সরল গরল-নরসিংদীর ভোট, লোকমান হত্যা ও কিছু প্রশ্ন by মিজানুর রহমান খান
আজ নরসিংদী পৌরসভার ভোটাররা তাঁদের প্রয়াত মেয়র লোকমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। একজন লোকমান হোসেন তাঁদের চোখে সফল নেতা হিসেবে উদ্ভাসিত ছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় রুগ্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে তাঁর জনপ্রিয়তা বা লোকপ্রিয়তা বিচ্ছিন্ন ছিল না।
গোটা উপমহাদেশে গডফাদার ধরনের ভাবমূর্তি নিয়েও জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকার নজির কম নয়। এর কারণ বহুবিধ। তবে টানাপোড়েনে থাকা জনগণের চোখে প্রকট হয়ে ওঠে উন্নয়ন-বঞ্চনা। সুতরাং কে কীভাবে কোথা থেকে উঠে এসে উন্নয়ন নিশ্চিত করছেন, তার বাছবিচার করা তাঁদের পক্ষে সব সময় সম্ভব হয় না। ফৌজি-শাসক জেনারেল এরশাদের ব্যাপকভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে তাঁর প্রতি জনগণের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে। তিনি উন্নয়নের কর্তৃপক্ষ হতে পারেন কিন্তু কিছুতেই নৈতিক কর্তৃপক্ষ নন। লোকমানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উন্নতির সঙ্গে সুশাসনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশে গত তিন দশক দুই বড় দলের দুজন ব্যক্তিনির্ভর যে তন্ত্র সমাজে শিকড় গেড়েছে, তার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ধরনের ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন, বিভিন্ন পেশাদার সংগঠনের নির্বাচন; নির্বাচন যেখানে যেমনই হোক, মনোনয়নের কিংবা গোপন ব্যালটে, ওই দুই ব্যক্তির ছায়া থেকে তা কিছুতেই মুক্ত থাকে না। নারায়ণগঞ্জের আইভী একটি ব্যতিক্রমী উপাখ্যান। কিন্তু তাঁকেও দ্রুত কলুষিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। আমরাও যে যেখানে আছি, কোনো না কোনো মাত্রায় নিজেদের খাপ খাইয়ে চলছি।
নরসিংদীর পৌর মেয়র নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই। এই অবস্থাটি নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা থেকে একেবারেই আলাদা।
আজকের নরসিংদীর নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়াই প্রত্যাশা। কিন্তু আমরা মনে রাখব, এই ভোটাভুটি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের আছরমুক্ত নয়। দলীয় রাজনৈতিক-প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে বিকশিত ও চর্চা করতে না দিলে তার পরিণাম এমনই ধ্বংসাত্মক হতে বাধ্য। আওয়ামী লীগ নরসিংদীতেও দলীয় প্রার্থী দিতে গিয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে গঠিত মনোনয়ন কমিটি দলীয় প্রার্থীর নাম নির্দিষ্ট করতে পারেনি। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, নিহত লোকমান হোসেনের মা যেহেতু লোকমান-ভ্রাতা কামরুজ্জামানকে সমর্থন দিয়েছেন, তাই নরসিংদীর মেয়র নির্বাচনে পাল্টাপাল্টি প্রার্থী দেওয়ার দরকার নেই।
কামরুজ্জামান হলফনামায় বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি ফৌজদারি মামলা ছিল। এর মধ্যে পাঁচটিতে তিনি খালাসপ্রাপ্ত। একটি হত্যা মামলাসহ দুটি ফৌজদারি মামলা এখনো বিচারাধীন। তিনি অষ্টম শ্রেণী পাস। পেশাগতভাবে কামরুজ্জামান একজন ঠিকাদার। আজ তিনি নরসিংদী শহরের উল্লেখযোগ্য করদাতাদের অন্যতম। যদিও একসময় তিনি ছাত্রলীগের সহসভাপতি হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু নরসিংদীর আওয়ামী লীগের শিকড়ের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কখনোই যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং আওয়ামী লীগের যাঁরা ত্যাগী নেতা-কর্মী, তাঁরা চেয়ে চেয়ে দেখলেন; কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, কার্যত পারিবারিক প্রক্রিয়ায় সমাজে নতুন নেতৃত্বের সৃষ্টি ও তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগেরই অপর মেয়র পদপ্রার্থী মোন্তাজ উদ্দিন ভূঁইয়ার পূর্ববৃত্তান্ত অধিকতর পরিচ্ছন্ন। ওয়ার্ড থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এসেছেন। তিনিও প্রতিযোগিতায় আছেন। তাঁর জয়ের সম্ভাবনাও নাকি উড়িয়ে দেওয়ার নয়।
লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর আমি নরসিংদী শহরে গিয়েছিলাম। কথা বলেছি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে। আজ থেকে ৭৮ দিন আগে লোকমান নিহত হয়েছিলেন। নরসিংদীবাসী বিপুল আবেগে তাঁর হত্যার বিচার চেয়েছিলেন। সরকারদলীয় নেতা নিহত হয়েছেন, আর সময়টা এখন আওয়ামী লীগের। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকড় এতটাই গভীরে প্রবেশ করেছে যে এ থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা কখনো চাইলেই সম্পূর্ণ পৃথক রূপে কোনো আচরণ করতে পারে না।
এ ধরনের সংবেদনশীল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার ১২০ দিনের মধ্যে কথা বলেও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের জন্ম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শাসকেরা জনগণকে ভাঁওতা দিয়ে চলছে। নরসিংদীবাসীও সেই একই ভাঁওতার শিকার। যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের সুষ্ঠু বিচারের জন্য মামলার এজাহার ও তার সুষ্ঠু তদন্ত প্রতিবেদন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ কিলার শরিফকে ধরে এবং তার ১২ পৃষ্ঠার জবানবন্দি (এক আইনজ্ঞের মতে এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য) নিয়ে বিরাট কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কিন্তু অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আসামিদের জামিন, জবানবন্দি ও রিমান্ড—এসবই হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমের খোরাক। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবেন না যে, মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় নরসিংদীবাসী কবে জানতে পারবে। চলমান ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ সত্যতা জানতেও আমাদের বিরাট আগ্রহ। এজাহারভুক্ত ১৪ আসামির মধ্যে ১২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর ১১ জন জামিনে বেরিয়ে গেছেন। বাকি একজনের পক্ষে জামিন আবেদনই করা হয়নি। দেশে যথাসময়ে বিচার পাওয়া যায় না বলে আসামিদের জামিন লাভ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন-উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। অস্বাভাবিকতা এই পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে আসামিরা জামিন পেলে যতটা উদ্বেগ তৈরি হয়, বিচার দু-চার বছর পিছিয়ে গেলেও যেন কোনো সমস্যা হয় না। বিনা বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তি কারাগারে বন্দী থাকার মধ্যেও একটা সান্ত্বনা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
আমরা লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ সুপার ও দুজন এএসপিকে নাটকীয়ভাবে বদলি হতে দেখেছি। একজনকে বরখাস্তও করা হয়েছে। কিন্তু জবাবটা মিলছে না অভিযোগপত্র কবে মিলবে। বিচার কবে হবে, সে প্রশ্ন তাই এখনো ঝুলন্ত। যে হত্যাকাণ্ডের পর কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির বিনাশ ঘটেছে, সেই হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী পুলিশি-প্রক্রিয়া এতটা শ্লথ হবে, তা অনেকেরই চিন্তার বাইরে ছিল।
একটি কঠিন সত্যের উল্লেখ না করলেই নয়। দেশের বহু স্থানের মতো নরসিংদীও নিষ্ঠুর বিরাজনৈতিকীকরণের শিকার। সৎ ও ভালো মানুষেরা দলের মধ্য থেকেও নির্জীব থাকাটাই নিয়তি মনে করছেন। যে যুবক জামিনে বেরিয়ে কথিত মতে হামলা চালিয়েছে, তিনি মানিক কমিশনারের ছেলে। মানিক কমিশনার হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি ছিলেন নিহত মেয়র লোকমান। অপর আসামি আজকের মেয়র পদপ্রার্থী মো. কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল। মানিক কমিশনার হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে একজন সাংসদের উপস্থিতিতে ঢাকার এমপি হোস্টেলে লোকমান একটি লিখিত গোপন চুক্তি করেছিলেন, যা দেশের এবং নির্দিষ্টভাবে নরসিংদীর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একটি ক্লাসিক দৃষ্টান্ত। গত ১ নভেম্বর লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে নরসিংদীর রাজনৈতিক অপরাধজগতের বহু খবর বেরিয়েছে। কিন্তু এই অবাক গোপন চুক্তি এই প্রতিবেদকের জানা মতে আজও রয়ে গেছে অনুদ্ঘাটিত এবং অপ্রকাশিত।
আজ ভোটাভুটির মাধ্যমে নরসিংদীর জনগণ নতুন মেয়র নির্বাচন করবেন। কামরুজ্জামান নতুন মেয়র হোন বা না হোন, তাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সত্যিকারের অর্জন হবে সামান্যই। এই শিক্ষাই নেওয়াই সমীচীন, দলীয় রাজনীতিকে মুক্ত জলাশয়ে পরিণত করতে হবে। জোয়ার-ভাটা থাকতে হবে। এটা নিশ্চিত না করলে লোকমান ও কামরুজ্জামানরাই সামনে আসবেন। যদিও তাঁরা তাঁদের কৃতকর্মের সবটুকুর জন্য দায়ী নন। কারণ, কলুষিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাঁরাও কখনো ভিকটিম বা খেলার পুতুল। রুগ্ণ রাজনীতির নগ্ন চেহারাটা এজাহারের আয়নায় দেখুন। লোকমান হত্যা মামলার ১৪ জন আসামি। এর মধ্যে তিনজনই আগের মেয়র নির্বাচনে লোকমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়েছেন। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগার। এজাহারভুক্ত তিন আসামি লোকমানের স্বীকৃত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অন্যদিকে লোকমান-ভ্রাতার প্রতিদ্বন্দ্বী মোন্তাজ উদ্দিন জামিন নিয়ে আজকের নির্বাচন করলেও দল তাঁকে কিন্তু অস্বীকার বা বহিষ্কার করতে পারছে না। তিনি নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। লোকমান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। এসবই দল ও সমাজের জন্য নিদারুণ লজ্জা। ১৯৯৫ সালের পরে সর্বশেষ ২০০৪ সালে নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের কমিটি হয়েছিল কাউন্সিলের মাধ্যমে। গত ১৬ বছর ধরে নরসিংদীতে যদি দলের সংবিধান লঙ্ঘিত না হতো, কমিটিগুলো সুষ্ঠুভাবে ও গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করতে পারত, তাহলে লোকমান হোসেনের চেয়েও আওয়ামী লীগের নীতিনিষ্ঠ ও যোগ্য নেতৃত্ব মেয়র হতে পারতেন। নরসিংদীর অবকাঠামো উন্নয়ন অধিকতর যোগ্য ব্যক্তির হাতে হতে পারত।
মানিক কমিশনার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। লোকমান ওই বিচার-প্রক্রিয়াকে যে বাধাগ্রস্ত করেছিলেন এবং আরও যে চাঞ্চল্যকর অপরাধ করেছিলেন, তার সাক্ষ্যপ্রমাণ অকাট্য। নিহত মানিক কমিশনারের দুই ভাই (মানিক কমিশনার হত্যা মামলার বাদীসহ) ও তাঁর ছেলে লোকমান হত্যার ত্রুটিপূর্ণ এজাহারভুক্ত আসামি। আজ লোকমান-ভ্রাতা কামরুলের সহজ বিজয় অনেকে আশা করছেন। কিন্তু তার পরই কি নরসিংদীর রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরে আসবে? এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন না। মেয়র প্রার্থী কামরুল দুই দিন আগেই ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মানিক কমিশনার হত্যা মামলায় হাজিরা দিয়েছেন বলেও জানলাম। এই হত্যা মামলা প্রত্যাহারে কার কী ভূমিকা ছিল, তা তদন্তের দাবি রাখে।
লোকমানের গোপন চুক্তি এবং লোকমান হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দরকার পড়তে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উন্নতির সঙ্গে সুশাসনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশে গত তিন দশক দুই বড় দলের দুজন ব্যক্তিনির্ভর যে তন্ত্র সমাজে শিকড় গেড়েছে, তার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ধরনের ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন, বিভিন্ন পেশাদার সংগঠনের নির্বাচন; নির্বাচন যেখানে যেমনই হোক, মনোনয়নের কিংবা গোপন ব্যালটে, ওই দুই ব্যক্তির ছায়া থেকে তা কিছুতেই মুক্ত থাকে না। নারায়ণগঞ্জের আইভী একটি ব্যতিক্রমী উপাখ্যান। কিন্তু তাঁকেও দ্রুত কলুষিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। আমরাও যে যেখানে আছি, কোনো না কোনো মাত্রায় নিজেদের খাপ খাইয়ে চলছি।
নরসিংদীর পৌর মেয়র নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই। এই অবস্থাটি নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা থেকে একেবারেই আলাদা।
আজকের নরসিংদীর নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়াই প্রত্যাশা। কিন্তু আমরা মনে রাখব, এই ভোটাভুটি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের আছরমুক্ত নয়। দলীয় রাজনৈতিক-প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে বিকশিত ও চর্চা করতে না দিলে তার পরিণাম এমনই ধ্বংসাত্মক হতে বাধ্য। আওয়ামী লীগ নরসিংদীতেও দলীয় প্রার্থী দিতে গিয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে গঠিত মনোনয়ন কমিটি দলীয় প্রার্থীর নাম নির্দিষ্ট করতে পারেনি। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, নিহত লোকমান হোসেনের মা যেহেতু লোকমান-ভ্রাতা কামরুজ্জামানকে সমর্থন দিয়েছেন, তাই নরসিংদীর মেয়র নির্বাচনে পাল্টাপাল্টি প্রার্থী দেওয়ার দরকার নেই।
কামরুজ্জামান হলফনামায় বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি ফৌজদারি মামলা ছিল। এর মধ্যে পাঁচটিতে তিনি খালাসপ্রাপ্ত। একটি হত্যা মামলাসহ দুটি ফৌজদারি মামলা এখনো বিচারাধীন। তিনি অষ্টম শ্রেণী পাস। পেশাগতভাবে কামরুজ্জামান একজন ঠিকাদার। আজ তিনি নরসিংদী শহরের উল্লেখযোগ্য করদাতাদের অন্যতম। যদিও একসময় তিনি ছাত্রলীগের সহসভাপতি হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু নরসিংদীর আওয়ামী লীগের শিকড়ের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কখনোই যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং আওয়ামী লীগের যাঁরা ত্যাগী নেতা-কর্মী, তাঁরা চেয়ে চেয়ে দেখলেন; কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, কার্যত পারিবারিক প্রক্রিয়ায় সমাজে নতুন নেতৃত্বের সৃষ্টি ও তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগেরই অপর মেয়র পদপ্রার্থী মোন্তাজ উদ্দিন ভূঁইয়ার পূর্ববৃত্তান্ত অধিকতর পরিচ্ছন্ন। ওয়ার্ড থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এসেছেন। তিনিও প্রতিযোগিতায় আছেন। তাঁর জয়ের সম্ভাবনাও নাকি উড়িয়ে দেওয়ার নয়।
লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর আমি নরসিংদী শহরে গিয়েছিলাম। কথা বলেছি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে। আজ থেকে ৭৮ দিন আগে লোকমান নিহত হয়েছিলেন। নরসিংদীবাসী বিপুল আবেগে তাঁর হত্যার বিচার চেয়েছিলেন। সরকারদলীয় নেতা নিহত হয়েছেন, আর সময়টা এখন আওয়ামী লীগের। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকড় এতটাই গভীরে প্রবেশ করেছে যে এ থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা কখনো চাইলেই সম্পূর্ণ পৃথক রূপে কোনো আচরণ করতে পারে না।
এ ধরনের সংবেদনশীল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার ১২০ দিনের মধ্যে কথা বলেও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের জন্ম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শাসকেরা জনগণকে ভাঁওতা দিয়ে চলছে। নরসিংদীবাসীও সেই একই ভাঁওতার শিকার। যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের সুষ্ঠু বিচারের জন্য মামলার এজাহার ও তার সুষ্ঠু তদন্ত প্রতিবেদন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ কিলার শরিফকে ধরে এবং তার ১২ পৃষ্ঠার জবানবন্দি (এক আইনজ্ঞের মতে এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য) নিয়ে বিরাট কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কিন্তু অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আসামিদের জামিন, জবানবন্দি ও রিমান্ড—এসবই হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমের খোরাক। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবেন না যে, মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় নরসিংদীবাসী কবে জানতে পারবে। চলমান ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ সত্যতা জানতেও আমাদের বিরাট আগ্রহ। এজাহারভুক্ত ১৪ আসামির মধ্যে ১২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর ১১ জন জামিনে বেরিয়ে গেছেন। বাকি একজনের পক্ষে জামিন আবেদনই করা হয়নি। দেশে যথাসময়ে বিচার পাওয়া যায় না বলে আসামিদের জামিন লাভ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন-উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। অস্বাভাবিকতা এই পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে আসামিরা জামিন পেলে যতটা উদ্বেগ তৈরি হয়, বিচার দু-চার বছর পিছিয়ে গেলেও যেন কোনো সমস্যা হয় না। বিনা বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তি কারাগারে বন্দী থাকার মধ্যেও একটা সান্ত্বনা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
আমরা লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ সুপার ও দুজন এএসপিকে নাটকীয়ভাবে বদলি হতে দেখেছি। একজনকে বরখাস্তও করা হয়েছে। কিন্তু জবাবটা মিলছে না অভিযোগপত্র কবে মিলবে। বিচার কবে হবে, সে প্রশ্ন তাই এখনো ঝুলন্ত। যে হত্যাকাণ্ডের পর কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির বিনাশ ঘটেছে, সেই হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী পুলিশি-প্রক্রিয়া এতটা শ্লথ হবে, তা অনেকেরই চিন্তার বাইরে ছিল।
একটি কঠিন সত্যের উল্লেখ না করলেই নয়। দেশের বহু স্থানের মতো নরসিংদীও নিষ্ঠুর বিরাজনৈতিকীকরণের শিকার। সৎ ও ভালো মানুষেরা দলের মধ্য থেকেও নির্জীব থাকাটাই নিয়তি মনে করছেন। যে যুবক জামিনে বেরিয়ে কথিত মতে হামলা চালিয়েছে, তিনি মানিক কমিশনারের ছেলে। মানিক কমিশনার হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি ছিলেন নিহত মেয়র লোকমান। অপর আসামি আজকের মেয়র পদপ্রার্থী মো. কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল। মানিক কমিশনার হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে একজন সাংসদের উপস্থিতিতে ঢাকার এমপি হোস্টেলে লোকমান একটি লিখিত গোপন চুক্তি করেছিলেন, যা দেশের এবং নির্দিষ্টভাবে নরসিংদীর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একটি ক্লাসিক দৃষ্টান্ত। গত ১ নভেম্বর লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে নরসিংদীর রাজনৈতিক অপরাধজগতের বহু খবর বেরিয়েছে। কিন্তু এই অবাক গোপন চুক্তি এই প্রতিবেদকের জানা মতে আজও রয়ে গেছে অনুদ্ঘাটিত এবং অপ্রকাশিত।
আজ ভোটাভুটির মাধ্যমে নরসিংদীর জনগণ নতুন মেয়র নির্বাচন করবেন। কামরুজ্জামান নতুন মেয়র হোন বা না হোন, তাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সত্যিকারের অর্জন হবে সামান্যই। এই শিক্ষাই নেওয়াই সমীচীন, দলীয় রাজনীতিকে মুক্ত জলাশয়ে পরিণত করতে হবে। জোয়ার-ভাটা থাকতে হবে। এটা নিশ্চিত না করলে লোকমান ও কামরুজ্জামানরাই সামনে আসবেন। যদিও তাঁরা তাঁদের কৃতকর্মের সবটুকুর জন্য দায়ী নন। কারণ, কলুষিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাঁরাও কখনো ভিকটিম বা খেলার পুতুল। রুগ্ণ রাজনীতির নগ্ন চেহারাটা এজাহারের আয়নায় দেখুন। লোকমান হত্যা মামলার ১৪ জন আসামি। এর মধ্যে তিনজনই আগের মেয়র নির্বাচনে লোকমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়েছেন। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগার। এজাহারভুক্ত তিন আসামি লোকমানের স্বীকৃত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অন্যদিকে লোকমান-ভ্রাতার প্রতিদ্বন্দ্বী মোন্তাজ উদ্দিন জামিন নিয়ে আজকের নির্বাচন করলেও দল তাঁকে কিন্তু অস্বীকার বা বহিষ্কার করতে পারছে না। তিনি নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। লোকমান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। এসবই দল ও সমাজের জন্য নিদারুণ লজ্জা। ১৯৯৫ সালের পরে সর্বশেষ ২০০৪ সালে নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের কমিটি হয়েছিল কাউন্সিলের মাধ্যমে। গত ১৬ বছর ধরে নরসিংদীতে যদি দলের সংবিধান লঙ্ঘিত না হতো, কমিটিগুলো সুষ্ঠুভাবে ও গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করতে পারত, তাহলে লোকমান হোসেনের চেয়েও আওয়ামী লীগের নীতিনিষ্ঠ ও যোগ্য নেতৃত্ব মেয়র হতে পারতেন। নরসিংদীর অবকাঠামো উন্নয়ন অধিকতর যোগ্য ব্যক্তির হাতে হতে পারত।
মানিক কমিশনার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। লোকমান ওই বিচার-প্রক্রিয়াকে যে বাধাগ্রস্ত করেছিলেন এবং আরও যে চাঞ্চল্যকর অপরাধ করেছিলেন, তার সাক্ষ্যপ্রমাণ অকাট্য। নিহত মানিক কমিশনারের দুই ভাই (মানিক কমিশনার হত্যা মামলার বাদীসহ) ও তাঁর ছেলে লোকমান হত্যার ত্রুটিপূর্ণ এজাহারভুক্ত আসামি। আজ লোকমান-ভ্রাতা কামরুলের সহজ বিজয় অনেকে আশা করছেন। কিন্তু তার পরই কি নরসিংদীর রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরে আসবে? এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন না। মেয়র প্রার্থী কামরুল দুই দিন আগেই ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মানিক কমিশনার হত্যা মামলায় হাজিরা দিয়েছেন বলেও জানলাম। এই হত্যা মামলা প্রত্যাহারে কার কী ভূমিকা ছিল, তা তদন্তের দাবি রাখে।
লোকমানের গোপন চুক্তি এবং লোকমান হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দরকার পড়তে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments