সরকারি চাকরিজীবীদের বয়সসীমা by এ এম এম শওকত আলী

রকারি চাকরিজীবীদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৫৭ বছর থেকে ৫৯ বছর করার বিষয়ে সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তবে এটা কার্যকর করতে আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে। কারণ এ-সংক্রান্ত আইন সংশোধন না করে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যাবে না। অর্থাৎ এ-সংক্রান্ত বিল সংসদে অনুমোদিত হওয়ার পর সংশোধনী আইন কার্যকর করা হবে। প্রচলিত আইনটি হলো গণকর্মচারী (অবসর) আইন, ১৯৭৪। সংশ্লিষ্ট বিধিমালা হলো গণকর্মচারী (অবসর)


বিধিমালা, ১৯৭৫। অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বৃদ্ধিসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইতিমধ্যে মিডিয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া মন্ত্রিপরিষদে প্রস্তাবটি আলোচনার সময়ও দৃশ্যমান ছিল। কোনো কোনো মন্ত্রী এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। আবার কিছু মন্ত্রী অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৫৯ বছরের পরিবর্তে ৬০ বা ৬২ বছর করার পক্ষেও মত প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। তাঁর যুক্তি ছিল_এক. এর ফলে অন্যদের পদোন্নতি পেতে কোনো বিলম্ব হবে না এবং দুই. নতুন নিয়োগের বিষয়টিও বন্ধ হয়ে যাবে না।
ফিরে দেখলে বলা সম্ভব যে ১৯৪৭ সালের আগে অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ছিল ৫৫ বছর। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে দুই বছর বৃদ্ধি করে করা হয় ৫৭ বছর। আইয়ুব খানের আমলে করা হয় ৬০ বছর। ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে ৬০ বছর হ্রাস করে ৫৭ বছর করা হয়। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও ৫৭ বছর অপরিবর্তিত ছিল। প্রাক ১৯৪৭ সময়কালে অবসর গ্রহণসহ চাকরির অন্যান্য শর্ত বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। এ বিষয়ে দুই ধরনের বিধি ছিল। একটি কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিজীবীদের জন্য। অন্যটি প্রাদেশিক সরকারের চাকরিজীবীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে অবসর গ্রহণসংক্রান্ত আইন ১৯৭৩ সালে অধ্যাদেশ আকারে প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল গণকর্মচারী (অবসর) অধ্যাদেশ, ১৯৭৩। এক বছর পর আইন প্রণীত করে পূর্ববর্তী অধ্যাদেশটি রদ করা হয়। এ আইনের বিধান অনুযায়ী ৫৭ বছর উত্তীর্ণ হওয়ার পরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা সম্ভব ছিল। এখনো তাই আছে। উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট আইনটি কেবল সরকারি চাকরিজীবীদের জন্যই প্রযোজ্য নয়। সরকারি বিধিবদ্ধ সংস্থাসহ সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরাও আইনের আওতাভুক্ত। এ কারণেই বলা হয়েছে গণকর্মচারী (অবসর) আইন। তবে প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ ওয়ার্ক চার্জড কর্মচারীরা এর আওতাবহির্ভূত।
প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের নিয়োগ কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতি। তবে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এ-সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করার এখতিয়ার মূলত প্রধানমন্ত্রীর। কারণ সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীসহ প্রধান বিচারপতির নিয়োগ দিতে রাষ্ট্রপতিই ক্ষমতাবান। তবে রাষ্ট্রীয় অন্যান্য বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতীত রাষ্ট্রপতির এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংবিধানসম্মত নয়। এ বিষয়ে জনমনে সাধারণ ধারণা হলো, আইন অনুযায়ী অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে কোনো কোনো গণকর্মচারীর এক, দুই বা তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত জনস্বার্থে নয়; বরং দলীয় স্বার্থেই গ্রহণ করা হয়েছে বা হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে নগণ্যসংখ্যক ব্যতিক্রমও হতে পারে। এখন পর্যন্ত যে বিষয়টি স্পষ্ট নয় তা হলো প্রস্তাবিত সংশোধনীবলে ৫৭ বছরের স্থলে ৫৯ বছর প্রতিস্থাপিত করা হবে না সম্পূর্ণ নতুন আইন প্রণীত হবে? প্রথাগতভাবে আইন মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রণয়নের বিষয় সমর্থন করে না। কারণ প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত কেবল একটি বিধানের সঙ্গে যুক্ত।
এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। গত বছরই সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, একটি সিভিল সার্ভিস আইন করা হবে। বলা হয়েছিল, গত মার্চ মাসের মধ্যেই এটা করা হবে। আইনের খসড়াও প্রণীত হয়। খসড়াটি নিয়ে মিডিয়ায়ও অনেক কথা বলা হয়। এ খসড়ায় অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬০ বছর ছিল। এ ধরনের আইন প্রণয়নের পক্ষে জোরালো যুক্তি ছিল। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের চাকরিজীবীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়নের বিধান রয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছরের মধ্যেও এ আইন প্রণীত হয়নি। খসড়াটি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কেন আইনে রূপান্তরিত হয়নি, সে বিষয়টি স্পষ্টকরণের প্রয়োজন রয়েছে।
এ পর্যন্ত মিডিয়ায়ও এ প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের আহূত প্রেস কনফারেন্সে বা ব্রিফিংয়েও এ বিষয়টি ছিল উহ্য। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৪ সালের আইনটির কার্যকারিতা ১৯৭৩ সালের নভেম্বর ২৩ তারিখ থেকে করা হয়। কেন আইনটির কার্যকারিতা এক বছর আগে থেকেই করা হয়, সে বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে।
কারণ যেকোনো আইনের কার্যকারিতা পেছনে নেওয়া হলে তা আইনের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। যেকোনো নতুন আইন সাধারণত গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পরই কার্যকর করা হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ভবিষ্যতে কবে থেকে আইন কার্যকর হবে, তা সরকার গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করার ক্ষমতা আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানে উল্লেখ করা হয়। কোন কোন গণকর্মচারী নবসৃষ্ট সুবিধা পাবেন? এ বিষয়ে সরকারের ভাষ্যকারীদের ভিন্ন ধরনের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। কেউ বলেছেন, নিয়ম অনুযায়ী হবে। আবার অন্যরা বলেছেন, যাঁরা ইতিমধ্যে অবসর গ্রহণের প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে গেছেন, তাঁরা এর সুবিধাভোগী হবেন না।
ফিরে দেখলে আরো বলা যায় যে ১৯৯৬-২০০১ সালের প্রথম ভাগে বয়সসীমা বৃদ্ধির প্রস্তাবও বিবেচনাধীন ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একজন উচ্চপর্যায়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা তৎকালীন সংস্থাপনসচিবকে বয়স বৃদ্ধির প্রস্তাব ওই দপ্তরে প্রেরণ করার নির্দেশ প্রদান করেন। যথারীতি এ-সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ প্রেরণ করা হলেও সংশ্লিষ্ট নথিটি আর ফেরত আসেনি। পরবর্তী সরকারও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ওই সময়ও প্রেরিত সারসংক্ষেপে দুটি যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এক. পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে বয়সসীমা ৬০ বছর করা হয়েছে এবং দুই. বাংলাদেশে গড় আয়ু আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দৃষ্টিকোণে দেখতে গেলে বলা যায়, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বহু আগেই গ্রহণ করা সমীচীন ছিল। কেন তখন করা হয়নি তা অজানা।
১৯৭৪ সালে অবসর গ্রহণ আইন প্রণয়নের প্রায় এক বছর পর ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ওই আইনের আওতায় বিধিমালা প্রণীত হয়। পরবর্তী অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাহী বিভাগ এ আইনের আওতায় বিধি অনুসরণের বিষয়ে তেমন কোনো আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। আইনে বলা হয়েছিল, চিকিৎসক ও শিক্ষকদের অবসরে যাওয়ার এক মাস আগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ই প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্ষমতাবান। কিন্তু সব সময়ই প্রক্রিয়াটি কেন্দ্রীভূত করা হয়। সংস্থাপন (বর্তমানে জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই এটা করা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের বিষয়টি কেন্দ্রীভূত হয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। এ দপ্তরের মৌখিক অনুমতি ছাড়া সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ও কোনো নথি প্রক্রিয়াজাত করত না।
১৯৭৫ সালের বিধিমালায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য দুটি মাপকাঠি নির্ধারিত হয়। এক. এ ধরনের নিয়োগ বিবেচনার জন্য প্রস্তাবিত প্রার্থীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাসহ সততা, দক্ষতা, সুনাম ও নৈতিক দৃঢ়তা এবং দুই. এ ধরনের নিয়োগ জনস্বার্থ পূরণে সক্ষম কি না। প্রায় সব সময়ই সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত ত্বরিতগতিতে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে যে মাপকাঠি বিধিমালায় রয়েছে, তা অনুসরণ করার কোনো সময়ই ছিল না। এ ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত জনস্বার্থের পরিপূরক হবে, সে বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত। এ বিষয়টি বিচার বিভাগের দ্বারা পরীক্ষিত হয়নি। তবে অবসরসীমার আগেই কোনো কর্মচারীকে জনস্বার্থে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের নির্বাহী সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রে রিট পিটিশনে উচ্চ আদালতে বিবেচিত ও রায় প্রদান করা হয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভুক্তভোগী কর্মচারী আদালতের রায়ের কোনো সুফলই ভোগ করতে সক্ষম হয়নি। কারণ রায় ঘোষণার আগেই সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বাধ্য হবে অবসর গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ তাঁর ৫৭ বছর পূর্তি হয়েছে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.