চারদিক-দুর্যোগে সহায় কমিউনিটি রেডিও by বদরুল হায়দার চৌধুরী
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। ‘সিডর’ নামের প্রাকৃতিক দানব হানা দেয় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। এর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা অনেকেরই জানা। সে সময়ের একটি ঘটনা। বাগেরহাট জেলার সাউথখালী গ্রামের মুনিরা বেগম এই প্রাকৃতিক দানবের এক নির্মম শিকার। এই নির্মমতার কাহিনি শোনা যাক তাঁর কাছ থেকে: ‘সন্ধ্যার দিকে নিজ ঘরে বসে ছিলাম।
পাশেই ছিল স্বামী ও দুই ছেলে। হঠাৎ গর্জন শোনা যায়। বাইরে বের হয়ে দেখি, বড় গাছের সমান উঁচু ঢেউ আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যেই ছিটকে পড়লাম স্বামী ও সন্তানদের কাছ থেকে। ভেসে যাওয়ার সময় বড় একটি গাছ হাতের নাগালে এল। আঁকড়ে ধরলাম সব শক্তি দিয়ে। ঝড় থেমে যাওয়ার পর কোনো রকমে বেঁচে যাওয়া স্বামী ও এক ছেলেকে খুঁজে পাই। অন্য ছেলেটিকে আর পাওয়া যায়নি।’
এই মর্মন্তুদ কাহিনি বর্ণনা করার সময় মুনিরা বেগমের দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। তিনি বলেছিলেন, ‘এ সময় বাড়িতে বা প্রতিবেশী কারও কাছেই রেডিও ছিল না। রেডিও থাকলে হয়তো খবর আগেই জানতে পারতাম। সিডর আসার আগেই নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ারও সুযোগ পেতাম।’ কমিউনিটি রেডিও স্টেশন চালু হলে শুধু এ রকম দুর্যোগেই নয়, সমাজ-জীবনের অনেক খবরই জানা যাবে।
গ্রামীণ ও উপকূলীয় জনপদে বসবাসকারী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কমিউনিটি রেডিওর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নেপালের রেডিও সাগরমাথা, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের ‘মানা’ রেডিও, বিহারের ‘রাগব’ এফএম, ক্যাম্পাস ‘অ্যানা’ রেডিও, শ্রীলঙ্কার ‘কোতমালে’ কমিউনিটি রেডিও নিজেদের মানুষের শিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। শ্রীলঙ্কায় ১৯৮৯, নেপালে ১৯৯৭, ভারতে ২০০৬ সাল থেকে কমিউনিটি রেডিও কাজ করে চলেছে।
ভারতে বর্তমানে প্রায় ছয় হাজার এবং থাইল্যান্ডে প্রায় তিন হাজার কমিউনিটি রেডিও সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে চলেছে। ইউনেসকোর সহযোগিতায় ২০০১ সাল থেকে দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকার মালি, মোজাম্বিক, সেনেগাল, এশিয়ার কিছু অঞ্চল ও ক্যারিবিয়ায় কমিউনিটি রেডিও সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বলিভিয়ার খনিশ্রমিকেরা কমিউনিটি রেডিওকে তাঁদের জীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় কৌশল-যন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। রেডিও স্টেশন সচল রাখার জন্য তাঁরা প্রতি মাসে এক দিনের বেতন কর্তৃপক্ষকে দান করে দেন।
ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে দিন দিন কমিউনিটি রেডিওর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বর্তমানে জাভা দ্বীপে চার শতাধিক কমিউনিটি রেডিও চালু রয়েছে। গত চার বছরে গণতন্ত্র ও সমাজ উন্নয়নে এ ধরনের রেডিও স্টেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই দ্বীপের ইয়োগিয়াকার্তায় অবস্থিত একটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের নাম ‘অ্যাংক্রিংগান’। গ্রামের মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষায় এ স্টেশনটি পরিচালনা করে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহৎ বদ্বীপ রাষ্ট্র। এর চারদিক সাগর, পর্বত ও নদীবেষ্টিত। এর উপকূলের শত শত গ্রামে বাস করছে লাখ লাখ মানুষ। এ ছাড়া উপকূল ও সীমান্তসংলগ্ন বেশির ভাগ গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। শীতকাল ছাড়া বছরের বেশির ভাগ সময়ই এসব অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন কাটায়। এসব অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষের ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। এসব অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একাত্ম করতে হলে অতি দ্রুত কমিউনিটি রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
২০১০ সালের ২২ এপ্রিল সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ দেশে কমিউনিটি রেডিওর কার্যক্রমকে অনুমোদন দিয়েছে। অবশ্য এ জন্য ১২ বছর ধরে সংগ্রাম করতে হয়েছে। বিভিন্ন এনজিও, নাগরিক সমাজ ও কিছু সংগঠন এ লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালায়। এসব সংগঠন দেশে কমিউনিটি রেডিওর কার্যক্রম চালু করার জন্য সরকারের সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছে। তুলে ধরেছে এর যৌক্তিকতা। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজ এ দেশে নিজস্ব কমিউনিটির উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে নতুন ধরনের এক রেডিও স্টেশন, যার নাম কমিউনিটি রেডিও। যেসব প্রতিষ্ঠান এ দেশে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তার মধ্যে অন্যতম ‘বিএনএনআরসি’। ১২ বছর ধরেই এই সংগঠন ও এর কর্ণধারদের এ বিষয়ে ব্যাপক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করতে দেখা গেছে। গত বছর সরকার দেশে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ পর্যন্ত ১৭৯টি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাওয়ার জন্য আবেদন করে। এর মধ্যে সম্প্রতি ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে এ দেশে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। জুন মাসের মধ্যে এসব রেডিও স্টেশনের সম্প্রচার শুরু করার কথা। ইতিমধ্যেই অনেকের মনেই এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন উঁকি মারছে। কেমন হবে এই রেডিও স্টেশনগুলোর কার্যক্রম? এগুলো কি বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে যাবে?
প্রথমেই বুঝতে হবে, কমিউনিটি কী? কমিউনিটি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী, যার অন্তর্ভুক্ত মানুষজনের একই ধরনের কিছু লোকজ, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা নির্দিষ্ট কোনো বিশেষ শহর, গ্রাম কিংবা মহল্লার মধ্যে থেকে পারস্পরিক আদান-প্রদান করে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিপণন, সেবা ও মালামাল লেনদেনের মাধ্যমে একই অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অংশীদার হয়ে ওঠে। কমিউনিটি রেডিও হলো স্থানীয় জনসেবামূলক এক ধরনের প্রতিষ্ঠান, যা পুরো জাতির পরিবর্তে কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করবে। কমিউনিটি রেডিও একটি কমিউনিটির নিজস্ব সম্পদ, যা একটি জনপদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, বিচার-বিবেচনা ও চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটাবে।
বদরুল হায়দার চৌধুরী
এই মর্মন্তুদ কাহিনি বর্ণনা করার সময় মুনিরা বেগমের দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। তিনি বলেছিলেন, ‘এ সময় বাড়িতে বা প্রতিবেশী কারও কাছেই রেডিও ছিল না। রেডিও থাকলে হয়তো খবর আগেই জানতে পারতাম। সিডর আসার আগেই নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ারও সুযোগ পেতাম।’ কমিউনিটি রেডিও স্টেশন চালু হলে শুধু এ রকম দুর্যোগেই নয়, সমাজ-জীবনের অনেক খবরই জানা যাবে।
গ্রামীণ ও উপকূলীয় জনপদে বসবাসকারী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কমিউনিটি রেডিওর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নেপালের রেডিও সাগরমাথা, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের ‘মানা’ রেডিও, বিহারের ‘রাগব’ এফএম, ক্যাম্পাস ‘অ্যানা’ রেডিও, শ্রীলঙ্কার ‘কোতমালে’ কমিউনিটি রেডিও নিজেদের মানুষের শিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। শ্রীলঙ্কায় ১৯৮৯, নেপালে ১৯৯৭, ভারতে ২০০৬ সাল থেকে কমিউনিটি রেডিও কাজ করে চলেছে।
ভারতে বর্তমানে প্রায় ছয় হাজার এবং থাইল্যান্ডে প্রায় তিন হাজার কমিউনিটি রেডিও সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে চলেছে। ইউনেসকোর সহযোগিতায় ২০০১ সাল থেকে দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকার মালি, মোজাম্বিক, সেনেগাল, এশিয়ার কিছু অঞ্চল ও ক্যারিবিয়ায় কমিউনিটি রেডিও সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বলিভিয়ার খনিশ্রমিকেরা কমিউনিটি রেডিওকে তাঁদের জীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় কৌশল-যন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। রেডিও স্টেশন সচল রাখার জন্য তাঁরা প্রতি মাসে এক দিনের বেতন কর্তৃপক্ষকে দান করে দেন।
ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে দিন দিন কমিউনিটি রেডিওর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বর্তমানে জাভা দ্বীপে চার শতাধিক কমিউনিটি রেডিও চালু রয়েছে। গত চার বছরে গণতন্ত্র ও সমাজ উন্নয়নে এ ধরনের রেডিও স্টেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই দ্বীপের ইয়োগিয়াকার্তায় অবস্থিত একটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের নাম ‘অ্যাংক্রিংগান’। গ্রামের মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষায় এ স্টেশনটি পরিচালনা করে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহৎ বদ্বীপ রাষ্ট্র। এর চারদিক সাগর, পর্বত ও নদীবেষ্টিত। এর উপকূলের শত শত গ্রামে বাস করছে লাখ লাখ মানুষ। এ ছাড়া উপকূল ও সীমান্তসংলগ্ন বেশির ভাগ গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। শীতকাল ছাড়া বছরের বেশির ভাগ সময়ই এসব অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন কাটায়। এসব অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষের ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। এসব অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একাত্ম করতে হলে অতি দ্রুত কমিউনিটি রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
২০১০ সালের ২২ এপ্রিল সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ দেশে কমিউনিটি রেডিওর কার্যক্রমকে অনুমোদন দিয়েছে। অবশ্য এ জন্য ১২ বছর ধরে সংগ্রাম করতে হয়েছে। বিভিন্ন এনজিও, নাগরিক সমাজ ও কিছু সংগঠন এ লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালায়। এসব সংগঠন দেশে কমিউনিটি রেডিওর কার্যক্রম চালু করার জন্য সরকারের সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছে। তুলে ধরেছে এর যৌক্তিকতা। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজ এ দেশে নিজস্ব কমিউনিটির উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে নতুন ধরনের এক রেডিও স্টেশন, যার নাম কমিউনিটি রেডিও। যেসব প্রতিষ্ঠান এ দেশে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তার মধ্যে অন্যতম ‘বিএনএনআরসি’। ১২ বছর ধরেই এই সংগঠন ও এর কর্ণধারদের এ বিষয়ে ব্যাপক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করতে দেখা গেছে। গত বছর সরকার দেশে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ পর্যন্ত ১৭৯টি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাওয়ার জন্য আবেদন করে। এর মধ্যে সম্প্রতি ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে এ দেশে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। জুন মাসের মধ্যে এসব রেডিও স্টেশনের সম্প্রচার শুরু করার কথা। ইতিমধ্যেই অনেকের মনেই এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন উঁকি মারছে। কেমন হবে এই রেডিও স্টেশনগুলোর কার্যক্রম? এগুলো কি বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে যাবে?
প্রথমেই বুঝতে হবে, কমিউনিটি কী? কমিউনিটি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী, যার অন্তর্ভুক্ত মানুষজনের একই ধরনের কিছু লোকজ, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা নির্দিষ্ট কোনো বিশেষ শহর, গ্রাম কিংবা মহল্লার মধ্যে থেকে পারস্পরিক আদান-প্রদান করে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিপণন, সেবা ও মালামাল লেনদেনের মাধ্যমে একই অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অংশীদার হয়ে ওঠে। কমিউনিটি রেডিও হলো স্থানীয় জনসেবামূলক এক ধরনের প্রতিষ্ঠান, যা পুরো জাতির পরিবর্তে কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করবে। কমিউনিটি রেডিও একটি কমিউনিটির নিজস্ব সম্পদ, যা একটি জনপদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, বিচার-বিবেচনা ও চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটাবে।
বদরুল হায়দার চৌধুরী
No comments