পরিহাসের সপ্তম সংশোধনী by মিজানুর রহমান খান

তিত ফৌজি শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সেফটি বাল্ব বা নিরাপত্তা-কপাটিকা। তাঁকে ঘিরে ২০১১ সালে অন্তত দুটো মজার ঘটনা ঘটেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বললেন তাঁর বিচার করতে। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের সায় যেন বিচারের পক্ষে নেই। তবে সেনাশাসনবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রশংসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের ঠিকই রয়েছে। জনগণের কাছ থেকে


গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে বাহবা নেওয়ার সুযোগ তারা হারাতে চায় না। আবার পতিত স্বৈরশাসকের প্রতি তাদের টান না কমিয়ে বরং তা বাড়াতেই তারা যেন আগ্রহী ছিল। আমরা দেখছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর এরশাদ এখন আওয়ামী লীগের আরও ওজনদার মিত্রে পরিণত হয়েছেন। কারণ, দরকার পড়লে বিএনপিবিহীন কোনো সাধারণ নির্বাচনে তাঁকে সহজেই কাজে লাগানো যেতে পারে।
গত বছরের আগস্টে সপ্তম সংশোধনী হাইকোর্টে প্রথমবারের মতো অবৈধ ঘোষিত হয়। এই সংশোধনী পাস হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ নতুন করে আমাদের স্মরণ করা দরকার। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বন্দুকের নল ঠেকিয়ে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেন এরশাদ। এরপর ১৯৮৬ সালে এরশাদের সেনাশাসনের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বৈধতার প্রয়োজন দেখা দেয়। তথাকথিত গণতান্ত্রিক উত্তরণের দোহাই দিয়ে নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এরশাদ। এরশাদের অধীনে যে নির্বাচনে যাবে সে হবে জাতীয় বেইমান—এমনটিই ছিল তখন আওয়ামী লীগের অবস্থান। পরে অবশ্য হঠাৎ নাটকীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। বিতর্কিত সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল সপ্তম সংশোধনী।
১৯৮৬ থেকে ২০১১ সালের মাঝখানে কেটে গেছে সিকি শতাব্দী। নব্বইয়ে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতার বলয় থেকে একেবারেই কক্ষচ্যুত হননি; বরং তিনি হয়ে উঠেছেন এক কিং মেকার। সে কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয়।
গত মে মাসে আপিল বিভাগ সপ্তম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। তখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বর্তমানে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে সংসদ জেনারেল এরশাদের শাস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আওয়ামী লীগ সে কাজ করতে পারে না, তা জানাই ছিল। সেনাছাউনিতে জন্ম নেওয়া বিএনপিরও এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এরপর গত জুনে আমরা পেলাম পঞ্চদশ সংশোধনী। সেখানে ভবিষ্যতের এরশাদ ধরনের ব্যক্তিদের অ্যাডভেঞ্চার ঠেকাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হলো। এই শাস্তির বিধান যে অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক, তা ধারণা করা কঠিন নয়। কোন আদালতে কীভাবে কী শাস্তি হবে, তা পরিষ্কার নয়।
তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, অনাগত দিনে কোনো সংবিধানবহির্ভূত শক্তির কোনো ছলছুতায় ক্ষমতা জবরদখল নিরুৎসাহিত হবে। কারণ, একটা সাংবিধানিক বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এরশাদের সামরিক শাসন অবৈধ ঘোষণা করে সপ্তম সংশোধনী বাতিল, আর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা দখল নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা ২০১১ সালের দুটি বড় অর্জন। তবে একই সঙ্গে পতিত স্বৈরাচারীর সঙ্গে সরকারি ও বিরোধী দলের সহাবস্থান আমাদের দেশের এক বড় রাজনৈতিক পরিহাস।

No comments

Powered by Blogger.