অর্থনীতি-অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও গৃহীত ব্যবস্থা by আবুল মাল আবদুল মুহিত
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নকে সামনে রেখে দেশ ও জাতির কল্যাণে সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কার্যক্রম শুরু করে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ, উন্নত ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিগণিত করা।
রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের মাধ্যমে ২০১৪ ও ২০১৭ সাল নাগাদ জাতীয় প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৮ শতাংশ ও ১০ শতাংশে উন্নীত করা।
সরকারের ক্ষমতা গ্রহণকালে চ্যালেঞ্জ: সরকারকে একসঙ্গে দুঃশাসন ও দুর্নীতির মোকাবিলা করতে হয় এক হাতে আর অন্য হাতে বিশ্বমন্দা ও মূল্যস্ফীতিকে করতে হয় নিয়ন্ত্রণ। সরকার শক্ত হাতে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করে ও পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করে। ৩০ বছর পর হলেও সরকার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের বিচার শুরু করে। সরকার দুর্নীতির অপবাদ রোধে কঠোর অবস্থান নেয় এবং অন্তত উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের জনবল শক্তিশালী করতে ব্রতী হয় এবং তিন বছরে প্রায় দুই লাখ সরকারি চাকুরেকে নিযুক্তি দেয়। সরকারের কৃতিত্ব হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি।
গত তিন বছরে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে ব্যাপক সুদূরপ্রসারী সংস্কার কার্যক্রম, সুষ্ঠু বাজেট ব্যবস্থাপনা ও প্রণোদনার মতো কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়ন ও রাজস্ব খাতে শৃঙ্খলাও বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।
সরকারের অঙ্গীকার: ক্ষমতা গ্রহণ করার পরে ২০০৯-১০ সালের বাজেট প্রণয়নের সময় সরকারের ঘোষণা ছিল:
‘মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ওয়াদার প্রথম বিষয়টি ছিল মহামন্দার মোকাবিলা, দ্রব্যমূল্যের হ্রাসকরণ ও দেশজ উৎপাদন বাড়িয়ে বা যথাসময়ে আমদানি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।’
‘আমাদের আরেকটি অঙ্গীকার ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-সংকটের সমাধান এবং সেই লক্ষ্যে একটি তিন-সালা জরুরি কার্যক্রম বাস্তবায়ন।’
‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের প্রধান খাতগুলো হলো: কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিল্প ও বাণিজ্য প্রসার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিধান।’
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য: সরকারের অঙ্গীকার মত প্রতিকূল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখাই সরকারের অন্যতম প্রধান অর্জন। গত তিন বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে অবস্থানে আছে তার সার্বিক চিত্রটি নিম্নরূপ:
১. সারা বিশ্বে মহামন্দার সময়ও বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং বিনিয়োগ কখনো নিম্নগামী হয়নি (গড়ে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ)। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী পণ্য ও সেবা রপ্তানি যেখানে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হয় সেখানে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স-প্রবাহ ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হ্রাস পায়, অথচ সে বছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
২. ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তুলনায় পরবর্তী দুই অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার প্রশমিত হয়। বর্তমান অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির যে ঊর্ধ্বমুখী ধারা তা কেবল বাংলাদেশে নয়, বিকাশমান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
৩. সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক নীতিমালা অবলম্বন করেও বাজেট ঘাটতি চার শতাংশের সামান্য ওপরে থাকে।
৪. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন থেকে ১০ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
৫. সরকারি বাজেটের আকার, রাজস্ব আদায় ও সরকারি ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে (উন্নয়ন কার্যক্রমে এই ধারা বহাল থেকেছে)। রাজস্ব আদায় ৬৪ হাজার ৫০০ কোটি থেকে বাড়ছে এক লাখ ১৮ হাজার কোটি ও মোট সরকারি ব্যয় বাড়ছে ৮৯ হাজার কোটি থেকে এক লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
৬. বৈদেশিক সহায়তা হিসেবে নতুন অর্থের যে অঙ্গীকার পাওয়া গেছে তাও দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে। অঙ্গীকার ২৮০০ মিলিয়ন থেকে ৫৯০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
৭. মন্দার মধ্যেও জনশক্তি রপ্তানি বহাল থেকেছে এবং বর্তমান বছরে তা প্রায় পাঁচ লাখে পৌঁছাবে।
৮. কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে জোরদার রেখেছে। মানুষের আয় বাড়িয়েছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।
৯. সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ফলে দারিদ্র্য কমেছে, বিশেষ করে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে এবং বর্তমান মূল্যস্ফীতির প্রভাব বঞ্চিত ব্যক্তিদের ওপরে পড়েনি।
১০. অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে অর্থনীতির গতিশীলতা জোর পেয়েছে এবং শিল্প খাতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে তরল জ্বালানিনির্ভর সরবরাহের পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু রেন্টাল সরবরাহের অবসায়নে তা তিন বছরে অনেক কমে আসবে।
১১. বিভিন্ন কর্মসংস্থান কার্যক্রমের ফলে বেকারত্ব বাড়েনি ও দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য এসেছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৫ সালে ৪০ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: চ্যালেঞ্জ ও সমাধান: ১. ২০১১-১২ সালে বাজেট উপস্থাপনাকালে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও দেশের সমৃদ্ধির জন্য এই সরকার তাদের কৌশল বিবৃত করে এই বলে:
দুটি বছর বিশ্ব মহামন্দার সফল মোকাবিলা করে দেখা গেল যে, ২০১১-১২ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য ও তেলের দাম যেভাবে বাড়তে থাকল তাতে মূল্যস্ফীতি একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে সামনে এল। এ অবস্থা অনুধাবন করে ২০১১-১২ সালের বাজেটে মহাজোট সরকার ঘোষণা দিল, খাদ্যপণ্যের মূল্য ও জ্বালানি তেলের বৃদ্ধিজনিত ‘অভিঘাত মোকাবিলার জন্য আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন: হয়তো বেশ কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হতে পারে। ক. ভর্তুকিসহ কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় হ্রাস,
খ. প্রয়োজনে কৃচ্ছ্র সাধন, গ. রাজস্ব আয় বাড়ানো, ঘ. মুদ্রা সরবরাহ ও ব্যক্তি খাতে ঋণ সরবরাহ কমানো এবং ঙ. বিনিময় হারের যথাযথ বিন্যাস করা।’
৫.২. অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ অভিঘাত মোকাবিলা করে বাংলাদেশ গত তিন বছর সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাসহ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। জিডিপির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু জাতীয় আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়-দারিদ্র্যের হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে । পাশাপাশি, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের ফলে বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাত পরিস্থিতির উন্নতি, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, রাজস্ব আদায়, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অর্জন প্রণিধানযোগ্য।
৫.৩. ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে অর্থনৈতিক নীতিমালা সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির জন্য কাজ করে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা, মহামন্দার মুখে রপ্তানি ধরে রাখা, ঋণখেলাপি থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দেওয়া, কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং সামাজিক ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এসব উদ্যোগের জন্য মুদ্রা ও ঋণনীতি থাকে মোটামুটি সম্প্রসারণশীল। সম্প্রসারণশীল ধারার পরিবর্তন সূচিত হয় ২০১১-১২। মুদ্রা সংকোচন হয় অপরিহার্য, ঋণপ্রদানেও আসে কড়াকড়ি। কিন্তু সরকারের ভর্তুকির দায় তত দ্রুততার সঙ্গে কমানো হয় কষ্টকর। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারে গাফিলতি ও শ্লথগতি। এতে নির্ধারিত ঘাটতি বাজেটে টানাপোড়েন চলে। আবার আমদানি-বাণিজ্যে নিম্নগতিও আসতে দেরি হয়। এ জন্য সাময়িকভাবে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যায় এবং মুদ্রামানে দ্রুত অবচিতি ঘটে। অন্যদিকে পর পর আড়াই বছর অর্থনৈতিক ঊর্ধ্বগতির ফলে প্রত্যাশার হয় বিস্ফোরণ এবং ভর্তুকির জন্য চাহিদা, বাজেট বরাদ্দের জন্য দাবি বাড়তেই থাকে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আমাদের সাবধানতা গ্রহণ করতে হয়েছে।
৫.৪. বর্ণিত পরিস্থিতিতে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন নীতি-কৌশল গ্রহণ করেছে।
ক. রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রচেষ্টা জোরদার
এনবিআর রাজস্ব আদায়
‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ ব্যবস্থার দ্রুত বাস্তবায়ন;
ভ্যাট আদায়ের compliance বৃদ্ধি;
কর ফাঁকি রোধে কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ;
গ্রোথ সেন্টারগুলোকে ভ্যাট ও আয়করের আওতাভুক্তকরণ।
নন-এনবিআর ও এনটিআর রাজস্ব আদায়
২০০০ সালের আগে নির্ধারিত ফি/রেটগুলো বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আবশ্যিকভাবে পুনর্নির্ধারণ;
২০০০-০৬ সময়ে নির্ধারিত ফি/রেটগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা ও পুনর্নির্ধারণ,
নতুন ভ্যাট ও আয়কর আইন প্রণয়ন,
ভ্যাট আইনের খসড়া জানুয়ারি ২০১২ সালের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সভায় উপস্থাপন।
খ. সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতা ও ব্যয় সংকোচন
অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় ব্যয় সীমিত রাখা
সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি ক্রয়, নতুন ভাতা প্রচলন না করা এবং বিদ্যমান ভাতার হার বৃদ্ধি না করা;
খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ পর্যাপ্ত থাকায় খাদ্য আমদানি (চাল) হ্রাস করা।
বর্তমান আর্থিক সীমাবদ্ধতার বিষয় বিবেচনা করে এডিপির ব্যয় অগ্রাধিকারভিত্তিক করা
পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক চিহ্নিত ‘উচ্চ অগ্রাধিকার’, ‘অগ্রাধিকার’ ও ‘কম অগ্রাধিকার’—এই তিন ধরনের প্রকল্পের মধ্যে উচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ প্রদান।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রকল্প সাহায্যের ব্যবহার: পাইপলাইনে থাকা প্রতিশ্রুতি প্রকল্প সাহায্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও দাতা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা।
গ). ভর্তুকিজনিত ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা
জ্বালানি খাতে ভর্তুকিজনিত ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশীয় বাজারে জ্বালানি পণ্যের মূল্য পর্যায়ক্রমে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা;
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি সীমিত রাখার লক্ষ্যে—
পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতের ট্যারিফ adjustment অব্যাহত রাখা;
জ্বালানি খাত-সম্পর্কিত পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কয়লা, গ্যাস, তাপবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বাস্তবায়ন।
কৃষি ভর্তুকি লক্ষ্যভিত্তিক করার জন্য জ্বালানি বাবদ প্রদত্ত ভর্তুকি সুবিধা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সরাসরি প্রদানের কৌশল নির্ধারণ;
কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে বিতরণের কৌশল নির্ধারণ;
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন প্রকার সারের স্থানীয় বিক্রয়মূল্য পুনর্নির্ধারণ।
ঘ. ব্যাংক উৎসের ওপর চাপ কমাতে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস হতে প্রাপ্তি বাড়ানোর উদ্যোগ
জরুরি ভিত্তিতে, পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র হতে প্রাপ্তি বাড়াতে বিশেষ প্রচারণা (compaign) চালানো এবং প্রয়োজনে সুদের হার (সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়ামসহ) বাড়ানো।
ঙ). মুদ্রা খাতসহ লেনদেন ভারসাম্য রক্ষা
মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের অবচিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ ও ঋণের প্রবৃদ্ধি (বিশেষ করে সরকারি খাতে ঋণ গ্রহণ) সীমিত রাখা;
দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে অনুদান ও concessional ঋণের পাশাপাশি বিকল্প অর্থায়নের উৎস বিবেচনা;
উন্নয়ন-সহযোগী দেশ বা সংস্থার সম্ভাব্য অর্থায়নে বৃহৎ প্রকল্পগুলো [যেমন: পদ্মা সেতু, এমআরটি-৬] বাস্তবায়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যা লেনদেন ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে;
জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির লক্ষ্যে
বিদেশ গমনে ইচ্ছুক শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করা।
গৃহীত ও চলমান বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ (নিট ওভার ড্রাফট) ডিসেম্বর ২০১১ সালের শুরুতে যেখানে ছিল ১৪ হাজার ১২০ কোটি টাকা তা ডিসেম্বর ২০১১ শেষ নাগাদ ১০ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। পাশাপাশি যৌক্তিক মুদ্রানীতি গ্রহণের ফলে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রদান নিরুৎসাহিত করার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং খাদ্যপণ্য আমদানি হ্রাসের ফলে সার্বিকভাবে আমদানি কমে আসছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থানও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমদানি ব্যয় হ্রাস ও জনশক্তি রপ্তানির এ ধারা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সহজশর্তে ঋণ ব্যবহার বেগবান হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ মুদ্রাবাজারে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়বে, যা টাকার বিনিময় হারকেও স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসবে। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দিক হচ্ছে রাজনৈতিক বিভাজন ও অসহিষ্ণুতা। (সংক্ষেপিত)
আবুল মাল আবদুল মুহিত: অর্থমন্ত্রী।
সরকারের ক্ষমতা গ্রহণকালে চ্যালেঞ্জ: সরকারকে একসঙ্গে দুঃশাসন ও দুর্নীতির মোকাবিলা করতে হয় এক হাতে আর অন্য হাতে বিশ্বমন্দা ও মূল্যস্ফীতিকে করতে হয় নিয়ন্ত্রণ। সরকার শক্ত হাতে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করে ও পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করে। ৩০ বছর পর হলেও সরকার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের বিচার শুরু করে। সরকার দুর্নীতির অপবাদ রোধে কঠোর অবস্থান নেয় এবং অন্তত উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের জনবল শক্তিশালী করতে ব্রতী হয় এবং তিন বছরে প্রায় দুই লাখ সরকারি চাকুরেকে নিযুক্তি দেয়। সরকারের কৃতিত্ব হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি।
গত তিন বছরে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে ব্যাপক সুদূরপ্রসারী সংস্কার কার্যক্রম, সুষ্ঠু বাজেট ব্যবস্থাপনা ও প্রণোদনার মতো কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়ন ও রাজস্ব খাতে শৃঙ্খলাও বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।
সরকারের অঙ্গীকার: ক্ষমতা গ্রহণ করার পরে ২০০৯-১০ সালের বাজেট প্রণয়নের সময় সরকারের ঘোষণা ছিল:
‘মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ওয়াদার প্রথম বিষয়টি ছিল মহামন্দার মোকাবিলা, দ্রব্যমূল্যের হ্রাসকরণ ও দেশজ উৎপাদন বাড়িয়ে বা যথাসময়ে আমদানি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।’
‘আমাদের আরেকটি অঙ্গীকার ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-সংকটের সমাধান এবং সেই লক্ষ্যে একটি তিন-সালা জরুরি কার্যক্রম বাস্তবায়ন।’
‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের প্রধান খাতগুলো হলো: কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিল্প ও বাণিজ্য প্রসার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিধান।’
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য: সরকারের অঙ্গীকার মত প্রতিকূল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখাই সরকারের অন্যতম প্রধান অর্জন। গত তিন বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে অবস্থানে আছে তার সার্বিক চিত্রটি নিম্নরূপ:
১. সারা বিশ্বে মহামন্দার সময়ও বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং বিনিয়োগ কখনো নিম্নগামী হয়নি (গড়ে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ)। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী পণ্য ও সেবা রপ্তানি যেখানে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হয় সেখানে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স-প্রবাহ ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হ্রাস পায়, অথচ সে বছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
২. ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তুলনায় পরবর্তী দুই অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার প্রশমিত হয়। বর্তমান অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির যে ঊর্ধ্বমুখী ধারা তা কেবল বাংলাদেশে নয়, বিকাশমান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
৩. সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক নীতিমালা অবলম্বন করেও বাজেট ঘাটতি চার শতাংশের সামান্য ওপরে থাকে।
৪. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন থেকে ১০ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
৫. সরকারি বাজেটের আকার, রাজস্ব আদায় ও সরকারি ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে (উন্নয়ন কার্যক্রমে এই ধারা বহাল থেকেছে)। রাজস্ব আদায় ৬৪ হাজার ৫০০ কোটি থেকে বাড়ছে এক লাখ ১৮ হাজার কোটি ও মোট সরকারি ব্যয় বাড়ছে ৮৯ হাজার কোটি থেকে এক লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
৬. বৈদেশিক সহায়তা হিসেবে নতুন অর্থের যে অঙ্গীকার পাওয়া গেছে তাও দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে। অঙ্গীকার ২৮০০ মিলিয়ন থেকে ৫৯০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
৭. মন্দার মধ্যেও জনশক্তি রপ্তানি বহাল থেকেছে এবং বর্তমান বছরে তা প্রায় পাঁচ লাখে পৌঁছাবে।
৮. কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে জোরদার রেখেছে। মানুষের আয় বাড়িয়েছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।
৯. সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ফলে দারিদ্র্য কমেছে, বিশেষ করে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে এবং বর্তমান মূল্যস্ফীতির প্রভাব বঞ্চিত ব্যক্তিদের ওপরে পড়েনি।
১০. অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে অর্থনীতির গতিশীলতা জোর পেয়েছে এবং শিল্প খাতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে তরল জ্বালানিনির্ভর সরবরাহের পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু রেন্টাল সরবরাহের অবসায়নে তা তিন বছরে অনেক কমে আসবে।
১১. বিভিন্ন কর্মসংস্থান কার্যক্রমের ফলে বেকারত্ব বাড়েনি ও দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য এসেছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৫ সালে ৪০ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: চ্যালেঞ্জ ও সমাধান: ১. ২০১১-১২ সালে বাজেট উপস্থাপনাকালে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও দেশের সমৃদ্ধির জন্য এই সরকার তাদের কৌশল বিবৃত করে এই বলে:
দুটি বছর বিশ্ব মহামন্দার সফল মোকাবিলা করে দেখা গেল যে, ২০১১-১২ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য ও তেলের দাম যেভাবে বাড়তে থাকল তাতে মূল্যস্ফীতি একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে সামনে এল। এ অবস্থা অনুধাবন করে ২০১১-১২ সালের বাজেটে মহাজোট সরকার ঘোষণা দিল, খাদ্যপণ্যের মূল্য ও জ্বালানি তেলের বৃদ্ধিজনিত ‘অভিঘাত মোকাবিলার জন্য আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন: হয়তো বেশ কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হতে পারে। ক. ভর্তুকিসহ কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় হ্রাস,
খ. প্রয়োজনে কৃচ্ছ্র সাধন, গ. রাজস্ব আয় বাড়ানো, ঘ. মুদ্রা সরবরাহ ও ব্যক্তি খাতে ঋণ সরবরাহ কমানো এবং ঙ. বিনিময় হারের যথাযথ বিন্যাস করা।’
৫.২. অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ অভিঘাত মোকাবিলা করে বাংলাদেশ গত তিন বছর সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাসহ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। জিডিপির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু জাতীয় আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়-দারিদ্র্যের হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে । পাশাপাশি, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের ফলে বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাত পরিস্থিতির উন্নতি, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, রাজস্ব আদায়, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অর্জন প্রণিধানযোগ্য।
৫.৩. ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে অর্থনৈতিক নীতিমালা সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির জন্য কাজ করে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা, মহামন্দার মুখে রপ্তানি ধরে রাখা, ঋণখেলাপি থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দেওয়া, কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং সামাজিক ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এসব উদ্যোগের জন্য মুদ্রা ও ঋণনীতি থাকে মোটামুটি সম্প্রসারণশীল। সম্প্রসারণশীল ধারার পরিবর্তন সূচিত হয় ২০১১-১২। মুদ্রা সংকোচন হয় অপরিহার্য, ঋণপ্রদানেও আসে কড়াকড়ি। কিন্তু সরকারের ভর্তুকির দায় তত দ্রুততার সঙ্গে কমানো হয় কষ্টকর। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারে গাফিলতি ও শ্লথগতি। এতে নির্ধারিত ঘাটতি বাজেটে টানাপোড়েন চলে। আবার আমদানি-বাণিজ্যে নিম্নগতিও আসতে দেরি হয়। এ জন্য সাময়িকভাবে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যায় এবং মুদ্রামানে দ্রুত অবচিতি ঘটে। অন্যদিকে পর পর আড়াই বছর অর্থনৈতিক ঊর্ধ্বগতির ফলে প্রত্যাশার হয় বিস্ফোরণ এবং ভর্তুকির জন্য চাহিদা, বাজেট বরাদ্দের জন্য দাবি বাড়তেই থাকে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আমাদের সাবধানতা গ্রহণ করতে হয়েছে।
৫.৪. বর্ণিত পরিস্থিতিতে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন নীতি-কৌশল গ্রহণ করেছে।
ক. রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রচেষ্টা জোরদার
এনবিআর রাজস্ব আদায়
‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ ব্যবস্থার দ্রুত বাস্তবায়ন;
ভ্যাট আদায়ের compliance বৃদ্ধি;
কর ফাঁকি রোধে কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ;
গ্রোথ সেন্টারগুলোকে ভ্যাট ও আয়করের আওতাভুক্তকরণ।
নন-এনবিআর ও এনটিআর রাজস্ব আদায়
২০০০ সালের আগে নির্ধারিত ফি/রেটগুলো বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আবশ্যিকভাবে পুনর্নির্ধারণ;
২০০০-০৬ সময়ে নির্ধারিত ফি/রেটগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা ও পুনর্নির্ধারণ,
নতুন ভ্যাট ও আয়কর আইন প্রণয়ন,
ভ্যাট আইনের খসড়া জানুয়ারি ২০১২ সালের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সভায় উপস্থাপন।
খ. সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতা ও ব্যয় সংকোচন
অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় ব্যয় সীমিত রাখা
সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি ক্রয়, নতুন ভাতা প্রচলন না করা এবং বিদ্যমান ভাতার হার বৃদ্ধি না করা;
খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ পর্যাপ্ত থাকায় খাদ্য আমদানি (চাল) হ্রাস করা।
বর্তমান আর্থিক সীমাবদ্ধতার বিষয় বিবেচনা করে এডিপির ব্যয় অগ্রাধিকারভিত্তিক করা
পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক চিহ্নিত ‘উচ্চ অগ্রাধিকার’, ‘অগ্রাধিকার’ ও ‘কম অগ্রাধিকার’—এই তিন ধরনের প্রকল্পের মধ্যে উচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ প্রদান।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রকল্প সাহায্যের ব্যবহার: পাইপলাইনে থাকা প্রতিশ্রুতি প্রকল্প সাহায্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও দাতা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা।
গ). ভর্তুকিজনিত ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা
জ্বালানি খাতে ভর্তুকিজনিত ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশীয় বাজারে জ্বালানি পণ্যের মূল্য পর্যায়ক্রমে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা;
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি সীমিত রাখার লক্ষ্যে—
পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতের ট্যারিফ adjustment অব্যাহত রাখা;
জ্বালানি খাত-সম্পর্কিত পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কয়লা, গ্যাস, তাপবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বাস্তবায়ন।
কৃষি ভর্তুকি লক্ষ্যভিত্তিক করার জন্য জ্বালানি বাবদ প্রদত্ত ভর্তুকি সুবিধা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সরাসরি প্রদানের কৌশল নির্ধারণ;
কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে বিতরণের কৌশল নির্ধারণ;
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন প্রকার সারের স্থানীয় বিক্রয়মূল্য পুনর্নির্ধারণ।
ঘ. ব্যাংক উৎসের ওপর চাপ কমাতে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস হতে প্রাপ্তি বাড়ানোর উদ্যোগ
জরুরি ভিত্তিতে, পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র হতে প্রাপ্তি বাড়াতে বিশেষ প্রচারণা (compaign) চালানো এবং প্রয়োজনে সুদের হার (সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়ামসহ) বাড়ানো।
ঙ). মুদ্রা খাতসহ লেনদেন ভারসাম্য রক্ষা
মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের অবচিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ ও ঋণের প্রবৃদ্ধি (বিশেষ করে সরকারি খাতে ঋণ গ্রহণ) সীমিত রাখা;
দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে অনুদান ও concessional ঋণের পাশাপাশি বিকল্প অর্থায়নের উৎস বিবেচনা;
উন্নয়ন-সহযোগী দেশ বা সংস্থার সম্ভাব্য অর্থায়নে বৃহৎ প্রকল্পগুলো [যেমন: পদ্মা সেতু, এমআরটি-৬] বাস্তবায়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যা লেনদেন ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে;
জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির লক্ষ্যে
বিদেশ গমনে ইচ্ছুক শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করা।
গৃহীত ও চলমান বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ (নিট ওভার ড্রাফট) ডিসেম্বর ২০১১ সালের শুরুতে যেখানে ছিল ১৪ হাজার ১২০ কোটি টাকা তা ডিসেম্বর ২০১১ শেষ নাগাদ ১০ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। পাশাপাশি যৌক্তিক মুদ্রানীতি গ্রহণের ফলে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রদান নিরুৎসাহিত করার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং খাদ্যপণ্য আমদানি হ্রাসের ফলে সার্বিকভাবে আমদানি কমে আসছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থানও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমদানি ব্যয় হ্রাস ও জনশক্তি রপ্তানির এ ধারা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সহজশর্তে ঋণ ব্যবহার বেগবান হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ মুদ্রাবাজারে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়বে, যা টাকার বিনিময় হারকেও স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসবে। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দিক হচ্ছে রাজনৈতিক বিভাজন ও অসহিষ্ণুতা। (সংক্ষেপিত)
আবুল মাল আবদুল মুহিত: অর্থমন্ত্রী।
No comments