হঠাৎ আশার নির্বাপণ by ফারুক ওয়াসিফ
খবরটা এল সকালের দিকেই। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ভেসে উঠল একটা অপ্রত্যাশিত শিরোনাম: ‘তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরসহ নিহত ৫’। শিরোনামের ওপরে কিকার দেওয়া ছিল, ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। কিকার সাংবাদিকতার পরিভাষা; অর্থ যা ধাক্কা দেয়, যা পদাঘাতে সচকিত করে। প্রায় তরুণ এবং কীর্তিমান দুই পুরুষের এমন হঠাৎ প্রস্থান সত্যিই ধাক্কা দিয়েছিল অসংখ্য মানুষের মনে। নিয়তির এমন নির্মমতায় থমকে গিয়েছিল অনেকের মন। আর এভাবেই বছরের
নাড়া-দেওয়া মৃত্যুর তালিকার শীর্ষে উঠে আসে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং চিত্রগ্রাহক ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরের নাম।
১৩ সংখ্যাটির সঙ্গে অশুভর যোগাযোগটা একটা কুসংস্কার। কিন্তু আগস্টের ১৩ তারিখেই ঘটল ঘটনাটি। তাঁদের সঙ্গী হলেন আরও তিনজন চলচ্চিত্রকর্মী। তারেক মাসুদের জীবনসঙ্গিনী চলচ্চিত্রকার ক্যাথরিন মাসুদ মৃত্যুযাত্রার সঙ্গী হলেও প্রাণে বাঁচলেন। গুরুতর আহত হলেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। তাঁরা সবাই মানিকগঞ্জে গিয়েছিলেন তারেক মাসুদের পরের ছবি কাগজের ফুল-এর দৃশ্যপট নির্বাচনে। কিন্তু সেটাই হয়ে উঠল এক ট্র্যাজিক কাহিনির শেষ দৃশ্যপট। কাগজের ফুল আর ফুটল না, খবরের কাগজে পরদিন ফুটল কালো অক্ষরের শোক শিরোনাম: তারেক-মিশুকের বিদায়। সড়ক দুর্ঘটনা এবং এই যুগল মৃত্যু এভাবে চিরকালের জন্য একাকার হয়ে গেল। আর সংবাদমাধ্যম হয়ে রইল সেই দুঃসংবাদের ভগ্নদূত।
মুহূর্তের মধ্যেই অজস্রবার কপি হলো শিরোনামটি। কেউ ফোনে, কেউ ইন্টারনেটের ব্লগে ও ফেসবুকে—যে যেভাবে পারে, খবরটি ছড়িয়ে দিতে থাকল। অবিশ্বাস্যকেও অনিবার্য মনে হয় কখনো কখনো। মৃত্যুগুলো প্রথমে অবিশ্বাস্য লেগেছিল, কিন্তু বারবার শুনে-দেখে-জেনে নেওয়ার পর অনিবার্যতা পেয়ে গেল সংবাদটি। সবাই বুঝে গেল, যারা যাওয়ার ছিল না, তারা সত্যি সত্যিই চলে গেছে—আর ফেরানো যাবে না। ‘আর ফেরানো যাবে না’—এই অনুভূতির চাপ কমাতে নির্বাক শোক শব্দ পেল। শোকার্ত, ক্রুদ্ধ আর হতাশার সংলাপে-বিলাপের প্রতিধ্বনি উঠল মধ্যবিত্ত মহলে। ফেসবুক ও ব্লগে বইতে থাকল শোক আর ক্ষোভের ঢল। এভাবেই ঘটনাটি ২০১১ সালের অজস্র সড়ক দুর্ঘটনা ও জীবনের অনিশ্চয়তার প্রতীক হয়ে উঠল। শোকের ভাষার মধ্যে ফুটে উঠতে থাকল প্রতিবাদের স্বর। অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, বেপরোয়া চালক আর দায়িত্বহীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে দাঁড়াতে হলো নাগরিক কাঠগড়ায়।
সব মৃত্যুই সমান মর্মান্তিক। সব শোকই অসহনীয়। যার জীবন যায়, তার তো সবই যায়। কিন্তু তারেক আর মিশুকদের সমাধিস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা হলেও সমাধিস্থ হয়েছিল একটি উচ্চাশা। নিঃসন্দেহে তারেক মাসুদ জীবিত বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকারদের প্রধানতম ছিলেন। তাঁর মাটির ময়না, মুক্তির গান, রানওয়েকে দেখা হচ্ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের মাইলফলক হিসেবে। মাটির ময়না বিশ্বচলচ্চিত্রের মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছিল; পেয়েছিল বিশ্বখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ সমালোচক পুরস্কার। মুক্তির গান চলচ্চিত্র তরুণদের মনে মুক্তিযুদ্ধকে পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের সময়কার তরুণদের মানসনায়ক। অন্যদিকে, মিশুক মুনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে হিসেবে নন, নিজ গুণেই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকতা ছেড়ে সরাসরি সাংবাদিকতায় জড়িত হন। বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শকদের মধ্যে আগুয়ানই ছিলেন বরাবর। কানাডার প্রবাসজীবনে বন্ধুদের সঙ্গে রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক নামে বিকল্প মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন।
এ রকম অসামান্য দুটি জীবনের অকালপ্রয়াণ জাতীয় ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়।
সব কান্নাই নোনা ব্যথার। সব মৃত্যুই মানবতার। তারেক-মিশুকদের মৃত্যুর মধ্যে তাই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আরও হাজার হাজার মানুষের বিপর্যয়ই দেখা যায়। মৃত্যু খ্যাত আর অখ্যাতদের এক করে দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, কেউই আর নিরাপদ নয়। জানিয়ে দেয়, এ দেশে জীবন জিয়ে না।
১৩ সংখ্যাটির সঙ্গে অশুভর যোগাযোগটা একটা কুসংস্কার। কিন্তু আগস্টের ১৩ তারিখেই ঘটল ঘটনাটি। তাঁদের সঙ্গী হলেন আরও তিনজন চলচ্চিত্রকর্মী। তারেক মাসুদের জীবনসঙ্গিনী চলচ্চিত্রকার ক্যাথরিন মাসুদ মৃত্যুযাত্রার সঙ্গী হলেও প্রাণে বাঁচলেন। গুরুতর আহত হলেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। তাঁরা সবাই মানিকগঞ্জে গিয়েছিলেন তারেক মাসুদের পরের ছবি কাগজের ফুল-এর দৃশ্যপট নির্বাচনে। কিন্তু সেটাই হয়ে উঠল এক ট্র্যাজিক কাহিনির শেষ দৃশ্যপট। কাগজের ফুল আর ফুটল না, খবরের কাগজে পরদিন ফুটল কালো অক্ষরের শোক শিরোনাম: তারেক-মিশুকের বিদায়। সড়ক দুর্ঘটনা এবং এই যুগল মৃত্যু এভাবে চিরকালের জন্য একাকার হয়ে গেল। আর সংবাদমাধ্যম হয়ে রইল সেই দুঃসংবাদের ভগ্নদূত।
মুহূর্তের মধ্যেই অজস্রবার কপি হলো শিরোনামটি। কেউ ফোনে, কেউ ইন্টারনেটের ব্লগে ও ফেসবুকে—যে যেভাবে পারে, খবরটি ছড়িয়ে দিতে থাকল। অবিশ্বাস্যকেও অনিবার্য মনে হয় কখনো কখনো। মৃত্যুগুলো প্রথমে অবিশ্বাস্য লেগেছিল, কিন্তু বারবার শুনে-দেখে-জেনে নেওয়ার পর অনিবার্যতা পেয়ে গেল সংবাদটি। সবাই বুঝে গেল, যারা যাওয়ার ছিল না, তারা সত্যি সত্যিই চলে গেছে—আর ফেরানো যাবে না। ‘আর ফেরানো যাবে না’—এই অনুভূতির চাপ কমাতে নির্বাক শোক শব্দ পেল। শোকার্ত, ক্রুদ্ধ আর হতাশার সংলাপে-বিলাপের প্রতিধ্বনি উঠল মধ্যবিত্ত মহলে। ফেসবুক ও ব্লগে বইতে থাকল শোক আর ক্ষোভের ঢল। এভাবেই ঘটনাটি ২০১১ সালের অজস্র সড়ক দুর্ঘটনা ও জীবনের অনিশ্চয়তার প্রতীক হয়ে উঠল। শোকের ভাষার মধ্যে ফুটে উঠতে থাকল প্রতিবাদের স্বর। অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, বেপরোয়া চালক আর দায়িত্বহীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে দাঁড়াতে হলো নাগরিক কাঠগড়ায়।
সব মৃত্যুই সমান মর্মান্তিক। সব শোকই অসহনীয়। যার জীবন যায়, তার তো সবই যায়। কিন্তু তারেক আর মিশুকদের সমাধিস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা হলেও সমাধিস্থ হয়েছিল একটি উচ্চাশা। নিঃসন্দেহে তারেক মাসুদ জীবিত বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকারদের প্রধানতম ছিলেন। তাঁর মাটির ময়না, মুক্তির গান, রানওয়েকে দেখা হচ্ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের মাইলফলক হিসেবে। মাটির ময়না বিশ্বচলচ্চিত্রের মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছিল; পেয়েছিল বিশ্বখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ সমালোচক পুরস্কার। মুক্তির গান চলচ্চিত্র তরুণদের মনে মুক্তিযুদ্ধকে পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের সময়কার তরুণদের মানসনায়ক। অন্যদিকে, মিশুক মুনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে হিসেবে নন, নিজ গুণেই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকতা ছেড়ে সরাসরি সাংবাদিকতায় জড়িত হন। বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শকদের মধ্যে আগুয়ানই ছিলেন বরাবর। কানাডার প্রবাসজীবনে বন্ধুদের সঙ্গে রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক নামে বিকল্প মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন।
এ রকম অসামান্য দুটি জীবনের অকালপ্রয়াণ জাতীয় ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়।
সব কান্নাই নোনা ব্যথার। সব মৃত্যুই মানবতার। তারেক-মিশুকদের মৃত্যুর মধ্যে তাই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আরও হাজার হাজার মানুষের বিপর্যয়ই দেখা যায়। মৃত্যু খ্যাত আর অখ্যাতদের এক করে দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, কেউই আর নিরাপদ নয়। জানিয়ে দেয়, এ দেশে জীবন জিয়ে না।
No comments