বর্ষশেষ সংখ্যা-২০১১: জমার চেয়ে খরচ যখন বেশি by আনিসুল হক
২০১১ হতে পারত আমাদের সবচেয়ে ভালো বছর। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরই বিডিআর বিপর্যয়, সেটা সামলাতেই প্রথম বছর কেটে গেছে, দ্বিতীয় বছরটায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে তৃতীয় বছরটায় আমরা উন্নয়নের পথে উড়াল দিতে পারব—এক বছর আগে এই ছিল আশা। বছর শেষে হিসাবের খেরোখাতায় দেখা যাচ্ছে, যোগের চেয়ে বিয়োগ হয়েছে বেশি, জমার চেয়ে খরচের খাতটা বড়। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এর প্রতিষ্ঠাতা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ
ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, আদালত সেই সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন, কিন্তু দেশে-বিদেশে এই পদক্ষেপ সাধুবাদ পায়নি। শেয়ারবাজারে দরপতন অব্যাহত ছিল, এবং খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ তদন্ত কমিটির সুপারিশকে খুব একটা আমলে নেওয়া হয়নি। মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে, অনশন করেছে, কিন্তু তাতে তাদের দুঃখকষ্ট ক্ষতি কমেনি। বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে, র্যাব কর্তৃক লিমনের পায়ে গুলি করার খবরে হইচই পড়ে গেছে, কিন্তু তা বিচারের বাণীকে নীরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই তড়িঘড়ি এই বিল পাসের উদ্দেশ্য অনেকের কাছেই সাধু বলে মনে হয়নি। বিরোধী দল রাস্তায় নেমে পড়েছে। জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়ে গেছে।
মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন স্কুলছাত্র মৃত্যুবরণ করেছে, সেই শোকের অশ্রু শুকানোর আগেই এসেছে আরেক আঘাত, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ আর সাংবাদিক মিশুক মুনীর।
ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির বিল পাস হয়ে গেছে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই। এত সব নেতিবাচক খবরের মধ্যে ইতিবাচক খবর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল বাতিল করা হয়েছে আদালতের রায়ে, এরশাদের সামরিক শাসন ঘোষিত হয়েছে অবৈধ বলে। আর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মানুষ দাঁড়িয়েছে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে, দলীয় সমর্থন না পাওয়া সত্ত্বেও জনতা জয়ের মালা পরিয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভীর গলায়।
বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন করা গেছে সুন্দরভাবে এবং মেসির আর্জেন্টিনার আগমন ঘটেছে বাংলাদেশে।
ভালোর চেয়ে কালো বেশি, আর আশ্চর্য যে, এগুলোর একটাও প্রাকৃতিক নয়, সবই মনুষ্যসৃষ্ট। অর্থাৎ আমাদের নেতৃত্ব যদি চাইতেন, এগুলো পরিহার করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হতো। রাজনীতিতে বিরোধীপক্ষকে এক হাত দেখিয়ে নেওয়ার বা দলীয়করণের মোহ যদি ত্যাগ করা যায়, বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া খুবই সম্ভব।
পৃথিবীজুড়ে ২০১১ ছিল ঘটনাবহুল। প্রধান ঘটনা নিশ্চয়ই আরব বসন্তের হাওয়া। তার কতটা দক্ষিণা, আর কতটা পশ্চিমা—এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই তোলা যাবে। জাপানে ভূমিকম্প ও সুনামির ব্যাপকতা বলছে, আমরা এখনো কতটাই অসহায়। লাদেনের মৃত্যু, গাদ্দাফি হত্যাকাণ্ডে পশ্চিমারা প্রকাশ্যে স্বস্তি প্রকাশ করেছে, কিন্তু বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত হতে প্রাচ্যের মন সায় দেয় কি? উইলিয়াম ও কেটের বিয়ে নিয়ে পৃথিবীব্যাপী আগ্রহ দেখা দিয়েছিল, মনে পড়ে পুরোনো কৌতুক, বাঘের বিয়েতে বিড়াল লাফাচ্ছে—‘আরে বিড়াল, তুই লাফাস কেন’, বিড়াল বলে, ‘ও তো আমারই ভাই, বিয়ের আগে তো আমিও বাঘই ছিলাম, বিয়ের পরেই না বিড়াল হয়ে গেলাম।’
জাতিসংঘে স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি উঠেছে, আমেরিকা যথারীতি বিরোধিতা করেছে, ইউনেসকোয় ফিলিস্তিনি পতাকা উড্ডয়নের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র তার চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। স্টিভ জবসের মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে দেশে দেশে। পশ্চিমবঙ্গে পতন ঘটেছে লাল দুর্গের, মিয়ানমারে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে, অং সান সু চি মুক্ত আকাশের নিচে সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন, আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক লেনদেন শুরু হয়েছে মিয়ানমারের।
সবচেয়ে বেশি আশাবাদ তৈরি করেছে হয়তো ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলন। পৃথিবীব্যাপী বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষ সজাগ ও সোচ্চার হতে শুরু করেছে, ওতেই ঊষার আগমনবার্তা দেখছেন কেউ কেউ।
অতীতের চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ। এটা ধর্মের বাণী। আমরা এই আশাতেই আছি। ২০১১ ভালো যায়নি, নিশ্চয়ই ২০১২ ভালো যাবে। সুখে-দুঃখেই আমাদের জীবন। তবু শেষতক দুঃখের চেয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দের ভাগ নিশ্চয়ই বেশি। কবি টি এস এলিয়ট বলেছিলেন, ‘অতীত এবং বর্তমান দুই-ই নিহিত আছে ভবিষ্যতের মধ্যে, আর ভবিষ্যৎ রয়ে গেছে অতীতের মধ্যে।’ তবু আমরা আশা করি, আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো হোক। ২০১২ আমাদের জীবনে বয়ে আনুক হাসি-আনন্দ-সাফল্য—ব্যক্তিগত সাফল্য, জাতীয় সাফল্য, মানবতার সাফল্য। ‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষকে নিয়ে যাবে মানুষ’—নাজিম হিকমতের এ আশাবাদ সফল হোক। সবাইকে শুভ নববর্ষ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই তড়িঘড়ি এই বিল পাসের উদ্দেশ্য অনেকের কাছেই সাধু বলে মনে হয়নি। বিরোধী দল রাস্তায় নেমে পড়েছে। জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়ে গেছে।
মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন স্কুলছাত্র মৃত্যুবরণ করেছে, সেই শোকের অশ্রু শুকানোর আগেই এসেছে আরেক আঘাত, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ আর সাংবাদিক মিশুক মুনীর।
ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির বিল পাস হয়ে গেছে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই। এত সব নেতিবাচক খবরের মধ্যে ইতিবাচক খবর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল বাতিল করা হয়েছে আদালতের রায়ে, এরশাদের সামরিক শাসন ঘোষিত হয়েছে অবৈধ বলে। আর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মানুষ দাঁড়িয়েছে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে, দলীয় সমর্থন না পাওয়া সত্ত্বেও জনতা জয়ের মালা পরিয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভীর গলায়।
বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন করা গেছে সুন্দরভাবে এবং মেসির আর্জেন্টিনার আগমন ঘটেছে বাংলাদেশে।
ভালোর চেয়ে কালো বেশি, আর আশ্চর্য যে, এগুলোর একটাও প্রাকৃতিক নয়, সবই মনুষ্যসৃষ্ট। অর্থাৎ আমাদের নেতৃত্ব যদি চাইতেন, এগুলো পরিহার করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হতো। রাজনীতিতে বিরোধীপক্ষকে এক হাত দেখিয়ে নেওয়ার বা দলীয়করণের মোহ যদি ত্যাগ করা যায়, বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া খুবই সম্ভব।
পৃথিবীজুড়ে ২০১১ ছিল ঘটনাবহুল। প্রধান ঘটনা নিশ্চয়ই আরব বসন্তের হাওয়া। তার কতটা দক্ষিণা, আর কতটা পশ্চিমা—এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই তোলা যাবে। জাপানে ভূমিকম্প ও সুনামির ব্যাপকতা বলছে, আমরা এখনো কতটাই অসহায়। লাদেনের মৃত্যু, গাদ্দাফি হত্যাকাণ্ডে পশ্চিমারা প্রকাশ্যে স্বস্তি প্রকাশ করেছে, কিন্তু বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত হতে প্রাচ্যের মন সায় দেয় কি? উইলিয়াম ও কেটের বিয়ে নিয়ে পৃথিবীব্যাপী আগ্রহ দেখা দিয়েছিল, মনে পড়ে পুরোনো কৌতুক, বাঘের বিয়েতে বিড়াল লাফাচ্ছে—‘আরে বিড়াল, তুই লাফাস কেন’, বিড়াল বলে, ‘ও তো আমারই ভাই, বিয়ের আগে তো আমিও বাঘই ছিলাম, বিয়ের পরেই না বিড়াল হয়ে গেলাম।’
জাতিসংঘে স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি উঠেছে, আমেরিকা যথারীতি বিরোধিতা করেছে, ইউনেসকোয় ফিলিস্তিনি পতাকা উড্ডয়নের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র তার চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। স্টিভ জবসের মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে দেশে দেশে। পশ্চিমবঙ্গে পতন ঘটেছে লাল দুর্গের, মিয়ানমারে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে, অং সান সু চি মুক্ত আকাশের নিচে সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন, আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক লেনদেন শুরু হয়েছে মিয়ানমারের।
সবচেয়ে বেশি আশাবাদ তৈরি করেছে হয়তো ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলন। পৃথিবীব্যাপী বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষ সজাগ ও সোচ্চার হতে শুরু করেছে, ওতেই ঊষার আগমনবার্তা দেখছেন কেউ কেউ।
অতীতের চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ। এটা ধর্মের বাণী। আমরা এই আশাতেই আছি। ২০১১ ভালো যায়নি, নিশ্চয়ই ২০১২ ভালো যাবে। সুখে-দুঃখেই আমাদের জীবন। তবু শেষতক দুঃখের চেয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দের ভাগ নিশ্চয়ই বেশি। কবি টি এস এলিয়ট বলেছিলেন, ‘অতীত এবং বর্তমান দুই-ই নিহিত আছে ভবিষ্যতের মধ্যে, আর ভবিষ্যৎ রয়ে গেছে অতীতের মধ্যে।’ তবু আমরা আশা করি, আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো হোক। ২০১২ আমাদের জীবনে বয়ে আনুক হাসি-আনন্দ-সাফল্য—ব্যক্তিগত সাফল্য, জাতীয় সাফল্য, মানবতার সাফল্য। ‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষকে নিয়ে যাবে মানুষ’—নাজিম হিকমতের এ আশাবাদ সফল হোক। সবাইকে শুভ নববর্ষ।
No comments