আইভী: ভয় হতে অভয় পথে by সোহরাব হাসান
জনশক্তির কাছে অস্ত্র, মাস্তানি, পেশিশক্তি ও কালোটাকা যে কিছুই নয়, তা আবারও প্রমাণিত হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন নিয়ে দেশজুড়ে ছিল তোলপাড়, উদ্বেগ-উত্তেজনা। অনেকের কাছে এটি ছিল অসম লড়াই। একদিকে পেশিশক্তি ও কালোটাকা, অন্যদিকে সততা ও শুভবোধ। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে তিন প্রধান প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দলের সিন্ধান্তে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর
আলম খন্দকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ালে ভোটের লড়াইটা হয় সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমানের মধ্যে। তাঁরা দুজন আওয়ামী লীগ করলেও দল সমর্থন দেয় শামীম ওসমানকে। নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় জনতার শক্তি ও কালোটাকা-মাস্তানির মধ্যে লড়াইয়ে।
সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে এই নির্বাচনে জনগণ এমন একজন প্রার্থীকে বিজয়ী করেছেন, যিনি একটি দলের হয়েও দলকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। যিনি জয়ের জন্য মাস্তানি বা কালোটাকার ওপর নির্ভর করেননি। নির্ভর করেছেন সাধারণ ভোটারদের ওপর।
সেলিনা হায়াৎ আইভী পেশায় চিকিৎসক, বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে আসা এবং বিদেশের আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে দেশে এসেছেন জনসেবার ব্রত নিয়ে। ২০০৩ সালে যখন সারা দেশে আওয়ামী লীগের দুঃসময়, তখন তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর প্রায় আট বছর সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সীমিত সাধ্যের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে সচেষ্ট থেকেছেন।
যখন দলীয় সমর্থনের প্রশ্ন এল, সেলিনা হায়াৎ আইভী বিমুখ হলেন, শীর্ষ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে তাঁকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য পদের টোপ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি রাজি হননি। নারায়ণগঞ্জের মেয়ে আইভী নিজেকে নারায়ণগঞ্জবাসীর সেবায়ই নিয়োজিত রাখতে চাইলেন।
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী-সমর্থক, বিশেষ করে যাঁরা সুযোগসন্ধানী নন, দলের সেই নেতারাও তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর সমর্থনে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ গঠিত হলো। দলমত-নির্বিশেষে সবাই তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এলেন।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একদা সন্ত্রাসের জনপদ নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জে গণবিপ্লব সংঘটিত হলো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জবাসী সজাগ ও সতর্ক ছিলেন, যাতে ভোটকেন্দ্র দখল বা ভোটের ফল ছিনতাই হয়ে না যায়। প্রতিপক্ষ তাঁকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিয়েছে, পোষ্টার ছিঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু যাঁর পোস্টার ভোটারদের বুকের মাঝে, তাঁকে হারানো যায় না। এক লাখেরও বেশি ভোটে জয় ছিনিয়ে নিলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী।
বাংলাদেশে যেখানে ভোটের রাজনীতি মানে অনেকটা পেশিশক্তি ও কালোটাকা প্রভাবিত, সেখানে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে। এমনকি নির্বাচিত হওয়ার পরও আইভী কারও মন জুগিয়ে কথা বলেননি। নির্বাচিত প্রতিনিধিকে প্রশাসনিক নির্দেশে সরিয়ে দেওয়ার মন্দ নজিরের তিনি প্রতিবাদ করেছেন। নিঃশঙ্কচিত্তে এগিয়ে চলেছেন ভয় হতে অভয় পথে।
এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথম নারী মেয়র পেল। আশা করা যায়, তাঁর পথ ধরে ভবিষ্যতে আরও বেশিসংখ্যক নারী রাজনীতিতে আসবেন, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন—উত্তরাধিকারসূত্রে নয়, নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়েই।
No comments