ফিরে দেখা ২০১১: খে লা-বাংলাদেশে বিশ্বকাপ
দূরের বাতিঘর। আমাদের কাছে বিশ্বকাপের মানে ছিল এটাই। একটা সময় বিশ্বকাপ মানে ছিল ভিনদেশি কোনো দলকে সমর্থন দেওয়া, সেই দলের পতাকা ওড়ানো, সেই দলের হয়ে গলাবাজি করা, দরকার পড়লে চায়ের কাপে সাইক্লোনও তুলে ফেলা। এরপর একটা সময় এল যখন বিশ্বকাপে আর অন্য দলকে সমর্থন দেওয়ার দরকার পড়ল না, অন্তত ক্রিকেট বিশ্বকাপে। কিন্তু আমরা বিশ্বকাপের আয়োজক হয়ে যাব, বছর কুড়ি আগেও এ কথা বললে হয়তো
আমাদের অনেকেই বিশ্বাস করত না। ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বিশ্বকে চমকে দেওয়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একসময়ের দূরের বাতিঘর চলে এসেছে আমাদের নিঃশ্বাস-ছোঁয়া দূরত্বে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি ক্রিকেট-শ্রেষ্ঠত্বের দশম আসরটির যৌথ আয়োজক হয়েছিল বাংলাদেশ। শুধু তা-ই নয়, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও উদ্বোধনী ম্যাচেরও সফল আয়োজন করেছে বাংলাদেশ।
এই বিশ্বকাপ বাংলাদেশকে ঠিক যেন রোলার কোস্টার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে। তাতে ছিল ৫৮-এর লজ্জা, ছিল ইংল্যান্ড-বধের গৌরবও। শেষ পর্যন্ত পরের রাউন্ডে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি, তবে জাঁকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আর সফল আয়োজনের কারণে অন্তত ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ নিজেদের চ্যাম্পিয়ন দাবি করতেই পারে।—রাজীব হাসান
সাকিব-তামিম অপসারণ
শেফ দ্য মিশনের রিপোর্ট এতটা আলোচিত কখনোই হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে। এক রিপোর্টেই বদলে গেল বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব!
ক্রিকেট শুধু নয়, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেই তুমুল আলোচনার জন্ম দিল গত আগষ্টের জিম্বাবুয়ে সফর শেষে বিসিবি পরিচালক শফিকুর রহমানের দেওয়া রিপোর্ট। অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বগুণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো তাতে। অভিযোগ সহ-অধিনায়ক তামিম ইকবালের বিরুদ্ধেও। সাকিব দলকে একতাবদ্ধ করতে পারছেন না। ব্রায়ান ভিটরিকে ‘অর্ডিনারি’ বলে তামিম নাকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সৌজন্যবোধ নষ্ট করেছেন। খেপিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষ শিবিরকে। জিম্বাবুয়ে সফরে ব্যর্থতার আসল দায় তাই অধিনায়ক-সহঅধিনায়কের।
সাকিব-তামিম বিসিবির অনেকের চক্ষুশূল হয়েছিলেন আগে থেকেই। তাদের বধ করার এরকম মোক্ষম অস্ত্র কেন কাজে লাগাবে না তারা! বোর্ড সভা ডেকে টেবিল চাপড়ে আলোচনা হলো সাকিব-তামিম নেতৃত্বের জন্য কতটা অযোগ্য। ভুলে যাওয়া হলো বাংলাদেশ দলের সাফল্যে তাদের ব্যাট-বলের অবদান। হাবিবুল বাশারের পর অধিনায়কের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ধারা সাকিবই ফিরিয়ে এনেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে। ব্যাট হাতে রান করছেন। বল হাতে উইকেট পাচ্ছেন। ম্যাচ শেষে হাসছেন সাফল্যের হাসি। এই চেহারার একজন অধিনায়ক এ দেশের ক্রিকেট কত প্রতীক্ষার পর পেয়েছে, সেটাও মনে থাকল না কারও!
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশের ক্রীড়াঙ্গন যখন মেসি আর আর্জেন্টিনাকে নিয়ে মাতোয়ারা, তখনই খবর এল সাকিব আর ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নন। তামিম নন সহ-অধিনায়ক।
অথচ সাকিবকে একরকম জোর করেই অধিনায়কের দায়িত্ব দিয়েছিল বিসিবি। ২০০৯-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে সিরিজ ধরে ধরে অধিনায়কত্ব করলেও প্রথম তাকে দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিশ্বকাপের আগে, ২০১০ এর ৩১ ডিসেম্বর। সাকিবও এটাই চাচ্ছিলেন। সিরিজ ধরে ধরে অধিনায়কত্ব করলে সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা করা যায় না। লম্বা সময়ের জন্য পেলে সেটা সম্ভব। সাকিবকে সেভাবে এগুনোর সুযোগই দেওয়া হলো না।
বিশ্বকাপে ৫৮ আর ৭৮ এর লজ্জার ধারাবাহিকতায় জিম্বাবুয়ে সফরেও ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। তবে দল ঘনিষ্ঠ অনেকের সঙ্গে সাকিব-বিরোধীরাও ততদিনে বুঝতে পারছিলেন, সাকিব বদলাচ্ছেন। খোলস থেকে বেরিয়ে অধিনায়ক হিসেবে প্রস্ফুটিত হচ্ছেন। কিন্তু লাভ কি তাতে? সেই খবর তো আর বিসিবির দরবার পর্যন্ত পৌঁছায় না। পৌঁছালেও কর্তারা শুনবেন কেন? শক্ত মেরুদণ্ডের কাউকে অধিনায়কত্বের চেয়ারে বসিয়ে রাখলে যে বোর্ডের খবরদারির সুযোগ কমে যায়, সেটা তো তত দিনে বুঝে গেছেন তারা!
অতএব, মাথা-ব্যথা সারানোর ছুতোয় মাথাটাই কেটে ফেল! —তারেক মাহমুদ
ঢাকায় মেসি
আসবেন রাজার লোক, ক্যাম্বিসের জুতো পায়ে। তাঁর জন্য কত বিনিদ্র অপেক্ষা, কত শিহরণ-জাগানিয়া ক্ষণগণনা! অবশেষে তিনি এলেন। এলেন স্বয়ং রাজপুত্র, কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ফুটবল যাঁর শুধু বাঁ পায়ের জাদুতেই মোহাচ্ছন্ন। হাজার ক্রোশ দূর থেকে শুধু টিভিতেই সেই জাদু দেখে কত বিনিদ্র রাত কেটেছে এই বাংলার কতজনের। সেই লিওনেল মেসি টিভির বাক্স ফুঁড়ে যেন হুট করেই চলে এলেন সামনে। একেবারে রক্তমাংসের লিওনেল মেসি!
সেপ্টেম্বরে সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারকে তাঁর ফর্মের তুঙ্গে দেখার সৌভাগ্য হলো বাংলাদেশের মানুষের। যারা মাঠে গিয়ে দেখতে পেল না, তারাও টিভিতে দেখে তৃপ্ত হলো। আর্জেন্টিনার ‘অর্জুন’ হয়ে আসা মেসিও যেন এদিন তাঁর সবগুলো তূণের খেল দেখাতে প্রস্তুত ছিলেন। ম্যাচে একেবারে মাঝমাঠ থেকে চার নাইজেরীয়কে কাটিয়ে দুর্দান্তভাবে বল নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন। গোলটা অবিশ্বাস্যভাবে ঠেকিয়েছেন গোলরক্ষক। না হলে ফুটবলের সর্বকালের আলোচিত গোলগুলোর একটি হতোই, মেসিও আজীবন মনে রাখতেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম।
তবে এত হাজার মাইল দূরের একটি দেশ আর্জেন্টিনা আর মেসি নামে যেভাবে উথাল তরঙ্গ তুলতে পারে, সেটা দেখেও ফিরে যাওয়া মেসি কি ভুলতে পারবেন কখনো এই দেশের কথা?—রাজীব হাসান
No comments