ছে। তাঁরা ভাবছেন, এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে ছাড়বেন। আর সরকারি দলের ভাবখানা হলো, সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র তারা নস্যাৎ করে দিতে পেরেছে। এটি তাদের মস্ত বড় বিজয়। ভবিষ্যতেও তারা এই বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখবে। এর মধ্যে দুই দলের সমাবেশ থেকেই পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি চলেছে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন ও অমার্জিত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একদল আরেক দলকে বিদেশের দালাল, এজেন্ট বলে অভিহিত করেছে। ভেবে দেখুন, এঁরাই আমাদের জাতীয় নেতা-নেত্রী। এঁদের হাতেই ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ভরশীল।
সবশেষে আবার শুরুর কথটি বলতে চাই, এই যে সরকারি দল ও বিরোধী দল মিলে মহাসমাবেশের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করল, তাতে জনগণের কী লাভ হলো? সরকারি দল হয়তো ভাবছে, কর্মীদের মনোবল চাঙা হয়েছে। বিরোধী দল ভাবছে, তারা ক্ষমতার কাছাকাছি চলে গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ যে চরম দুর্ভোগ আর ভোগান্তিতে পড়ল, আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হলো। তার দায় কার? সরকারি দল, বিরোধী দল উভয়েরই।
যেদিন ১৪ দলের মহাসমাবেশ হলো, তার আগের দিন মেঘনায় লঞ্চ ডুবে গেল। প্রায় দেড় শ মানুষ মারা গেল। কিন্তু নেতারা বক্তব্যে লঞ্চ দুর্ঘটনা সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না। দুঃখ প্রকাশ করলেন না। সবাই বুলন্ধ আওয়াজ তুললেন বিরোধী দলের কথিত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন। অন্যদিকে বিরোধী দলের মহাসমাবেশে ছোট দলের বড় নেতারা শেখ হাসিনার নাম ধরে গালাগাল করলেন। একজনকে ভারতে, অপরজনকে পাকিস্তানে পাঠানোর কথা বললেন। এই আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব। এই আমাদের রাজনীতি।
আমাদের সরকারি দল, আমাদের বিরোধী দল মানুষের কল্যাণ নিয়ে, দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে, লঞ্চ বা বাস দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভাবিত নয়, চিন্তিত নয়। দুর্ঘটনায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের স্বজনদের আহাজারিতে একটুও বিচলিত নন। বিচলিত হলে নৌপরিবহনমন্ত্রী বলতে পারতেন না, ‘লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী ছিল না।’ এত দিন দেখেছি, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের তিনি বাঁচাতে সচেষ্ট ছিলেন। তাদের নিয়ে সমাবেশ করেছেন। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া লাইসেন্স দিয়েছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত, সেই নৌপথও নিরাপদ নয়।
সব শেষে আবারও আগের প্রশ্নটি করতে চাই। এই যে সরকার ও বিরোধী জোট মহাসমাবেশ করে মহাবিজয় অর্জন করল, তা থেকে দেশবাসী কী পেল? দুর্ভোগ, দুর্দশা ও হতাশা ছাড়া কিছুই পায়নি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য অনুযায়ী যদি আমরা ধরে নিই দুই জোটের মহাসমাবেশই সফল হয়েছে। অন্তত পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনামে নেতাদের ভাষণ ছাপা হয়েছে, টেলিভিশন চ্যানেলেও প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে খালেদা জিয়ার সমাবেশের সরাসরি প্রচার কেন বন্ধ হলো, সেই প্রশ্নের জবাব তথ্যমন্ত্রী দিতে পারবেন কি? সরকারি দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো পথে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তারা সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করেছে, কিন্তু দুটি জনসভায় সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে কেন ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করা হলো, দেশের মানুষ তা জানতে পারল না। তারা দেখল, শেখ হাসিনার বক্তৃতা সরাসরি বিটিভিসহ বেশ কিছু টিভি চ্যানেল সরাসরি প্রচার করেছে; কিন্তু খালেদা জিয়ার বক্তৃতার সময় টিভি চ্যানেলগুলো স্তব্ধ হয়ে গেল।
তাহলে কি এখন স্তব্ধতার গণতন্ত্র চলছে? সেটাই সাচ্চা গণতন্ত্র হতো যদি সরকার পরিচালিত বিটিভিতে দুই নেত্রীর বক্তৃতা সরাসরি প্রচার করা হতো। বাংলাদেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের কাছে অতটা চাওয়া বোধ হয় আকাশকুসুম কল্পনা। তাই অন্তত বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে দুই নেত্রীর বক্তৃতা প্রচার হলে মানুষ সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে মিল খুঁজে পেত। খালেদা জিয়ার বক্তৃতা সরাসরি প্রচার বন্ধ করে সরকার যেমন মন্দ নজির স্থাপন করেছে, তেমনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটা ব্যাপারে ধন্যবাদ দেব। দেরিতে হলেও তিনি স্বীকার করেছেন, ১২ মার্চের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে জনগণ দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। সেই দুর্ভোগের জন্য তিনি দুঃখও প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, সরকার বিরোধী দলের মহাসমাবেশে লোকজনের আসায় বাধা দেয়নি। নাশকতার আশঙ্কায় জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই কথা সত্য হলে আমাদের দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। তাহলে কি দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে, প্রতিটি জেলা শহরে, প্রতিটি উপজেলা শহরে, প্রতিটি লঞ্চঘাটে, প্রতিটি দূরপাল্লার বাস টার্মিনালে এবং প্রতিটি বাস, মিনিবাস, লঞ্চে নাশকতাকারীরা লুকিয়ে ছিল? আর সে কারণেই নিশ্চয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মহাসমাবেশে আগত লোকদের গতি রোধ করেছে; আসতে বাধা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে বলতে হবে, দেশটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে চারদলীয় জোট তথা বিএনপি। একটি মহাসমাবেশ ঠেকাতে যদি তিন-চার দিন ধরে দেশকে অচল করে রাখতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে? বিরোধী দল আরও কঠিন কর্মসূচি দেবে। সরকার আরও বেপরোয়া হবে। একটি কর্মসূচি ঠেকাতে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে। পাল্টা কর্মসূচির প্রতিবাদে বিএনপি হরতাল ডাকবে। আবার সেই হরতাল ঠেকাতে সরকার পুলিশ-বিজিবির পাশাপাশি ছাত্রলীগের ক্যাডারদের মাঠে নামাবে। এভাবেই দেশ চলবে?
আমাদের মনে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো বিরোধী দলের মহাসমাবেশ ঠেকাতে গিয়ে সরকার জনগণের বিরুদ্ধে কেন যুদ্ধ ঘোষণা করল? কেন প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলল রাজধানী? ঢাকা শহরে এক কোটিরও বেশি লোকের বাস। তার পরও কিন্তু ১২ মার্চের মহাসমাবেশে বাইরে থেকে লোক আনতে হয়েছে। অর্থাৎ এই মহানগরে দুই প্রধান জোটকে মহাসমাবেশ করতে হয়েছে বাইরে থেকে লোক এনে। এই যে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে লোক আনা হলো, কেউ বাসে এসেছেন, কেউ ট্রেনে, বাস-ট্রেন না পেয়ে গাড়িতে, টেম্পোতে, নৌকায় এমনকি হেঁটেও অনেকে মহাসমাবেশে এসেছেন। কেন এসেছেন? তাঁরা মনে করেছেন, এটি তাঁদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। সরকারি দলের মহাসমাবেশেও কিন্তু বিভিন্ন জেলার ব্যানার দেখা গেছে। অর্থাৎ তাদেরও একাংশ বাইরে থেকে এসেছে। কারা তাঁদের সংগঠিত করেছেন? কারা খরচ জুগিয়েছেন? অর্থের উৎস কোথায়? সরকারি দলের নেতা বিরোধী দলের সমাবেশে যে ব্যয় হয়েছে, তার উৎস জানতে চান। তার আগে নিজেদের অর্থের উৎসটি জনগণের সামনে প্রকাশ করা উচিত। এটি তাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও। নির্বাচনের আগে তাঁরা বলেছিলেন, প্রত্যেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন। কিন্তু গত তিন বছরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া কেউই হিসাব জনগণকে জানাননি। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের মন্ত্রীদের, সাংসদদের সবকিছুতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন। সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা জনসমক্ষে তাঁদের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করলে বিরোধী দলের কাছেও তা দেওয়ার দাবি করতে পারতেন। কেবল এখনকার নয়, আগের সরকারের আমলেরও। কিন্তু তাঁরা তা করেননি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো ফারাক নেই। ফারাক নেই শুল্কমুক্ত গাড়ি নেওয়ার বেলায়। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ছাড়া নাকি সবাই শুল্কমুক্ত গাড়ি নিয়েছেন। শুল্কমুক্ত গাড়ি না হলে আমাদের ‘গরিব মন্ত্রী’ ও ‘গরিব সাংসদে’রা কীভাবে জনসেবা করবেন?
আমাদের আজকের আলোচনা দুই মহাসমাবেশের মধ্যেই সীমিত রাখতে চাই। বিরোধী দলের নেতাদের একটি সফল সমাবেশ করে অনেক বেশি আস্থাশীল মনে হচ্ছে। তাঁরা ভাবছেন, এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে ছাড়বেন। আর সরকারি দলের ভাবখানা হলো, সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র তারা নস্যাৎ করে দিতে পেরেছে। এটি তাদের মস্ত বড় বিজয়। ভবিষ্যতেও তারা এই বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখবে। এর মধ্যে দুই দলের সমাবেশ থেকেই পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি চলেছে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন ও অমার্জিত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একদল আরেক দলকে বিদেশের দালাল, এজেন্ট বলে অভিহিত করেছে। ভেবে দেখুন, এঁরাই আমাদের জাতীয় নেতা-নেত্রী। এঁদের হাতেই ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ভরশীল।
সবশেষে আবার শুরুর কথটি বলতে চাই, এই যে সরকারি দল ও বিরোধী দল মিলে মহাসমাবেশের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করল, তাতে জনগণের কী লাভ হলো? সরকারি দল হয়তো ভাবছে, কর্মীদের মনোবল চাঙা হয়েছে। বিরোধী দল ভাবছে, তারা ক্ষমতার কাছাকাছি চলে গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ যে চরম দুর্ভোগ আর ভোগান্তিতে পড়ল, আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হলো। তার দায় কার? সরকারি দল, বিরোধী দল উভয়েরই।
যেদিন ১৪ দলের মহাসমাবেশ হলো, তার আগের দিন মেঘনায় লঞ্চ ডুবে গেল। প্রায় দেড় শ মানুষ মারা গেল। কিন্তু নেতারা বক্তব্যে লঞ্চ দুর্ঘটনা সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না। দুঃখ প্রকাশ করলেন না। সবাই বুলন্ধ আওয়াজ তুললেন বিরোধী দলের কথিত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন। অন্যদিকে বিরোধী দলের মহাসমাবেশে ছোট দলের বড় নেতারা শেখ হাসিনার নাম ধরে গালাগাল করলেন। একজনকে ভারতে, অপরজনকে পাকিস্তানে পাঠানোর কথা বললেন। এই আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব। এই আমাদের রাজনীতি।
আমাদের সরকারি দল, আমাদের বিরোধী দল মানুষের কল্যাণ নিয়ে, দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে, লঞ্চ বা বাস দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভাবিত নয়, চিন্তিত নয়। দুর্ঘটনায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের স্বজনদের আহাজারিতে একটুও বিচলিত নন। বিচলিত হলে নৌপরিবহনমন্ত্রী বলতে পারতেন না, ‘লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী ছিল না।’ এত দিন দেখেছি, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের তিনি বাঁচাতে সচেষ্ট ছিলেন। তাদের নিয়ে সমাবেশ করেছেন। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া লাইসেন্স দিয়েছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত, সেই নৌপথও নিরাপদ নয়।
সব শেষে আবারও আগের প্রশ্নটি করতে চাই। এই যে সরকার ও বিরোধী জোট মহাসমাবেশ করে মহাবিজয় অর্জন করল, তা থেকে দেশবাসী কী পেল? দুর্ভোগ, দুর্দশা ও হতাশা ছাড়া কিছুই পায়নি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments