গাদ্দাফির মৃত্যু ও ‘মুক্ত’ লিবিয়া by হারুন-অর-রশীদ

রব জাতীয়তাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত সেই গাদ্দাফি আজ নেই। তাঁর মৃত্যুর পর রাজপথে লিবীয়দের উল্লাস করতে দেখেছে বিশ্ববাসী । গাদ্দাফির মৃত্যুর খবর শুনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লাস প্রকাশ করে বলেছেন, ‘ওয়াও’। মুক্ত লিবিয়ার পথ চলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ঢাকঢোল পিটিয়ে। তবে নাটকের আসল দৃশ্যই দেখার বাকি রয়ে গেছে। ১৯১১ সালে ইতালির দখলাধীন হয় লিবিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে ইতালিসহ অক্ষশক্তির শোচনীয় পরাজয়ের পর ১৯৫১


সালে লিগ অব নেশনসের ম্যান্ডেটের আওতায় দেশটির শাসনভার সাময়িকভাবে চলে যায় বিজয়ী মিত্রশক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ওপর। একই সালে বাদশাহ ইদ্রিসের নেতৃত্বে লিবিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণায় জাতিসংঘের একটি পরিকল্পনা নিশ্চিত হয়ে যায়।
তার পরও সে সময় রহস্যজনকভাবে দেশের তেলসম্পদের ওপর ব্রিটেন ও ফ্রান্স, পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য মেনে নিয়েছিলেন বাদশাহ ইদ্রিস। এ ছাড়া দেশে পশ্চিমাদের ঘাঁটি গেড়ে বসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনিই। ইতিহাস সাক্ষী—আরব বিশ্বের প্রায় বিকশিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পথভ্রষ্ট করার নানা নীলনকশা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছিল এই ঘাঁটিগুলো। তবে পশ্চিমাদের এই আধিপত্যে বাদ সাধলেন আরব জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত এক তরুণ সেনা কর্মকর্তা। তিনি মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তিনি কর্নেল গাদ্দাফি নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
১৯৬৯ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সী এই যুবক রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করলেন পশ্চিমাদের তাঁবেদার বাদশাহ ইদ্রিসকে। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে লিবিয়াকে শাসন করে গেছেন তিনি। বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত লিবিয়াকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখতে এর বিকল্প হয়তো ছিল না গাদ্দাফির হাতে। কিন্তু এ ধরনের শাসন মানেই দমন-নিপীড়ন। জনগণের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা আর ভিন্ন মত ও পথের লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া। তিউনিসিয়া থেকে আরব বিশ্বের স্বৈরশাসকদের জাঁতাকলে পিষ্ট জনগণের যে ‘আরব বসন্ত’ জন্ম নিল, তার ঢেউ আছড়ে পড়ল দেশে দেশে; এমনকি লিবিয়াতেও। অথচ লিবিয়ার দৃশ্যপট আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। শাসনকাজে গাদ্দাফি একনায়ক, অগণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ব্যাপারে নির্মম হলেও জনগণের কল্যাণে অনেক কর্মসূচি নিয়েছেন। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে তিনি কাজ করে গেছেন তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে। কিন্তু রাজনৈতিক অধিকার হারা জনগণ আরব বসন্তের বাতাস পেয়ে নেমে পড়ল গাদ্দফি পতনের আন্দোলনে। পশ্চিমারা এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি।
৪২ বছর ধরে লিবিয়া শাসন করে আসা গাদ্দাফি গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হলে দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি যোদ্ধা। দেশের জন্য লড়তে লড়তে যুদ্ধক্ষেত্রে মরতে চাই।’ আর ২০ অক্টোবর বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হওয়ার আগে গাদ্দাফির শেষ কথা ছিল, ‘তোমরা যা করছ, তা ভুল। তোমরা কি জানো না, কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল?’
গাদ্দাফির পতন ও তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশটি ও এর জনগণ ‘মুক্ত’ হয়েছে ঠিকই কিন্তু লিবিয়ার সামনে কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত লিবিয়াকে অখণ্ড রেখে গণতন্ত্রের পথে দেশটি কতটুকু এগোতে পারবে, সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক পর্যবেক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.