সময়ের কথা-শকুনের দোয়ায় গরু মরে না by অজয় দাশগুপ্ত

চার দশক পর আমরা অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্লেষণ করব এবং এগিয়ে যাওয়ার পথ অবশ্যই চিহ্নিত করব। এ পথে চলতে ধনবান শ্রেণীর উদ্যোগ-উদ্ভাবন-বিনিয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন পড়বে। তাদের মধ্যে অনেক সৃজনশীল উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা দেশকে আরও সমৃদ্ধ করায় বড় ভূমিকা নিতে পারেন। একই সঙ্গে চাই আমজনতার অংশগ্রহণ_ যেমনটি ঘটেছিল একাত্তরে। যে জাতি একাত্তরে জয়ী হয়েছে, তার অর্থনীতি সবল করার সংগ্রামেও পরাজয় নেই


রেহমান সোবহান ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় জাদুঘরে পড়ছিলেন 'ফিরে দেখা ও সামনে চলা' ভাষণ। ষাটের দশকে তিনি 'দুই অর্থনীতি' তত্ত্ব উপস্থাপন করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তার এবং আরও কয়েকজন বাঙালি অধ্যাপকের ভাষ্য ছিল_ পাকিস্তানের দুই অংশে দুই অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। শাসকরা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু লোক। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছে এবং এখানকার বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা_ সবকিছুতেই বাঙালিদের বঞ্চনা। এমনকি তারা গণতন্ত্রের অধিকার দিতেও রাজি ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান তার এ বক্তব্যকে গ্রহণ করেছিলেন এবং তাকে রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত করেন দক্ষতার সঙ্গে। নানামুখী বঞ্চনার অবসানের জন্যই স্বাধীনতার পথে চলে বাঙালিরা। স্বাধীনতার চার দশকের অর্জন নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি দুঃখভারাক্রান্ত মনে বলেন, এখন দুই সমাজ দাঁড়িয়ে গেছে বাংলাদেশে_ ধনী ও দরিদ্র। একাত্তরে আমরা এটা চাইনি।
রেহমান সোবহান যখন তার লিখিত বক্তব্য তুলে ধরছিলেন, পাশে ছিলেন অমর্ত্য সেন_ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঢাকাইয়া অর্থনীতিবিদ। তিনি বক্তব্য রাখার সময় বলেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মধ্যে নিজস্ব স্বকীয়তা তুলে ধরার একটি মনোভাব কাজ করেছে। যেমন তিনি বলতেন, জমিদারি প্রথা বাতিল করতে হবে। এ অঞ্চলে জমিদাররা ছিল মূলত হিন্দু এবং প্রজাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। দুই পক্ষের মধ্যে স্থায়ী সমঝোতা ও সদ্ভাব স্থাপনের জন্য এর অবসান প্রয়োজন। শেরেবাংলার মধ্যে বরিশাল নিয়েও গর্ব ছিল_ বিখ্যাত ঐতিহাসিক তপন রায় চৌধুরী মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পর তাকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছিলেন_ তুমি বরিশালের মুখ উজ্জ্বল করেছ। এ প্রসঙ্গ তুলেই অমর্ত্য সেন বলেন, আমাকে যেমন মানিকগঞ্জ যেতে হয়েছে 'মানিকগঞ্জবাসীদের' এক অনুষ্ঠানে। এটাও এক ধরনের আইডেনটিটি। একাত্তরে বাঙালিরা লড়ছিল আইডেনটিটির জন্য। সে সময়ের অনেক কথা রেহমান সোবহান ও অমর্ত্য সেন জাদুঘরে বক্তব্য রাখার সময় বেশ কৌতুকচ্ছলে বলে যান। যদিও প্রসঙ্গ ছিল খুব সিরিয়াস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা ও চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য স্থানে গণহত্যা শুরুর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই রেহমান সোবহান এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আগরতলা হয়ে চলে যান দিলি্ল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে গণহত্যা বন্ধে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য অনুরোধ জানানো। এ জন্য সহায়তা নিতে হয়েছিল ছাত্র জীবনের বন্ধু অমর্ত্য সেনের। ইন্দিরা গান্ধীর দফতরে কাজ করেন এমন কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে জানাশোনা ছিল অমর্ত্য সেনের। তার আদি বাড়ি মানিকগঞ্জে। পরে বাবা বাড়ি করেন ঢাকার ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ সমর্থন। রেহমান সোবহানের ওয়াশিংটনে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয় বাংলাদেশের সমর্থনে জনমত তৈরির জন্য_ অমর্ত্য সেন দায়িত্ব নেন তাকে ভিন্ন নাম-পরিচয়ে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট করে দেওয়ার। এ ঘটনা বেশ কৌতুকের ঢংয়ে পরিবেশন করে অমর্ত্য সেন বলেন, এ কাজে জাল পাসপোর্ট চক্রের সহায়তা নিতে হয়েছিল। 'রেহমান সোবহান জীবনে কখনও জাল কিছু ব্যবহার করেননি, এ কথা বলতে পারবেন না'_ এ কথা শুনে মিলনায়তন ভর্তি শ্রোতারা হাসিতে ফেটে পড়েন।
সবার জানা একটি কৌতুক বলে আরেক প্রসঙ্গে যেতে চাই। প্রতিবেশীর ছেলে ভালো স্কুলে ভর্তি হয়েছে শুনে হিংসায় জ্বলতে থাকা লোকটি বলল, ভাগ্যে কোনোদিনও পাস জুটবে না। দেখতে দেখতে শিক্ষা শেষ হয়ে গেল। প্রতিবেশী তখন বলল, চাকরি জুটবে না। চাকরিও যখন জুটল তখন বলল, মাইনে পাবে না। মাইনেও যখন পেল, তখন মন্তব্য_ কত দূর আর এগোবে...।
বাংলাদেশকে 'বাস্কেট কেস' বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। তবে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই বছরের পর বছর প্রচার করে চলেছেন যে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে 'বটমলেস বাস্কেট' বা তলাবিহীন ঝুড়ি। বাস্কেট কেস ও বটমলেস বাস্কেটের মধ্যে কিছু পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। বটমলেস বাস্কেট বলতে বোঝানো হয়ে থাকে, দেশটিকে যত সহায়তাই দেওয়া হোক না কেন, দুর্নীতিবাজ শাসকরা সব খেয়ে ফেলবে। বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন, 'চাটার দল সব খেয়ে ফেলে' কিংবা 'সবার জন্য কম্বল এসেছে, আমারটা পেলাম না কেন'_ এসব মন্তব্যের সঙ্গে তলাবিহীন ঝুড়ি একাকার হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুুকে হত্যা করেছিল যে অপরাধী চক্র, তারাও কিসিঞ্জারের এ মন্তব্য লুফে নেয়। জিয়াউর রহমান এবং এইচএম এরশাদের শাসনামলেও কিসিঞ্জার অনেকের কাছেই আদর্শ হয়ে ওঠেন। তার কথাই চরম সত্য, আর কিছু নয়! অথচ সত্তরের দশকের শেষ দিকের মার্কিন শাসকরা পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সঙ্গে জোট বেঁধে বাংলাদেশকেই গলাটিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। রিচার্ড নিক্সন এবং তার প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জার ছিলেন এ চক্রের নেতা।
আবার একটি কৌতুক বলি_ নরক পরিদর্শনে গিয়ে এক লোক দেখতে পেল, কঠোর শাস্তি-যন্ত্রণা ভোগ করা সব দেশের লোকদের আলাদা আলাদা এলাকায় রাখা হয়েছে। আর প্রত্যেক এলাকার জন্য রয়েছে ভয়াল দর্শন প্রহরী_ কেউ পালাতে চেষ্টা করলে আরও কঠোর-হিংস্র শাস্তি। কিন্তু বাঙালিদের জন্য নির্ধারিত এলাকায় কোনো প্রহরী নেই। কেন নেই, এ প্রশ্নের উত্তরে নরকের কর্তার মন্তব্য_ বাঙালিরা কেউ পালিয়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করলে অন্যরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যায়।
বাঙালিরা একে অপরকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে না, এ কৌতুকে সেটাই বলতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু চার দশকে আমাদের যে অগ্রগতি, তা থেকে তো এ কথা বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের জাস্ট ফালান্ড এবং জে আর পারকিনসন নামে দু'জন অর্থনীতিবিদ ১৯৭৬ সালে লিখেছিলেন : 'এমনকি সর্বোত্তম পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি সংকটপূর্ণ ও জটিল উন্নয়ন সমস্যা। জনগণ দরিদ্র (মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার), জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং বেশিরভাগ নিরক্ষর। এ দেশটি হতে পারে উন্নয়নের জন্য টেস্ট কেস। যদি বাংলাদেশের উন্নতি ঘটে, তাহলে ধরে নিতে হবে বিশ্বের যে কোথাও তা করা সম্ভব।'
এ কথার অর্থ দাঁড়ায় এ রকম_'যদি ওই ছেলে মাধ্যমিক পাস করে তাহলে স্কুলের চেয়ার-টেবিলও পাস করবে।'
শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলাদেশ চার দশক টিকে গেছে। যারা তলাবিহীন ঝুড়ি বলতে বলতে গলা ফাটিয়ে ফেলত, তারাও এখন স্বীকার করছে যে এ দেশটির তলানিতে কিছু জমা হচ্ছে বটে। পায়ের নিচে কিছু ভিত মিলছে, যা কিছু শক্তও বটে। রেহমান সোবহান ও অমর্ত্য সেন দু'জনেই বলছিলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে বাস্কেট কেস ব্যবহার করা হয়েছিল, বটমলেস বাস্কেট নয়। তলাবিহীন ঝুড়ি প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের ভেতরেরই কিছু লোকের আবিষ্কার, যারা নিজেদের দেশকে হেয় করেই মজা পেয়েছে এবং এখনও পায়। ড. আকবর আলি খান লিখেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে এমন নেতিবাচক ধারণার কারণ তিনটি। এক. পাকিস্তানি প্রচারে তারা বিভ্রান্ত হয়েছিল। তারা বলত, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান মিলে যে অর্থনীতি তা দেশটিকে টিকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু পৃথক বাংলাদেশের অর্থনীতি তেমনটি নয়। তাই বাংলাদেশ টিকবে না। দুই. নবজাত বাংলাদেশে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি এবং তা অসহনীয় হয়ে পড়বে। দেশটিতে লোকসংখ্যা যে হারে বাড়বে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার চেয়ে কম হারে ঘটবে। তিন. বাংলাদেশ সাহায্যগ্রহীতা দেশ হিসেবে জন্ম নিয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থনীতি আরও বিদেশি সাহায্যনির্ভর হয়ে পড়বে।
কিন্তু হায়, তাদের এ ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়নি। এভাবেও বরং বলা যায়, শকুনের দোয়ায় গরু মরেনি।
তবে এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়, চার দশকে বাংলাদেশ অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে যতটা এগিয়েছে তা আরও দৃশ্যমান হতো_ যদি জনসংখ্যা আরও কিছুটা সীমিত রাখা সম্ভব হতো। আমাদের দেশে এখন যদি ৯ থেকে ১০ কোটি লোক বসবাস করত তাহলে খাদ্য সমস্যা বলে কিছু থাকত না। রাজধানী এভাবে জনবহুল হয়ে পড়ত না। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকটে প্রতিদিন উদ্বেগে কাটাতে হতো না। এখনও সময় আছে, জনসংখ্যা সমস্যাকে আরও গুরুত্ব প্রদান করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের অনেক জমি। কিন্তু আমরা যে সীমিত আয়তনের! ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী...।
আমাদের অগ্রগতি অনেক। আজ পহেলা জানুয়ারি_ দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নতুন বই নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করছে। এ বই সময়মতো পেঁৗছে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ এক বড় অর্জন। অতীতে বেসরকারি খাতের প্রকাশক ও পুস্তক ব্যবসায়ীরা এ কাজে সফল হননি। তারা ব্যবসাকে বড় করে দেখেছেন। রেহমান সোবহান যে দুই সমাজের কথা বলেছেন এবং যা নিয়ে তার দুঃখের শেষ নেই_ শিক্ষা ক্ষেত্রেও তার প্রভাব আমরা দেখছি। তবে বেসরকারি খাতের ওপর সব দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। কার্ল মার্কস তার বিখ্যাত পুঁজি গ্রন্থে টি জে ডানিংয়ের লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন এভাবে : 'মুনাফার সুযোগ থাকলে পুঁজি সাহসী হয়ে ওঠে। ১০ শতাংশ মুনাফার সম্ভাবনা থাকলে পুঁজি যে কোনো স্থানে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ২০ শতাংশ মুনাফার সম্ভাবনায় বাড়ে ব্যাকুলতা। ৫০ শতাংশ মুনাফার সম্ভাবনা থাকলে পুঁজি হয়ে ওঠে দুর্দমনীয়। ১০০ শতাংশ মুনাফার সুযোগ থাকলে সব ধরনের আইন-কানুন পদদলিত করতে দ্বিধা থাকে না। আর মুনাফা যদি ৩০০ শতাংশ হয় তাহলে এমন কোনো অপরাধ নেই যা সংঘটনে আপত্তি থাকে। এমনকি মালিকের ফাঁসিতে ঝোলার শঙ্কা থাকলেও পিছপা হয় না।'
আমাদের ধনবান শ্রেণী এ পথেই চলেছে। তাদের অনেকে ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দেন না, বরং বুক ফুলিয়ে চলেন। শেয়ারবাজারে হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করার পর গলা ফাটিয়ে বলেন, যার সুযোগ আছে মুনাফার সে কেন বসে থাকবে?
চার দশক পর আমরা অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্লেষণ করব এবং এগিয়ে যাওয়ার পথ অবশ্যই চিহ্নিত করব। এ পথে চলতে ধনবান শ্রেণীর উদ্যোগ-উদ্ভাবন-বিনিয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন পড়বে। তাদের মধ্যে অনেক সৃজনশীল উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা দেশকে আরও সমৃদ্ধ করায় বড় ভূমিকা নিতে পারেন। একই সঙ্গে চাই আমজনতার অংশগ্রহণ_ যেমনটি ঘটেছিল একাত্তরে। যে জাতি একাত্তরে জয়ী হয়েছে, তার অর্থনীতি সবল করার সংগ্রামেও পরাজয় নেই।

অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.