ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ by ড. এ কে এম ইয়াকুব হোসাইন
ফিলিস্তিন সমস্যা দীর্ঘদিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা। এর সূচনা হয়েছিল পবিত্র জেরুজালেমের ওপর ইসরায়েল নামের ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ফিলিস্তিন সমস্যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা নিয়ে বিশ্বের দুই পরাশক্তি বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে এ সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চললেও তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পড়ে বৃহৎ শক্তিবর্গের কৌশলগত বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে আজ পর্যন্ত অনেক রক্তস্রোত বয়ে গেলেও সমস্যার
কোনো সমাধান হয়নি। ফলে ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণ করুণ পরিণতির সম্মুখীন হয়। আগ্রাসন ও পশ্চিমা অস্ত্রের বলে জন্ম নেওয়া ইসরায়েল ছয় দশক ধরে ফিলিস্তিনসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে। তারা শুধু ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে অস্বাভাবিক উপায়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করেই ক্ষান্ত হয়নি। ৬৩ বছর ধরে আরবদের নিজেদের জমি থেকে বিতাড়িত করে দখলদারিত্ব বৃদ্ধি ও পাকাপোক্ত করার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর থেকেই বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আরবরা গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর ও পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোতে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এ ছাড়া হাজার হাজার বাস্তুহারা ফিলিস্তিনি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে তারা এক দিনের জন্যও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি পরিত্যাগ করেনি। ১৯৪৮ সালের মহাবিপর্যয়ের পর থেকে ফিলিস্তিনিরা আরব বিশ্ব ও বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের সমর্থন নিয়ে নিজেদের পিতৃভূমিতে ফেরত যাওয়ার অধিকার তথা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সপক্ষে রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ইঙ্গ-মার্কিন সহযোগিতায় ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই তা একটি সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী আবারও বিশাল আরব ভূমি দখল করে নেয়, যা অদ্যাবধি তাদের দখলে রয়েছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা : নভেম্বর ১৯৪৭ : ইহুদি ও আরবদের জন্য ফিলিস্তিন বিভক্ত করতে রাজি হয় জাতিসংঘ। জুন ১৯৬৭ : ছয় দিনের যুদ্ধের পর পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। নভেম্বর ১৯৭৪ : পর্যবেক্ষকের মর্যাদা পায় পিএলও। সেপ্টেম্বর ১৯৮২ : ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান আরব লিগের এবং ইসরায়েলকে মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত। নভেম্বর ১৯৮৮ : ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্ত অনুযায়ী ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা পিএলও নেতৃত্বের। মার্চ ২০০২ : ইসরায়েল রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে প্রথম প্রস্তাব পাস। মার্চ ২০১১ : প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা বলেন, ১৯৬৭ সালের সীমান্তরেখাই হবে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনার ভিত্তি। সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১১ : পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পাওয়ার জন্য জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের আবেদন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়ার অচলাবস্থা নিরসনে নতুন উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'আমরা অনেক দিন ধরেই বলছি, ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়া উচিত। পাশাপাশি আরব-ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথাও বলে আসছি। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ : রামাল্লায় বিক্ষোভকারীরা আমেরিকাকে 'সাপের মাথা' হিসেবে আখ্যায়িত করে স্লোগান দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেওয়ার ঘটনাকে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতমূলক আচরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন রাজনীতিক, বিশ্লেষক ও সাধারণ ফিলিস্তিনিরা। তাঁরা বলেছেন, এ ঘটনা প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র সংকট নিরসনে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে অক্ষম। গাঁজায় হামাস নেতারা বলেছেন, ওবামার বক্তব্যের পর এখন থেকে ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্বকে ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করে থাকা বন্ধ করা উচিত। মুখপাত্র সামি আবু জুহরি বলেন, 'ওবামার বক্তব্য ইসরায়েলি দখলদারির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রতিফলন। এতে এটা প্রমাণ হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আরব ও ফিলিস্তিনের আস্থা রাখা ভুল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের পর আমরা স্বনির্ভর এবং আরব ও মুসলিম বিশ্বের সমন্বয়ে একটি জতীয় কৌশল গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।' ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে পাস হতে পরিষদের ১২৮টি সদস্য দেশের সমর্থন প্রয়োজন। সাধারণ পরিষদের মোট ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১২২টি দেশ ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফিলিস্তিনি নেতারা আশা করছেন, চলতি প্রচারণার ফলে এখন আরো ছয়টি দেশের সমর্থন তাঁরা পেয়ে যাবেন। সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবটি পাস হলে এবং মহাসচিব বান কি মুন অনুমোদন করলে সেটি নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো হবে। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ৯ সদস্যের সমর্থন এবং কোনো স্থায়ী সদস্যের পক্ষ থেকে ভেটো না দেওয়া হলে আবেদনটি পাস হবে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া ফিলিস্তিনকে এরই মধ্যে স্বীকৃতি দিলেও ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। আর পরিষদের বর্তমান অস্থায়ী সদস্য বসনিয়া, ব্রাজিল, গ্যাবন, নাইজেরিয়া, লেবানন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে অস্থায়ী সদস্য কলম্বিয়া, জার্মানি ও পর্তুগাল এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদের আবেদন পেশ করে দেশে ফিরে মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের বসতি নির্মাণ সম্পূর্ণ বন্ধ না হলে তিনি কোনো শান্তি আলোচনায় বসবেন না। এটা প্রমাণিত হয়েছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধ সাময়িকভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়_সমাধান খুঁজতে হবে আলোচনার টেবিলেই। সুতরাং এটা এখন মুসলিম বিশ্ব বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য উচিত হবে, কোয়ার্টেটের ওপর অব্যাহত চাপ রাখা, যাতে তাদের প্রস্তাব অনুসারে শান্তিপ্রক্রিয়া অগ্রসর হয়। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর দায়িত্ব কম নয়, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কখনো ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হতে পারেনি। পক্ষান্তরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আক্রমণের পথ সুগম করে দিয়েছে_কখনো কোনো মুসলিম দেশকে আক্রমণের দাওয়াত দিয়ে, কখনো তাকে আক্রমণে সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে। মুসলিম বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের সব কয়টি বড় ও শক্তিশালী দেশ যেমন তুরস্ক, মিসর ও সৌদি আরব_সবাই যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিশুদ্ধ বন্ধু। তারা সবাই ইরাক ও লিবিয়ায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণকে সমর্থন করেছে। আরব লিগ নামের আরব মুসলিম দেশগুলোর যে সংস্থা তা আরব জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুসারে কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারেনি। 'আরব বসন্ত' বলে আরব বিশ্বে যে গণতান্ত্রিক জোয়ার এসেছে, তাতে নতুন ভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ ঘটেছে, যা ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে উৎসাহিত করবে। এই গণতান্ত্রিক জোয়ারে যদি অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাগুলো ভেসে যায়, তাহলে আরব বিশ্ব দেহে নতুন প্রাণের সন্ধান পাবে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত হবে।
লেখক : অধ্যক্ষ সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, বকশীবাজার, ঢাকা
No comments