চরাচর-সোনাকান্দা ও হাজীগঞ্জ দুর্গের বেহালদশা by আলম শাইন
নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে সোনাকান্দা দুর্গের অবস্থান। মূলত দুর্গের নামানুসারে ওই এলাকার নামকরণ করা হয় সোনাকান্দা। সোনাকান্দা নামের চমৎকার একটি জনশ্রুতি রয়েছে, তবে ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই তাতে। জনশ্রুতিটা হচ্ছে : বার ভূঁইয়াদের অধিপতি ঈশা খাঁ বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের বিধবা কন্যা সোনাবিবিকে জোরপূর্বক বিয়ে করে এই দুর্গে নিয়ে আসেন। বিষয়টা মেনে নিতে পারেননি সোনাবিবি। তিনি নীরবে-
নিভৃতে দুর্গে বসে রাত-দিন কাঁদতে থাকেন। সেই থেকে দুর্গের নামকরণ হয় সোনাকান্দা। এই দুর্গের স্থাপত্যকাল ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময়। মূলত জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ইদ্রাকপুর, সোনাকান্দা ও হাজীগঞ্জ_এই তিনটি দুর্গ নির্মাণ করেছেন বাংলার সুবেদার মীর জুমলা। এগুলো মূলত জলদুর্গ, প্রসাদ দুর্গ নয়। ইটের তৈরি এ দুর্গের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৬ মিটার, প্রস্থ ৫৮ মিটার। দুর্গটি মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। এর উত্তর দিকে রয়েছে একটি প্রবেশ তোরণ। এটি চওড়া পাঁচ মিটার। দুর্গের দেয়ালের পুরু দেড় মিটার। আর দেয়ালের উচ্চতা সাড়ে তিন মিটার হলেও বর্তমানে উচ্চতা অনেকখানি কমে গেছে। দুর্গের পশ্চিমাংশে রয়েছে সিঁড়িযুক্ত খিলান পথ ও উঁচু বেদি। সেখান থেকে নদীর দিকে মুখ করে কামান বসানো থাকত। উল্লেখ্য, এতদঞ্চলের তিনটি জলদুর্গের মধ্যে সোনাকান্দা দুর্গটি সর্ববৃহৎ। সোনাকান্দা দুর্গের একটু ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্য দুটি দুর্গের মধ্যে নেই। এ দুর্গটি দুটি অংশে বিভক্ত। একটি হলো বুরুজবিশিষ্ট আয়তকার ফোকরযুক্ত অংশ আর অন্যটি পশ্চিম দিকে সিঁড়িপথ খিলানযুক্ত উঁচু বেদি। অন্য দুটিতে এমন খিলানসহ প্রবেশপথ নেই। সোনাকান্দা দুর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের চূড়ায় মার্লন নকশা এবং বুরুজ রয়েছে। উঁচু প্রাচীর থেকে বন্দুকের গুলি ও কামানের গোলা ছোড়ার জন্য নির্মিত ফোকরও রয়েছে, যা সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য জানান দেয়। সোনাকান্দা ও হাজীগঞ্জ দুর্গ দুটি ১৯৫০ সালে জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় নিয়ে সংস্কার করা হয়। হাজীগঞ্জ দুর্গটিও মীর জুমলার সময়ে নির্মিত হয়। এটি নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। দুর্গের উত্তর দিকে রয়েছে বিশাল প্রবেশ তোরণ। তোরণের ভেতর ও বাইরের দিকে উচ্চতাবিশিষ্ট সিঁড়িপথ রয়েছে। বাইরের দিকে সিঁড়িধাপ রয়েছে ১৮টি এবং ভেতরের দিকে আটটি। তোরণটি স্থাপন করা হয়েছে একটি আয়তকার কাঠামোর ওপর। তোরণের চূড়ায় রয়েছে চমৎকার খিলান। দুর্গটির দক্ষিণ বাহুর দিকে রয়েছে একটি বৃত্তাকার বুরুজ। এই বুরুজের সামনে স্থায়ীভাবে সাতটি ধাপের বেদি রয়েছে। বেদির ওপর নদীর দিকে মুখ করে বসানো থাকত কামান, যাতে জলদস্যুরা সহজে আক্রমণ করতে না পারে। দুর্গ দুটির বর্তমান অবস্থা ভালো নয়। দ্রুত সংস্কার না হলে এগুলো ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দুর্গগুলো সংস্কার করতে হবে, না হলে মূল স্থাপনার সঙ্গে অমিল ঘটতে পারে। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থ ('লিস্ট অব অ্যানসিয়েন্ট মনুমেন্টস ইন বেঙ্গল') সূত্রে জানা যায়, একসময় হাজীগঞ্জ দুর্গটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। পরে সংস্কার করতে গিয়ে এর অনেক রদবদল করা হয়। কাজেই বিষয়টির প্রতি যথাযথভাবে নজর দিতে দিয়ে এর সঠিক সংস্কার করতে হবে। না হলে দুর্গের বিকৃত রূপ দেখা দেবে। এমনটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
No comments