বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-সরকার বনাম অদৃশ্য হাতের কারসাজি by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
সিন্ডিকেট' শব্দটি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে একটি বহুল আলোচিত শব্দ। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মিডিয়ায় লেখালেখি হয় কিংবা জনসমাজে যখনই কথা ওঠে, তখনই 'সিন্ডিকেট' শব্দটি সংগত কারণেই প্রাধান্য পায়।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলের তরফে 'সিন্ডিকেট'-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে অতীতে প্রত্যক্ষ আপত্তি জানানো হয়েছে এবং 'সিন্ডিকেট' অর্থাৎ অদৃশ্য এই হাতের কারসাজিতে বাজার বারবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে, এই সত্যও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু বিলম্বে হলেও সরকার বিষয়টি আমলে নিতে বাধ্য হয়েছে এবং প্রত্যক্ষভাবে অদৃশ্য হাতের কারসাজি স্বীকারও করেছে। অবশেষে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার সব রকম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে কারসাজি নিয়ন্ত্রণে 'প্রতিযোগিতা আইন ২০১২' বিল হিসেবে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছে। ৭ মার্চ ২০১২, বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম কাদের (জিএম কাদের) বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপনের পর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। এ জন্য সময় দেওয়া হয়েছে ৩০ দিন। বিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, 'উদার বাণিজ্য ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাজারের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করছে। ফলে একদিকে ভোক্তাদের স্বার্থ বিঘি্নত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।' পূর্বতন বাণিজ্যমন্ত্রী যিনি এখন বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বাজার নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যত নানা রকম পদক্ষেপ কিংবা উদ্যোগ আয়োজনের ব্যবস্থা নিলেও বিস্ময়করভাবে লক্ষ করা গেছে, যখনই তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন, এর পর পরই বাজারে আরেক দফা উত্তাপ বেড়েছে অর্থাৎ পণ্যমূল্য লাফ দিয়ে আরো একধাপ বেড়েছে। দুর্মুখেরা এ নিয়ে নানা রকম কথা বলেছেন কিন্তু এটা তো সত্য, বিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যর্থতার স্বাক্ষর রেখেই এ মন্ত্রণালয় ত্যাগ করেছেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে মহাজোট সরকারের সাফল্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেও বাজার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দাগটি মোটা। নিকট অতীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে পণ্যমূল্যের ক্রম ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে 'সিন্ডিকেট' নিয়ে সমন্বিত অনুসন্ধান চালানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। বাজারদরের ঊর্ধ্বমুখী চাপে এমনিতেই জনজীবনে বিরাজ করছে চরম অস্বস্তি। এর মধ্যে দফায় দফায় জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিও এ ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, যা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার শামিল। নানা মহল থেকে বাজারব্যবস্থার উন্নয়ন ও সরকারের নজরদারি কঠোর করার তাগিদ আসছে বারবার। কৃত্রিমভাবে পণ্য সংকট সৃষ্টি করে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে- এ অভিযোগও উঠেছে বহুবার। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা শুধু তত্ত্বকথা আওড়িয়েই সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন। মাঝেমধ্যে ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠকে বসেছেন, নানা রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, উভয় তরফ থেকে প্রতিশ্রুতি-অঙ্গীকারও কম ব্যক্ত হয়নি, কিন্তু কার্যত ফল শূন্যই থেকে গেছে। দৃশ্যত বাজার নিয়ন্ত্রণে এসব পদক্ষেপ কিংবা আয়োজন প্রশ্নের পর প্রশ্নও দাঁড় করিয়েছে এবং দায়িত্বশীলদের ভূমিকাও বিস্ময়কর ঠেকেছে। একদিকে কৃষক তাঁর উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে তাঁকে ক্রমেই উচ্চমূল্যে নিত্যপণ্য ক্রয় করতে হচ্ছে। ফলে জীবনযাত্রা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে। এ চিত্র তো বহুবারই দেখা গেছে যে আমদানি করতে হয় না এমন পণ্যদ্রব্যের দামও যখন-তখন স্বেচ্ছাচারী অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদাররা বাড়িয়ে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বগতির দোহাই দিয়ে। সিন্ডিকেটের কবলে যে শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যই রয়েছে তা-ই নয়, জীবনরক্ষাকারী ওষুধের বাজারও তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। বিগত দুই মাসে ওষুধের মূল্য ক্রমেই বাড়ছে, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই। এ ক্ষেত্রেও সরকারের সবকিছু ছাপিয়ে অদৃশ্য হাতের কারসাজি যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, চার বছর ধরে অকার্যকর হয়ে রয়েছে বাজার উপদেষ্টা কমিটি। ২০০৮ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ২১ সদস্যের বাজার উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই কমিটির কোনো কার্যক্রমই নেই। এমনকি ঢাকা জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটির অনেকেই জানেন না কমিটিতে তাঁকে সদস্য করা হয়েছে (সূত্র : ১০ মার্চ ২০১২, সকালের খবর)। এদিকে একেবারে ভেস্তে গেছে রাজধানীর বাজার কার্যক্রম অভিযান। নামকাওয়াস্তে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বিএসটিআই মাঝেমধ্যে বাজারে অভিযান চালালেও এর কোনো দৃশ্যমান ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায় না। মূলত বাজার নামক অত্যন্ত স্পর্শকাতর ক্ষেত্রটি কতিপয় অসাধুর মুঠোবন্দি রয়েছে এবং কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই তারা তাদের আখের গোছাচ্ছে। ইতিমধ্যে বহুবার বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে ভোজ্য তেলসহ কোনো কোনো পণ্যের মূল্যনির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায়নি; বরং বাজার চলেছে ওই অসাধুদের কিংবা অদৃশ্য হাতের কারসাজিতেই। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কার ক্ষমতা বেশি? সরকার না স্বেচ্ছাচারী অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের? এদের মূল্যসন্ত্রাসী বললেও অত্যুক্তি হয় না। সরকার কেন তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে? কেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না? এর পেছনে রহস্য কী?
সরকারের বোধোদয় ঘটেছে অনেক বিলম্বে। পাশাপাশি এত দিন যে অপশক্তির অস্তিত্বই তারা স্বীকার করেনি, এখন তা স্বীকার করেছে এবং অবশেষে 'সিন্ডিকেট' নিয়ন্ত্রণে বিল উত্থাপন করেছে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার, আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, আইনের যথাযথ প্রয়োগই হলো মূল কথা। বাংলাদেশে আইনের কোনো অভাব নেই; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের কোনো কার্যকারিতাই নেই। মহাজোট সরকারের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা এবং তা সাধারণ মানুষের নাগালে রাখা। তারা ক্ষমতা নেওয়ার পর বাজার কিছুটা (উল্লেখ্য, বিগত প্রায় ১ দশক ধরে বাজার চিত্র স্বাভাবিক সংজ্ঞার মধ্যে নেই) নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এলেও বেশি দিন তা রক্ষা করা যায়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী 'সিন্ডিকেট'-এর কাছে প্রায় নতিস্বীকার করতে হলো। পণ্যদ্রব্যের দাম আবার ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করল। মোদ্দাকথা, সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেল বাজার! জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেল এবং দুর্বিষহ জীবনযাত্রার ভারে সাধারণ মানুষ নুইয়ে পড়েছে। শুধু বাজার নয়, বিরূপ ধাক্কা লাগল অন্য খাতেও, যে খাতগুলো সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এককালে টিসিবি নামক যে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের ব্যাপক কল্যাণ সাধন করেছিল, বাজারে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটি কোন অশুভ শক্তির স্বার্থ হাসিলে প্রায় অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো- এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়ও সরকারেরই। ইতিমধ্যে নানা মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে টিসিবিকে দৃশ্যত কার্যকর ও গতিশীল করার কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বটে কিন্তু তা-ও প্রশ্নমুক্ত নয়। অদূরদর্শী এসব পদক্ষেপের কোনোই সুফল মেলেনি এবং টিসিবির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করে ভোক্তাদের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়নি। এ দেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা ভালো না করে অবস্থা ভালোর যে প্রত্যাশা করা হয়, তা বড় হাস্যকর যুগপৎ বিস্ময়করও।
'সিন্ডিকেট' ভাঙার জন্য কিংবা 'সিন্ডিকেট'-এর অস্তিত্ব নির্মূল করার জন্য ইতিপূর্বে আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছিল। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক বাজার তদারক করতে মাঠে নামানো হলো ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না! এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, নতুন আইন প্রণয়ন করার এবং এ লক্ষ্যেই 'প্রতিযোগিতা আইন ২০১২' বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হলো। এর লক্ষ্য হলো ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ উৎসাহিত করা এবং ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, মনোপলি, কিছুসংখ্যক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের 'সিন্ডিকেট' কিংবা জোটবদ্ধ হয়ে কোনো পণ্য বা বাজার নিয়ন্ত্রণ রোধ করা। ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রোগটা চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও যথোপযুক্ত দাওয়াই দিতে এত দিন ধরে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে কেন? 'সিন্ডিকেট' নামক চক্রটি কিংবা অদৃশ্য হাত কি এতই শক্তিশালী যে এদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস কিংবা ক্ষমতা সরকারের নেই? নাকি এখানে অন্য কোনো 'কিন্তু' আছে যে 'কিন্তু' ক্ষমতাবান স্বেচ্ছাচারীদের উদর ভরতে ভূমিকা রাখছে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে? একদিকে সরকার বলছে, তাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই; অন্যদিকে অশুভ শক্তির দাপাদাপিতে সমাজদেহ থরথর করছে। এমন বিপরীত চিত্র জিইয়ে থাকার দায় নেবে কে? আমরা বিশ্বাস করতে চাই, 'সিন্ডিকেট' কিংবা অদৃশ্য হাত যতই শক্তিশালী হোক কিংবা তাদের কর্মকাণ্ড যতই বিস্তৃত হোক, এর কোনোটিই সরকারের চেয়ে বলবান কিংবা প্রসারিত নয়। যেহেতু বিলম্বে হলেও সরকার প্রকাশ্যে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে, তাই সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটনে ওই আইনের অপেক্ষা না করেও প্রচলিত আইনেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অবকাশ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এই সত্য যত দ্রুত উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন, ততই মঙ্গল। এ দেশে 'সাঁড়াশি অভিযান', 'চিরুনি অভিযান' শব্দযুগলগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এর অস্তিত্বও লক্ষ করেছি। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের ক্ষেত্রে নব্বইয়ের দশকে এবং এর পরও এমন অভিযান চালানো হয়েছে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ হাসিলে। প্রশ্ন হচ্ছে, জনস্বার্থ হাসিলে ওই রকম অভিযান চালাতে সরকারের অনীহা কেন?
লেখক : সাংবাদিক
deba _bishnu@yahoo.com
সরকারের বোধোদয় ঘটেছে অনেক বিলম্বে। পাশাপাশি এত দিন যে অপশক্তির অস্তিত্বই তারা স্বীকার করেনি, এখন তা স্বীকার করেছে এবং অবশেষে 'সিন্ডিকেট' নিয়ন্ত্রণে বিল উত্থাপন করেছে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার, আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, আইনের যথাযথ প্রয়োগই হলো মূল কথা। বাংলাদেশে আইনের কোনো অভাব নেই; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের কোনো কার্যকারিতাই নেই। মহাজোট সরকারের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা এবং তা সাধারণ মানুষের নাগালে রাখা। তারা ক্ষমতা নেওয়ার পর বাজার কিছুটা (উল্লেখ্য, বিগত প্রায় ১ দশক ধরে বাজার চিত্র স্বাভাবিক সংজ্ঞার মধ্যে নেই) নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এলেও বেশি দিন তা রক্ষা করা যায়নি। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী 'সিন্ডিকেট'-এর কাছে প্রায় নতিস্বীকার করতে হলো। পণ্যদ্রব্যের দাম আবার ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করল। মোদ্দাকথা, সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেল বাজার! জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেল এবং দুর্বিষহ জীবনযাত্রার ভারে সাধারণ মানুষ নুইয়ে পড়েছে। শুধু বাজার নয়, বিরূপ ধাক্কা লাগল অন্য খাতেও, যে খাতগুলো সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এককালে টিসিবি নামক যে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের ব্যাপক কল্যাণ সাধন করেছিল, বাজারে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটি কোন অশুভ শক্তির স্বার্থ হাসিলে প্রায় অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো- এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়ও সরকারেরই। ইতিমধ্যে নানা মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে টিসিবিকে দৃশ্যত কার্যকর ও গতিশীল করার কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বটে কিন্তু তা-ও প্রশ্নমুক্ত নয়। অদূরদর্শী এসব পদক্ষেপের কোনোই সুফল মেলেনি এবং টিসিবির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করে ভোক্তাদের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়নি। এ দেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা ভালো না করে অবস্থা ভালোর যে প্রত্যাশা করা হয়, তা বড় হাস্যকর যুগপৎ বিস্ময়করও।
'সিন্ডিকেট' ভাঙার জন্য কিংবা 'সিন্ডিকেট'-এর অস্তিত্ব নির্মূল করার জন্য ইতিপূর্বে আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছিল। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক বাজার তদারক করতে মাঠে নামানো হলো ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না! এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, নতুন আইন প্রণয়ন করার এবং এ লক্ষ্যেই 'প্রতিযোগিতা আইন ২০১২' বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হলো। এর লক্ষ্য হলো ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ উৎসাহিত করা এবং ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, মনোপলি, কিছুসংখ্যক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের 'সিন্ডিকেট' কিংবা জোটবদ্ধ হয়ে কোনো পণ্য বা বাজার নিয়ন্ত্রণ রোধ করা। ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রোগটা চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও যথোপযুক্ত দাওয়াই দিতে এত দিন ধরে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে কেন? 'সিন্ডিকেট' নামক চক্রটি কিংবা অদৃশ্য হাত কি এতই শক্তিশালী যে এদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস কিংবা ক্ষমতা সরকারের নেই? নাকি এখানে অন্য কোনো 'কিন্তু' আছে যে 'কিন্তু' ক্ষমতাবান স্বেচ্ছাচারীদের উদর ভরতে ভূমিকা রাখছে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে? একদিকে সরকার বলছে, তাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই; অন্যদিকে অশুভ শক্তির দাপাদাপিতে সমাজদেহ থরথর করছে। এমন বিপরীত চিত্র জিইয়ে থাকার দায় নেবে কে? আমরা বিশ্বাস করতে চাই, 'সিন্ডিকেট' কিংবা অদৃশ্য হাত যতই শক্তিশালী হোক কিংবা তাদের কর্মকাণ্ড যতই বিস্তৃত হোক, এর কোনোটিই সরকারের চেয়ে বলবান কিংবা প্রসারিত নয়। যেহেতু বিলম্বে হলেও সরকার প্রকাশ্যে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে, তাই সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটনে ওই আইনের অপেক্ষা না করেও প্রচলিত আইনেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অবকাশ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এই সত্য যত দ্রুত উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন, ততই মঙ্গল। এ দেশে 'সাঁড়াশি অভিযান', 'চিরুনি অভিযান' শব্দযুগলগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এর অস্তিত্বও লক্ষ করেছি। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের ক্ষেত্রে নব্বইয়ের দশকে এবং এর পরও এমন অভিযান চালানো হয়েছে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ হাসিলে। প্রশ্ন হচ্ছে, জনস্বার্থ হাসিলে ওই রকম অভিযান চালাতে সরকারের অনীহা কেন?
লেখক : সাংবাদিক
deba _bishnu@yahoo.com
No comments