চারদিক-‘মা মইরা গেল, ঈদ কেমনে করমু’
শামীম মন খারাপ করে বলে, ‘মায়েরে প্রতি ঈদে ৫০০ ট্যাকা দিয়া শাড়ি কিন্যা দিতাম। ঈদের দিন মা সেমাই, গোশত রানত। তারপর খাইয়্যা মায়ের লগে সারা দিন রবীন্দ্রসরোবরে ঘুরতাম। খুব মজা করতাম। মা-ডা হঠাৎ কইরা মইরা গেল। তাই ঈদ আর কেমনে করমু?’
ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে যারা নিয়মিত যায়, তাদের কাছে শামীম পরিচিত। তিনটি ছোট চাকার ওপর কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তিন কোনা করে বানানো ভ্যানের আদলে তৈরি যানে বসে সে ছুটে বেড়ায়। চাকার ঘড়ঘড় শব্দ শুনেই সবাই বুঝতে পারে, শামীম আসছে। যারা একটু বেশি পরিচিত, তাদের কাছে এসেই একগাল হেসে শামীম বলে, ‘তোমরা ভালা আছ?’ শামীমের হাসি ও আন্তরিকতার কাছে সবাই হার মানে। যে যা পারে তা-ই দেয়। কেউ কেউ শামীমকে চা, শিঙাড়া খাওয়ার জন্য বলে। শামীমের শরীর ও মন ভালো থাকলেই কেবল খাওয়ার ব্যাপারে ‘হ্যাঁ’ করে। ইদানীং শামীমের মুখ থেকে সেই পরিচিত হাসিটুকু মুছে গেছে। ২০ দিন আগে তার মা হঠাৎ মারা গেছেন।
১৪ বছরের শামীম কখনো দাঁড়াতে পারে না। বেঁকে যাওয়া দুই পা শুধু একটু লম্বা করতে পারে। বেঁকে যাওয়া দুই হাত দিয়েও তেমন কিছু করতে পারে না। বাথরুমে যেতে হয় অন্যের সাহায্য নিয়ে। তবে শামীম তার উপযোগী করে তৈরি যানে বসে, দুই হাতকে বৈঠার মতো ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করতে পারে। কিন্তু তার বড় ভাই শাহীনের বেঁকে যাওয়া ছোট ছোট হাত-পা নিয়ে নাড়াচাড়ার ক্ষমতা নেই। সে বসে থাকে রবীন্দ্রসরোবরের ফটকের বাইরে একটি গাছের নিচে।
শামীম বলে, ‘মায়ের নাক, মুখ দিয়া আগেও রক্ত পড়ত। হেই দিনও সকালে রক্ত পড়ে। তার পরও মা গরম ভাত রাইনদ্যা দুই ভাইরে খাওয়ায়। কয়, সন্ধ্যায় ওষুধ খাইলে ভালা হইয়া যাইব। আমিও মনে মনে ভাবি, সন্ধ্যায় মায়ের লাইগ্যা ওষুধ নিয়া বাড়ি ফিরমু। কামে চইল্যা আওয়ার পর শুনি, মা মইরা গেছে।’
শামীম বলতেই থাকে, ‘কামে আইলে মা একটু পর পর আইত, চুমু খাইত। হেই রকম আদর আর কেউ করে না। দোয়া করত। আয়ও ভালা হইত। মা নাই, কেউ দোয়া করে না। মন খারাপের লাইগ্যা আগের মতো মানুষের কাছে যাইতেও ইচ্ছা করে না। তাই আয়ও কইম্যা গেছে।’
জন্ম থেকেই এই দুই ভাই শারীরিক প্রতিবন্ধী। শামীম ও শাহীনের বাবা তাদের রেখে পালিয়ে গেছেন। আরেক জন তাদের মাকে বিয়ে করেন। সেই বাবা শামীম ও শাহীনের আয় দিয়ে বসে বসে খেতেন। তিনিও শামীমের জমানো এক হাজার টাকা ও একটি মুঠোফোন নিয়ে পালিয়ে গেছেন। এখন এই দুই ভাইয়ের ভরসা তাদের বৃদ্ধ নানি ও মামা-মামি। ঢাকা উদ্যানের এক বস্তিতে নানি ও মামা-মামির সংসারে দুই ভাইয়ের ঠাঁই হয়েছে। এক হাজার টাকা ঘর ভাড়ার মধ্যে দুই ভাইকে দিতে হয় ৫০০ টাকা।
শামীম বলে, ‘আমি মানুষের কাছে চাইতে পারি। নড়াচড়াও করতে পারি। কিন্তু ভাইটারে নিয়া চিন্তা। ও কারও কাছে কিছু চায় না। কেউ কিছু দিলে নেয়। নড়তেও পারে না। মা মরার পর থেইক্যা খালি মন খারাপ কইরা বইয়া থাহে। বুড়া নানিরও শরীরডা ভালা না।’
মা মারা যাওয়ায় ১৪ বছরের এই বালকের কাছে পৃথিবীটাকে অনেক কঠিন মনে হচ্ছে। কেননা, শারীরিক অক্ষমতার জন্য একমাত্র মা-ই কখনো বিরক্ত হননি, বকাঝকা করেননি। শামীমের নিজের শরীরও আর চলছে না। বিকেল হলেই গায়ে জ্বর আসে। আগে মা ভাত রান্না করে খাওয়াতেন, শুক্রবার মাংস খাওয়ারও সুযোগ মিলত। মামি আদর করলেও সকালে ভাতের বদলে পানি দেওয়া ভাত খেতে দেন। ভালো খাবারও তেমন একটা জোটে না। মামা ও মামি কাগজ কুড়িয়ে যা পান, তাতে সংসার চলে না।
ভিক্ষা করার জন্য অনেকে খারাপ গালিও দেয়। তখন মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে যায় শামীমের। শরীর ও মন ভালো থাকলে সে দিনে ৩০০ টাকার মতো পায়। ঢাকা উদ্যানের বস্তি থেকে রবীন্দ্রসরোবর পর্যন্ত রিকশায় দুই ভাইয়ের প্রতিদিন যাতায়াত খরচ ১০০ টাকা। দিনের খাবার ও অন্যান্য খরচ শেষে আর কিছু থাকে না। নিউমার্কেট এলাকায় আয় বেশি, কিন্তু পরিশ্রমও বেশি করতে হয়। তাই রবীন্দ্রসরোবরই আপাতত তার ঠিকানা।
শামীম বলে, ‘মা খালি চিন্তা করত, আর কানত। মা কইত, “আমাগোর কাছে টাকা না থাকলে কেউ দেখব না।” মায়ের ইচ্ছা আছিল, টাকা জমাইয়া দ্যাশে গিয়া একটা দোকান করব। দোকান করতে কত টাকা লাগে, তা-ও তো জানি না। তয় ভবিষ্যৎ করা লাগব। তাই চিন্তা করছি, একটা দোকান দিমু।’
গাইবান্ধা থেকে আসা এই দুই ভাইয়ের কিছু টাকা জমেছিল। কিন্তু হুট করে মা মারা যাওয়ায় সেই টাকাও শেষ হয়ে গেছে। রবীন্দ্রসরোবরেই সাইকেলে করে এক ব্যক্তি আচার বিক্রি করেন। শামীমের যখন শরীরটা আর চলতে চায় না, হাত দুটি অবশ অবশ লাগে, তখন সে সাইকেলের পেছনটা ধরে বসে থাকে। আচার বিক্রেতার সাইকেল চলতে থাকলে শামীমও চলে। এতেই তার মহা-আনন্দ। কিন্তু শামীম ও শাহীনকে বেঁচে থাকতে হলে চলা থামালে চলবে না। এই আচার বিক্রেতার মতো কেউ তাদের দিকে সাইকেল বাড়িয়ে না দিলেও চলতে হবে।
মানসুরা হোসাইন
১৪ বছরের শামীম কখনো দাঁড়াতে পারে না। বেঁকে যাওয়া দুই পা শুধু একটু লম্বা করতে পারে। বেঁকে যাওয়া দুই হাত দিয়েও তেমন কিছু করতে পারে না। বাথরুমে যেতে হয় অন্যের সাহায্য নিয়ে। তবে শামীম তার উপযোগী করে তৈরি যানে বসে, দুই হাতকে বৈঠার মতো ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করতে পারে। কিন্তু তার বড় ভাই শাহীনের বেঁকে যাওয়া ছোট ছোট হাত-পা নিয়ে নাড়াচাড়ার ক্ষমতা নেই। সে বসে থাকে রবীন্দ্রসরোবরের ফটকের বাইরে একটি গাছের নিচে।
শামীম বলে, ‘মায়ের নাক, মুখ দিয়া আগেও রক্ত পড়ত। হেই দিনও সকালে রক্ত পড়ে। তার পরও মা গরম ভাত রাইনদ্যা দুই ভাইরে খাওয়ায়। কয়, সন্ধ্যায় ওষুধ খাইলে ভালা হইয়া যাইব। আমিও মনে মনে ভাবি, সন্ধ্যায় মায়ের লাইগ্যা ওষুধ নিয়া বাড়ি ফিরমু। কামে চইল্যা আওয়ার পর শুনি, মা মইরা গেছে।’
শামীম বলতেই থাকে, ‘কামে আইলে মা একটু পর পর আইত, চুমু খাইত। হেই রকম আদর আর কেউ করে না। দোয়া করত। আয়ও ভালা হইত। মা নাই, কেউ দোয়া করে না। মন খারাপের লাইগ্যা আগের মতো মানুষের কাছে যাইতেও ইচ্ছা করে না। তাই আয়ও কইম্যা গেছে।’
জন্ম থেকেই এই দুই ভাই শারীরিক প্রতিবন্ধী। শামীম ও শাহীনের বাবা তাদের রেখে পালিয়ে গেছেন। আরেক জন তাদের মাকে বিয়ে করেন। সেই বাবা শামীম ও শাহীনের আয় দিয়ে বসে বসে খেতেন। তিনিও শামীমের জমানো এক হাজার টাকা ও একটি মুঠোফোন নিয়ে পালিয়ে গেছেন। এখন এই দুই ভাইয়ের ভরসা তাদের বৃদ্ধ নানি ও মামা-মামি। ঢাকা উদ্যানের এক বস্তিতে নানি ও মামা-মামির সংসারে দুই ভাইয়ের ঠাঁই হয়েছে। এক হাজার টাকা ঘর ভাড়ার মধ্যে দুই ভাইকে দিতে হয় ৫০০ টাকা।
শামীম বলে, ‘আমি মানুষের কাছে চাইতে পারি। নড়াচড়াও করতে পারি। কিন্তু ভাইটারে নিয়া চিন্তা। ও কারও কাছে কিছু চায় না। কেউ কিছু দিলে নেয়। নড়তেও পারে না। মা মরার পর থেইক্যা খালি মন খারাপ কইরা বইয়া থাহে। বুড়া নানিরও শরীরডা ভালা না।’
মা মারা যাওয়ায় ১৪ বছরের এই বালকের কাছে পৃথিবীটাকে অনেক কঠিন মনে হচ্ছে। কেননা, শারীরিক অক্ষমতার জন্য একমাত্র মা-ই কখনো বিরক্ত হননি, বকাঝকা করেননি। শামীমের নিজের শরীরও আর চলছে না। বিকেল হলেই গায়ে জ্বর আসে। আগে মা ভাত রান্না করে খাওয়াতেন, শুক্রবার মাংস খাওয়ারও সুযোগ মিলত। মামি আদর করলেও সকালে ভাতের বদলে পানি দেওয়া ভাত খেতে দেন। ভালো খাবারও তেমন একটা জোটে না। মামা ও মামি কাগজ কুড়িয়ে যা পান, তাতে সংসার চলে না।
ভিক্ষা করার জন্য অনেকে খারাপ গালিও দেয়। তখন মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে যায় শামীমের। শরীর ও মন ভালো থাকলে সে দিনে ৩০০ টাকার মতো পায়। ঢাকা উদ্যানের বস্তি থেকে রবীন্দ্রসরোবর পর্যন্ত রিকশায় দুই ভাইয়ের প্রতিদিন যাতায়াত খরচ ১০০ টাকা। দিনের খাবার ও অন্যান্য খরচ শেষে আর কিছু থাকে না। নিউমার্কেট এলাকায় আয় বেশি, কিন্তু পরিশ্রমও বেশি করতে হয়। তাই রবীন্দ্রসরোবরই আপাতত তার ঠিকানা।
শামীম বলে, ‘মা খালি চিন্তা করত, আর কানত। মা কইত, “আমাগোর কাছে টাকা না থাকলে কেউ দেখব না।” মায়ের ইচ্ছা আছিল, টাকা জমাইয়া দ্যাশে গিয়া একটা দোকান করব। দোকান করতে কত টাকা লাগে, তা-ও তো জানি না। তয় ভবিষ্যৎ করা লাগব। তাই চিন্তা করছি, একটা দোকান দিমু।’
গাইবান্ধা থেকে আসা এই দুই ভাইয়ের কিছু টাকা জমেছিল। কিন্তু হুট করে মা মারা যাওয়ায় সেই টাকাও শেষ হয়ে গেছে। রবীন্দ্রসরোবরেই সাইকেলে করে এক ব্যক্তি আচার বিক্রি করেন। শামীমের যখন শরীরটা আর চলতে চায় না, হাত দুটি অবশ অবশ লাগে, তখন সে সাইকেলের পেছনটা ধরে বসে থাকে। আচার বিক্রেতার সাইকেল চলতে থাকলে শামীমও চলে। এতেই তার মহা-আনন্দ। কিন্তু শামীম ও শাহীনকে বেঁচে থাকতে হলে চলা থামালে চলবে না। এই আচার বিক্রেতার মতো কেউ তাদের দিকে সাইকেল বাড়িয়ে না দিলেও চলতে হবে।
মানসুরা হোসাইন
No comments