কট্টরপন্থা-খাঁটি’ মৌলবাদের প্রকোপ বৃদ্ধি ইসরায়েলে by শান্তনু মজুমদার
ইসরায়েল শুরু থেকেই একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র। এই মৌলবাদ জন্ম থেকে অন্য ধর্মাবলম্বী (সুনির্দিষ্টভাবে মুসলমান) অন্য জাতির (সুনির্দিষ্টভাবে আরব) মানুষজনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে হেনস্তা-শায়েস্তা করার রসদ জুগিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ২০০৯ সালে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে লিকুদ পার্টির সরকার গঠনের পর থেকে মৌলবাদ চর্চায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেশটিতে। এত দিন মৌলবাদী এজেন্ডাগুলো অন্য ধর্ম, অন্য
জাতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করে জায়নবাদ টিকিয়ে রাখায় রাজনীতিকেরা মূল ভূমিকা পালন করলেও এখন কট্টরপন্থী ধর্মগুরু এবং সাধারণ মৌলবাদীরা জোশের সঙ্গে মাঠে নেমেছেন। শুধু অন্য ধর্মাবলম্বী নয়, শুধু অন্য জাতি নয়, নিজ ধর্মের, নিজ জাতির মানুষকে যুগ-অনুপযোগী নিয়মকানুনের শিকলে বেঁধে ফেলতে চাইছে মৌলবাদীরা। বলা যায়, ইসরায়েলে খোদ ইহুদিরাই এখন ‘খাঁটি’ মৌলবাদী হিংস্রতার মুখোমুখি।
গত কিছুদিন ধরে আট বছর বয়সী স্কুলছাত্রী নামা মার্গোলিসেকে নিয়ে যা করা হচ্ছে, তা ইসরায়েলে মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক প্রকোপ বোঝার জন্য যথেষ্ট। ছোট্ট শহর বেইত সিমেশ এর ছোট্ট মেয়ে নামা মৌলবাদীদের জন্য স্কুলে যেতে পারে না স্বাভাবিকভাবে। নামা একটি ধর্মীয় স্কুলে যায় শিক্ষা নিতে এবং সে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাকে লম্বা হাতার জামা ও স্কার্ট পরতে হয়। কিন্তু মৌলবাদীদের চোখে এটা যথেষ্ট নয়। এ জন্য স্কুলে যাওয়ার পথে নামার গায়ে থুতু ছিটাত, চিৎকার করে ‘বেশ্যা’ বলে গালি দিত; নামাকে তথাকথিত ‘শালীন’ পোশাক পরার জন্য হুমকি দিত মৌলবাদীরা। নামার ওপর মৌলবাদী নির্দয়তার খবর নিয়ে একটি টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার পর গত কয়েক দিন পরে মৌলবাদবিরোধী বাক-বিস্তার চলছে ব্যাপক হারে। কিন্তু এসব বাক-আস্ফাালনে মৌলবাদীদের হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। বরং তারা প্রতিবাদ করতে আসা লোকজন এমনকি পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে।
প্রসঙ্গত, বেইত সিমেশের মৌলবাদীরা অনেক দিন ধরেই নারী-পুরুষকে আলাদা ফুটপাতে হাঁটার আহ্বান সংবলিত নির্দেশিকা টানিয়েছে রাস্তায়, তারা ‘শালীনতা’ রক্ষার টহল নামিয়েছে এবং নির্দেশ অমান্যকারীদের দিকে পাথর ছুড়ছে। নারীদের প্রতি তথাকথিত ‘শালীন’ পোশাক পরার আহ্বান জানিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে আবাসিক এলাকাগুলোর দেয়াল। পুলিশ এত দিন এসব দেখেও দেখত না। চরম ডান ও কট্টর ধর্মবাদীদের সরকারের আমলে পুলিশের অবশ্য এসব দেখার কথাও নয়, নামার ঘটনা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চলে আসায় অবশ্য নেতানিয়াহুকেও নিন্দা জানাতে হচ্ছে, যা কোনোভাবেই তার প্রাণের কথা হতে পারে না। গত মাসের শেষ দিকের ঘটনা, মিরিয়াম শিয়ার নামের এক তরুণীকে একটি পথচলতি বাসের পেছন দিকে বসার হুকুম করেন জনৈক ধর্মগুরু। কারণ, মিরিয়াম নারী। ধর্মগুরুর হুকুম অমান্য করায় মিরিয়ামকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করে কট্টর মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে হারেদি তরিকার লোকজন।
লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদীদের মতো ইহুদি মৌলবাদীরা সুনির্দিষ্টভাবে নারীর প্রতি বিরূপ। তাদের ফতোয়াদির মূল অংশই নারীবিদ্বেষী। উদাহরণস্বরূপ ইসরায়েলের মৌলবাদীদের একটি অংশ নারীকণ্ঠের গান শোনাকে পাপ হিসেবে ফতোয়া দিচ্ছে। এ ছাড়া নারী-পুরুষের যুগল কণ্ঠে ধর্মগীত, বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডে নারীর মুখ দেখানোয় আপত্তি থেকে শুরু করে ইহুদি নারীকে কাপড়চোপড়ে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানে নারীকণ্ঠের গান না শোনার জন্যও ধর্মপ্রাণ সেনাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মৌলবাদীরা। এদের নারী বিদ্বেষ এতই প্রবল যে নারীকণ্ঠে গান শোনার আগে মৃত্যু বরণ করা শ্রেয় বলে ফতোয়া দিয়েছেন এক ধর্মগুরু। নেসেটে একজন নারীর বক্তৃতা শোনার ‘অপরাধে’ সম্প্র্রতি একটি প্রাক-মিলিটারি স্কুলের কিছু শিক্ষার্থীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন অপর এক ধর্মগুরু।
ইহুদি আইন হালাছাকে দৃশ্যত কঠিনভাবে মান্য করে জীবনযাপনকারী কিছু লোক ইসরায়েলে সব সময় ছিল। কিন্তু ভীতিকর ব্যাপার হচ্ছে, এই যে অধুনা এসব লোক হালাছাকে পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দিতে উদ্যত হচ্ছে। আর এ কাজে নীরব সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে সরকারের কাছ থেকে। আর এ সুযোগে মৌলবাদীরা তাদের প্রভাব বাড়িয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন। ইহুদিদের বিয়েশাদির ক্ষেত্রেও মৌলবাদী হস্তক্ষেপ বেড়েছে অন্য ধর্ম, অন্য জাতির বিরুদ্ধে মৌলবাদ চর্চাকারী ইসরায়েলে। ইসরায়েলের ইহুদি মৌলবাদী ধর্মগুরুদের মতে, বিয়ে করার জন্য নিজেকে ইহুদি হিসেবে পরিগণিত করাতে চাইলে একজন ব্যক্তিকে কমপক্ষে তিন প্রজন্মের পুরোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, হলোকাস্টের সময় প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসা ইহুদি পরিবারের লোকেরা এ প্রমাণ কীভাবে জোগাড় করবে? মৌলবাদীদের এসব যুক্তি বোঝানো যায়? আসলে যুক্তি হচ্ছে মৌলবাদের চূড়ান্ত প্রতিপক্ষ।
নেতানিয়াহুর জামানাতে কট্টরপন্থীদের সাহস এতটাই বেড়েছে যে তারা মধ্যপন্থী ধর্মগুরুদের সংগঠন জোহারকে বিয়েশাদি পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি তুলছে। তারা আপাতত ব্যর্থ হলেও দাবি থেকে সরে আসেনি। এ ছাড়া ইদানীং ধর্মপন্থী জায়নবাদী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কট্টরতম হারেদিদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। হারেদি শিক্ষকেরা স্বাভাবিকতাবিমুখ, বিজ্ঞানমনস্কতার শত্রু উগ্র মৌলবাদী নতুন প্রজন্মের ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। নিখুঁতভাবে মগজ ধোলাই হয়ে যাওয়া নব্য মৌলবাদীরা যেকোনো রাষ্ট্রীয় আইন বা সামাজিক চর্চাকে ধর্মসম্মত মনে না হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। এভাবে স্বধর্মে মানুষেরাই ক্রমে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে থাকায় মৌলবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভেতর থেকে ধসে যাওয়ার কাজটি ইহুদি মৌলবাদের হাতেও হতে পারে ভবিষ্যতে।
ইসরায়েলে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিষয়াদিতে ইহুদি মৌলবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধির বাস্তবতা অবশ্য এক দিনে তৈরি হয়নি। এ প্রসঙ্গে ২০০৫ সালে লিকুদ পার্টিতে ভাঙন, ২০০৬ সালের আইনসভা নির্বাচনে দলটির নিতান্ত বাজে ফল, ২০০৮ সালের শেষের দিকে সরকার টিকিয়ে রাখায় কাদিমা পার্টির ব্যর্থতা, ২০০৯ সালের শুরুতে লিকুদের নেতৃত্ব কোয়ালিশন সরকার গঠনের মতো বিষয়গুলো স্মরণে রাখতে হবে। ‘হিটনাটকুট’ বা ‘ডিসএনগেইজমেন্ট প্ল্যান’ ইস্যুতে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে ২০০৫ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে লিকুদ থেকে বেরিয়ে যান উদারপন্থী অ্যারিয়েল শ্যারন। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্যারন ‘হিটনাটকুট’ বাস্তবায়িত করেন, যার আওতায় গাজা ও পশ্চিম তীরের উত্তরাংশ থেকে সব ইসরায়েলি বসত সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। ‘হিটনাটকুট’ বাস্তবায়নের পরিণতিতে লিকুদে থাকতে না পেরে দলের উদারপন্থী ও মধ্যপন্থী দল লেবার পার্টির কিছু লোকজন সঙ্গে নিয়ে কাদিমা পার্টি গঠন করেন, ফলে লিকুদের ওপর নেতানিয়াহুর মতো চরম ডানপন্থীর একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়। ‘হিটনাটকুট’-এর সময় ইহুদি উপাসনালয় ভেঙে ফেলার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুকে নিয়ে সে সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দেওয়ার কাজটি বেশ ভালোভাবে করেন নেতানিয়াহু, এ কাজে সহায়তা নেওয়া হয় কট্টরপন্থী ধর্মগুরুদের।
কিন্তু এসবে আশু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ২০০৬ সালে আইনসভা নেসেটের নির্বাচনে ১২০টি আসনের মধ্যে নেতানিয়াহুর লিকুদ মাত্র ১২টি আসন পায়। বলতে গেলে তখন থেকেই উগ্র ডানপন্থার সঙ্গে ধর্মীয় রক্ষণশীল ও ধর্মীয় উগ্রবাদীদের নির্বাচনী সমর্থন লিকুদের দিকে নিয়ে আসার দিকে গুরুত্ব দেন নেতানিয়াহু। এই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের নির্বাচনী মৌসুমের পুরোটাই উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ইঙ্গিতপূর্ণ মুসলিম বিদ্বেষী বাক-বিস্তারে মনোনিবেশ করেন নেতানিয়াহু, যা উগ্র কট্টরপন্থী ইহুদিদের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়। আর ধর্মনির্ভর দলগুলোও নেতানিয়াহুর মাধ্যমে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ দেখতে পায়। নির্বাচনী মৌসুমে অবস্থার এত অবনতি ঘটে যে লেবার পার্টির মতো মধ্যপন্থী দলও উপরিউক্ত বিকৃতিতে অংশ নেয়। মর্মান্তিক ব্যাপার হচ্ছে, প্রগতিশীলতার দাবিদার লেবার পার্টিও দলনেতা এহুদ বারাকের ব্যক্তিস্বার্থের কাছে পরাজিত হয়ে সরকার গঠনে কড়া ডানপন্থী নেতানিয়াহুকে সমর্থন দেয়। এর বিনিমিয়ে বারাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ পেয়ে যান।
ইসরায়েলি ইহুদি মৌলবাদীদের দিনকে দিনকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে রাজনীতির মাঠের নানা হিসাব-নিকাশ ছাড়াও উদারপন্থী ধর্মগুরুদের একটি অংশের মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হওয়ার ভীতিজনিত নীরবতার ভূমিকা আছে। উদারপন্থী ধর্মপন্থীদের আরেকটি অংশের ধারণা, মৌলবাদীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিভেদ তৈরি হওয়াটা ধর্মীয় লাইনের জন্য অধিক ক্ষতিকর। তারা অবশ্যই ভুল। মৌলবাদ কোনো উদারতাই সহ্য করে না, ধর্মীয় উদারপন্থীদের তো একেবারেই নয়।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে গবেষক।
গত কিছুদিন ধরে আট বছর বয়সী স্কুলছাত্রী নামা মার্গোলিসেকে নিয়ে যা করা হচ্ছে, তা ইসরায়েলে মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক প্রকোপ বোঝার জন্য যথেষ্ট। ছোট্ট শহর বেইত সিমেশ এর ছোট্ট মেয়ে নামা মৌলবাদীদের জন্য স্কুলে যেতে পারে না স্বাভাবিকভাবে। নামা একটি ধর্মীয় স্কুলে যায় শিক্ষা নিতে এবং সে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাকে লম্বা হাতার জামা ও স্কার্ট পরতে হয়। কিন্তু মৌলবাদীদের চোখে এটা যথেষ্ট নয়। এ জন্য স্কুলে যাওয়ার পথে নামার গায়ে থুতু ছিটাত, চিৎকার করে ‘বেশ্যা’ বলে গালি দিত; নামাকে তথাকথিত ‘শালীন’ পোশাক পরার জন্য হুমকি দিত মৌলবাদীরা। নামার ওপর মৌলবাদী নির্দয়তার খবর নিয়ে একটি টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার পর গত কয়েক দিন পরে মৌলবাদবিরোধী বাক-বিস্তার চলছে ব্যাপক হারে। কিন্তু এসব বাক-আস্ফাালনে মৌলবাদীদের হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। বরং তারা প্রতিবাদ করতে আসা লোকজন এমনকি পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে।
প্রসঙ্গত, বেইত সিমেশের মৌলবাদীরা অনেক দিন ধরেই নারী-পুরুষকে আলাদা ফুটপাতে হাঁটার আহ্বান সংবলিত নির্দেশিকা টানিয়েছে রাস্তায়, তারা ‘শালীনতা’ রক্ষার টহল নামিয়েছে এবং নির্দেশ অমান্যকারীদের দিকে পাথর ছুড়ছে। নারীদের প্রতি তথাকথিত ‘শালীন’ পোশাক পরার আহ্বান জানিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে আবাসিক এলাকাগুলোর দেয়াল। পুলিশ এত দিন এসব দেখেও দেখত না। চরম ডান ও কট্টর ধর্মবাদীদের সরকারের আমলে পুলিশের অবশ্য এসব দেখার কথাও নয়, নামার ঘটনা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চলে আসায় অবশ্য নেতানিয়াহুকেও নিন্দা জানাতে হচ্ছে, যা কোনোভাবেই তার প্রাণের কথা হতে পারে না। গত মাসের শেষ দিকের ঘটনা, মিরিয়াম শিয়ার নামের এক তরুণীকে একটি পথচলতি বাসের পেছন দিকে বসার হুকুম করেন জনৈক ধর্মগুরু। কারণ, মিরিয়াম নারী। ধর্মগুরুর হুকুম অমান্য করায় মিরিয়ামকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করে কট্টর মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে হারেদি তরিকার লোকজন।
লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদীদের মতো ইহুদি মৌলবাদীরা সুনির্দিষ্টভাবে নারীর প্রতি বিরূপ। তাদের ফতোয়াদির মূল অংশই নারীবিদ্বেষী। উদাহরণস্বরূপ ইসরায়েলের মৌলবাদীদের একটি অংশ নারীকণ্ঠের গান শোনাকে পাপ হিসেবে ফতোয়া দিচ্ছে। এ ছাড়া নারী-পুরুষের যুগল কণ্ঠে ধর্মগীত, বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডে নারীর মুখ দেখানোয় আপত্তি থেকে শুরু করে ইহুদি নারীকে কাপড়চোপড়ে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানে নারীকণ্ঠের গান না শোনার জন্যও ধর্মপ্রাণ সেনাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মৌলবাদীরা। এদের নারী বিদ্বেষ এতই প্রবল যে নারীকণ্ঠে গান শোনার আগে মৃত্যু বরণ করা শ্রেয় বলে ফতোয়া দিয়েছেন এক ধর্মগুরু। নেসেটে একজন নারীর বক্তৃতা শোনার ‘অপরাধে’ সম্প্র্রতি একটি প্রাক-মিলিটারি স্কুলের কিছু শিক্ষার্থীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন অপর এক ধর্মগুরু।
ইহুদি আইন হালাছাকে দৃশ্যত কঠিনভাবে মান্য করে জীবনযাপনকারী কিছু লোক ইসরায়েলে সব সময় ছিল। কিন্তু ভীতিকর ব্যাপার হচ্ছে, এই যে অধুনা এসব লোক হালাছাকে পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দিতে উদ্যত হচ্ছে। আর এ কাজে নীরব সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে সরকারের কাছ থেকে। আর এ সুযোগে মৌলবাদীরা তাদের প্রভাব বাড়িয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন। ইহুদিদের বিয়েশাদির ক্ষেত্রেও মৌলবাদী হস্তক্ষেপ বেড়েছে অন্য ধর্ম, অন্য জাতির বিরুদ্ধে মৌলবাদ চর্চাকারী ইসরায়েলে। ইসরায়েলের ইহুদি মৌলবাদী ধর্মগুরুদের মতে, বিয়ে করার জন্য নিজেকে ইহুদি হিসেবে পরিগণিত করাতে চাইলে একজন ব্যক্তিকে কমপক্ষে তিন প্রজন্মের পুরোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, হলোকাস্টের সময় প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসা ইহুদি পরিবারের লোকেরা এ প্রমাণ কীভাবে জোগাড় করবে? মৌলবাদীদের এসব যুক্তি বোঝানো যায়? আসলে যুক্তি হচ্ছে মৌলবাদের চূড়ান্ত প্রতিপক্ষ।
নেতানিয়াহুর জামানাতে কট্টরপন্থীদের সাহস এতটাই বেড়েছে যে তারা মধ্যপন্থী ধর্মগুরুদের সংগঠন জোহারকে বিয়েশাদি পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি তুলছে। তারা আপাতত ব্যর্থ হলেও দাবি থেকে সরে আসেনি। এ ছাড়া ইদানীং ধর্মপন্থী জায়নবাদী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কট্টরতম হারেদিদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। হারেদি শিক্ষকেরা স্বাভাবিকতাবিমুখ, বিজ্ঞানমনস্কতার শত্রু উগ্র মৌলবাদী নতুন প্রজন্মের ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। নিখুঁতভাবে মগজ ধোলাই হয়ে যাওয়া নব্য মৌলবাদীরা যেকোনো রাষ্ট্রীয় আইন বা সামাজিক চর্চাকে ধর্মসম্মত মনে না হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। এভাবে স্বধর্মে মানুষেরাই ক্রমে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে থাকায় মৌলবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভেতর থেকে ধসে যাওয়ার কাজটি ইহুদি মৌলবাদের হাতেও হতে পারে ভবিষ্যতে।
ইসরায়েলে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিষয়াদিতে ইহুদি মৌলবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধির বাস্তবতা অবশ্য এক দিনে তৈরি হয়নি। এ প্রসঙ্গে ২০০৫ সালে লিকুদ পার্টিতে ভাঙন, ২০০৬ সালের আইনসভা নির্বাচনে দলটির নিতান্ত বাজে ফল, ২০০৮ সালের শেষের দিকে সরকার টিকিয়ে রাখায় কাদিমা পার্টির ব্যর্থতা, ২০০৯ সালের শুরুতে লিকুদের নেতৃত্ব কোয়ালিশন সরকার গঠনের মতো বিষয়গুলো স্মরণে রাখতে হবে। ‘হিটনাটকুট’ বা ‘ডিসএনগেইজমেন্ট প্ল্যান’ ইস্যুতে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে ২০০৫ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে লিকুদ থেকে বেরিয়ে যান উদারপন্থী অ্যারিয়েল শ্যারন। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্যারন ‘হিটনাটকুট’ বাস্তবায়িত করেন, যার আওতায় গাজা ও পশ্চিম তীরের উত্তরাংশ থেকে সব ইসরায়েলি বসত সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। ‘হিটনাটকুট’ বাস্তবায়নের পরিণতিতে লিকুদে থাকতে না পেরে দলের উদারপন্থী ও মধ্যপন্থী দল লেবার পার্টির কিছু লোকজন সঙ্গে নিয়ে কাদিমা পার্টি গঠন করেন, ফলে লিকুদের ওপর নেতানিয়াহুর মতো চরম ডানপন্থীর একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়। ‘হিটনাটকুট’-এর সময় ইহুদি উপাসনালয় ভেঙে ফেলার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুকে নিয়ে সে সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দেওয়ার কাজটি বেশ ভালোভাবে করেন নেতানিয়াহু, এ কাজে সহায়তা নেওয়া হয় কট্টরপন্থী ধর্মগুরুদের।
কিন্তু এসবে আশু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ২০০৬ সালে আইনসভা নেসেটের নির্বাচনে ১২০টি আসনের মধ্যে নেতানিয়াহুর লিকুদ মাত্র ১২টি আসন পায়। বলতে গেলে তখন থেকেই উগ্র ডানপন্থার সঙ্গে ধর্মীয় রক্ষণশীল ও ধর্মীয় উগ্রবাদীদের নির্বাচনী সমর্থন লিকুদের দিকে নিয়ে আসার দিকে গুরুত্ব দেন নেতানিয়াহু। এই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের নির্বাচনী মৌসুমের পুরোটাই উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ইঙ্গিতপূর্ণ মুসলিম বিদ্বেষী বাক-বিস্তারে মনোনিবেশ করেন নেতানিয়াহু, যা উগ্র কট্টরপন্থী ইহুদিদের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়। আর ধর্মনির্ভর দলগুলোও নেতানিয়াহুর মাধ্যমে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ দেখতে পায়। নির্বাচনী মৌসুমে অবস্থার এত অবনতি ঘটে যে লেবার পার্টির মতো মধ্যপন্থী দলও উপরিউক্ত বিকৃতিতে অংশ নেয়। মর্মান্তিক ব্যাপার হচ্ছে, প্রগতিশীলতার দাবিদার লেবার পার্টিও দলনেতা এহুদ বারাকের ব্যক্তিস্বার্থের কাছে পরাজিত হয়ে সরকার গঠনে কড়া ডানপন্থী নেতানিয়াহুকে সমর্থন দেয়। এর বিনিমিয়ে বারাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ পেয়ে যান।
ইসরায়েলি ইহুদি মৌলবাদীদের দিনকে দিনকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে রাজনীতির মাঠের নানা হিসাব-নিকাশ ছাড়াও উদারপন্থী ধর্মগুরুদের একটি অংশের মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হওয়ার ভীতিজনিত নীরবতার ভূমিকা আছে। উদারপন্থী ধর্মপন্থীদের আরেকটি অংশের ধারণা, মৌলবাদীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিভেদ তৈরি হওয়াটা ধর্মীয় লাইনের জন্য অধিক ক্ষতিকর। তারা অবশ্যই ভুল। মৌলবাদ কোনো উদারতাই সহ্য করে না, ধর্মীয় উদারপন্থীদের তো একেবারেই নয়।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে গবেষক।
No comments