সরকার বনাম ইউনূস by রাহীদ এজাজ
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে দিতে যেন পণ করেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এ বছরের প্রথমার্ধে এসেই সরকার তার উদ্দেশ্যটি পুরোপুরি চরিতার্থ করে। যে প্রক্রিয়ায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদকে তাঁরই হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠলেও সরকারের দাবি, কাজটি হয়েছে আইন মেনেই। ‘দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ড. ইউনূস গরিবের রক্ত শুষে নিচ্ছেন’—এ ধরনের প্রচারণার
পাশাপাশি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল বিভিন্ন মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ থাকেন। সরকারের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তো বলেই বসেন, ৭০ বছর বয়সী ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে উপযুক্ত নন। তাই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরে যেতে অব্যাহতভাবে আহ্বান জানান অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ড. ইউনূস খুব স্পষ্ট করেই গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ৮৩-এর উল্লেখ করে বলেন, ১৩ সদস্যবিশিষ্ট গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই কাউকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে নিয়োগ ও বরখাস্তের ক্ষমতা রাখে।
ড. ইউনূসের ওপর চাপ বাড়ানোর অংশ হিসেবে এ বছরের জানুয়ারিতে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয় মোজাম্মেল হককে। ড. ইউনূসের ঘোরতর সমালোচক হিসেবে চিহ্নিত মোজাম্মেল হক অতীতে গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। দুই মাস পর অর্থাৎ মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক এক চিঠিতে জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছেন ড. ইউনূস, যা গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ৮৩-এর পুরোপুরি লঙ্ঘন। এ বিষয়ে চিঠিতে বেশি বয়সের প্রসঙ্গটি তোলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনি লড়াই শুরু করেন ড. ইউনূস। সঙ্গে ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের নয়জন পরিচালক। কিন্তু আদালত শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে রায় দেন। ২০১১ সালের ১২ মে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান এর প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস।
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি দেশ-বিদেশে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকারের মনোভাব থেকে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক সমস্যার চেয়ে জরুরি তাঁকে প্রতিষ্ঠানটি থেকে সরিয়ে দেওয়া। অথচ যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সব সময় বিষয়টির একটি সম্মানজনক সমাধানের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিল। এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে একই অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সব অনুরোধই সরকার অগ্রাহ্য করেছে। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদের ভাবমূর্তি, তাঁকে ঘিরে নতুনভাবে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের পরিচিতি, কিংবা বহির্বিশ্বে তাঁর প্রভাব—সবকিছুকেই সরকার পাশ কাটিয়ে গেছে। ‘ড. ইউনূসকে সরাতেই হবে’ এই মন্ত্রে অটল থেকেছে সরকার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতেও হিলারি বলেছেন, ড. ইউনূসের বিষয়টি তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) জন্য উদ্বেগের। ঢাকা সফরে এসে ড. ইউনূসের ব্যাপারে একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জার্মান প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান ভুল্ফও। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয়টি সরকার অগ্রাহ্য করেই চলেছে।
No comments