ফিরে দেখা ২০১১-শেয়ারবাজারে বছরজুড়ে দরপতন আর বিনিয়োগকারীর আর্তনাদ by সুজয় মহাজন
অস্থিতিশীল ও দরপতনের একটি বছর পার করল দেশের শেয়ারবাজার। ২০১১ সালের পুরোটা সময়ই বাজারের সব কটি সূচকের ব্যাপক পতন ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি আবারও আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এবার বাজারের উত্থানপর্বে বিনিয়োগকারীসহ অনেকে আবারও ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনার আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু সরকারের শীর্ষ মহলসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে বারবার সেই
আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে বিনিয়োগকারীদের অভয় দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছিলেন, ‘৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর বাজারে আর কোনো ’৯৬ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কারণ, এই ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীই বাজারের বড় শক্তি।’
শেষ পর্যন্ত সেই ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর বাজারেই কেলেঙ্কারি ঘটে গেছে। ১৯৯৬ সালের বাজারের সঙ্গে ২০১১ সালের বাজারের কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণেই হয়তো কেলেঙ্কারির ধরনটা পাল্টেছে। কিন্তু ’৯৬ সালে যেমন অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, ২০১১ সালেও একই ঘটনা ঘটেছে। বরং বাজারের ব্যাপ্তি বাড়ার কারণে এবার নিঃস্ব বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বহুগুণে বেড়েছে।
২০১১ সালের অধিকাংশ সময়েই ঢাকায় ডিএসই ভবনের সামনের সড়ক বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের দখলে ছিল। দরপতনের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
পুঁজিবাজার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায়ে সরকার গত এপ্রিলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ভেঙে দিয়ে সেটি পুনর্গঠন করে। পুনর্গঠিত কমিশনও বাজারে দরপতন থামাতে পারেনি। ধারাবাহিক দরপতন চলতে থাকে। এ অবস্থায় পতন ঠেকাতে ও মৃত বাজারে প্রাণ ফেরাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আবেদনে বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগে বাজেট-পরবর্তী প্রায় এক মাস দরপতনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিল বাজার। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। জুলাইয়ের শেষ দিকে বাজারে আবারও দরপতন শুরু হয়। এই দরপতন থামাতে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
এসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ১৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের পর এসইসি বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ২২ দফা প্রণোদনা ঘোষণা করে; যার পূর্ণ বাস্তবায়নের কাজ এখনো চলছে।
২০১০ সালে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে চরম ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ায় বাজারের ধস অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০১১ সালের প্রথম প্রান্তিকের প্রথম দফা ধসকে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনিবার্য হিসেবে মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় দফা ধস ছিল সবার কাছেই অপ্রত্যাশিত। তাই প্রথম দফা ধসেও যাঁদের পুঁজিতে আঁচড় লাগেনি, তাঁরা দ্বিতীয় দফা ধসে দেনার জালে আটকে পড়েন।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক ছিল আট হাজার ৯১৯ পয়েন্ট, ২০১১ সাল শেষে তা নেমে এসেছে পাঁচ হাজার ২৫৮ পয়েন্টে।
সেই হিসাবে ডিএসই সাধারণ মূল্যসূচক কমেছে প্রায় তিন হাজার ৬৬১ পয়েন্ট। ৩০ ডিসেম্বর ২০১০ সালের সূচকের হিসাব ধরলে এক বছরের ব্যবধানে সেটি কমেছে প্রায় তিন হাজার ৩২ পয়েন্ট।
২০১০ সালের শেষ কার্যদিবসে ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। ২০১১ সালের শেষ কার্যদিবসে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৬০ কোটি টাকায়। এই এক বছরের ব্যবধানে দৈনিক লেনদেন কমেছে এক হাজার ২২৩ কোটি টাকা। একই সময়ের ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন ৮৯ হাজার কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকায়।
শেয়ার কেলেঙ্কারি খতিয়ে দেখতে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে সরকার গঠিত চার সদস্যের কমিটি ৩০ দফা সুপারিশসহ ৩২০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দেয়।
তাতে শেয়ারবাজার ধসের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনি দুর্বলতা, প্লেসমেন্ট ব্যবসার নামে দুর্নীতি, একদল সংঘবদ্ধ বিনিয়োগকারীর কারসাজি, আইনের মধ্যে থেকে কিছুসংখ্যক উদ্যোক্তা ও কোম্পানি মালিকের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে দায়ী করা হয়। সেই অনুযায়ী এসইসির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে একদল বিনিয়োগকারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণসহ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে কমিটি।
ওই সুপারিশের বড় অংশই এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে কমিটির প্রধান সম্প্রতি এক সেমিনারে জানিয়েছেন। এ কারণে বাজারে চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে বলেও তিনি জানান।
অপর দিকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর বাজার কিছুটা স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে শুরু করেছে। বছরের শেষ সপ্তাহের লেনদেন পর্যালোচনা করে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই গতি বজায় থাকলে নতুন বছরে বাজার স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক ধারায় চলবে।
No comments