চারদিক-চন্দ্রগ্রহণ কি রোগের কারণ?
রাজধানীর রায়েরবাজারের লাকি বললেন, ‘চন্দ্রগ্রহণের সময় বাঁকা হইয়া শুইয়া ছিলাম, তাই ছেলে পা বাঁকা নিয়া জন্মাইছে।’ দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করা লাকি চন্দ্রগ্রহণের সময় বাঁকা হয়ে শুয়ে থাকলে সন্তানের পা বাঁকা হয়—মুরব্বিদের কাছ থেকে কথাটি শুনতে শুনতে খানিকটা বিশ্বাস করা শুরু করেছেন। আবার এ কথা পুরোপুরি মানতেও পারেন না। আবার পায়ের পাতা বাঁকা বা মুগুর পা (ক্লাবফুট) নিয়ে ছেলে জন্মানোর পেছনে কারণও খুঁজে পান না।
গতকাল বুধবার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত) দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মায়েদের মুখে লাকির মতো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের আনাগোনা চলছিল।
এই মায়েরা হাসপাতালটিতে এসেছিলেন দি গ্লেনকো ফাউন্ডেশনের ওয়াক ফর লাইফ পরিচালিত ক্লিনিকে। হাসপাতালের নিচতলায় এ ক্লিনিকে সপ্তাহে দুই দিন মুগুর পায়ের শিশুদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। গতকাল ক্লিনিকে আসা মা ও শিশুদের দেখতে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জাস্টিন লি। অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার গত বছর ওয়াক ফর লাইফের আওতায় আসা আড়াই শ শিশুর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিল। হাইকমিশনার ও কমিশনের কর্মকর্তারা দেখতে এসেছিলেন কার্যক্রমের অগ্রগতি। মুগুর পায়ের শিশুদের আগের ছবি আর গতকাল ক্লিনিকের ভেতরে হেঁটে বেড়ানো, মায়েদের মুখের হাসি দেখে হাইকমিশনারের মুখেও খুশির ঝিলিক লাগে।
দেশে এই ধরনের শিশুর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। প্রতিবছর পাঁচ হাজার শিশু জন্মগতভাবে মুগুর পা নিয়ে জন্মায় বলে ধারণা করা হয়। কম বয়সে চিকিৎসা না করালে তা জটিল হয়। একসময় শিশুটি পুরোপুরি প্রতিবন্ধী হয়ে যায়।
দেশে ২০০৯ সাল থেকে কাজ করা ওয়াক ফর লাইফ গত বছর সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালে মোট ৩৬টি ক্লিনিকের মাধ্যমে পনসেটি মেথডের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে।
সংগঠনের কর্মকর্তারা জানালেন, ১৯৫০-এর দশকে ইগনাকিও পনসেটি নামের একজন চিকিৎসক মেথডটি শুরু করেছিলেন। এ পদ্ধতিতে তিন মাস পর্যন্ত প্রতিদিন অন্তত ২৩ ঘণ্টা শিশুকে বিশেষ জুতা পরিয়ে রাখতে হয়। এরপর পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে সর্বনিম্ন ১২ ঘণ্টা জুতা পরিয়ে রাখতে হয়। যশোরে তৈরি এই বিশেষ জুতাও শিশুদের বিনামূল্যে দিচ্ছে সংগঠনটি। এ পদ্ধতিতে জটিল অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না।
সংগঠনটির দাবি, ২০১০ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ছয় হাজার ৬৯টি মুগুর পা (কোনো শিশুর এক পায়ে, আবার কারও দুই পায়েই হতে পারে) ভালো করতে পেরেছে। তিন বছর বয়সের কম বয়েসী শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছে সংগঠনটি।
বংশগত কারণের পাশাপাশি জমজ শিশুর ক্ষেত্রে মায়ের পেটে জায়গাস্বল্পতায় যেকোনো একজনের বেলায় এ সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সবাই জানান।
কারণ যা-ই হোক না কেন, সন্তানের এ ধরনের সমস্যার পেছনে মায়ের কোনো না কোনো দোষ আছে বলেই এখনো অনেকের ধারণা।
নরসিংদীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মা বলেন, ‘চন্দ্রগ্রহণের সময় এইচএসসি পরীক্ষা ছিল। এ ছাড়া আমি গর্ভবতী—তাও বুঝতে পারিনি। বাইরে গেছি, বাঁকা হয়ে বসে পরীক্ষা দিয়েছি, তাই ছেলের দুই পা এমন হয়েছে বলে শুনতে শুনতে ক্লান্ত।’
একজন মা অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করেই বললেন, ‘জানি, আমার দোষ না, কিন্তু পরের বাড়িতে থেকে প্রতিবাদ করারও সাহস নাই।’
জুরাইনের একজন জানান, দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া মেয়ের পায়ের এ সমস্যাটি গোপন রাখা হয়েছে মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করে।
বিক্রমপুরের ফারহানার জমজ সন্তানের মধ্যে একজনের পায়ে সমস্যা। ফারহানার বোনের ও স্বামীর পরিবারেও একজনের আছে সমস্যাটি। ফলে ফাহিমাকে অন্যদের চেয়ে কিছুটা কম কথা শুনতে হয়েছে।
তবে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাচ্ছে। হাসপাতালে ভাইয়ের বউ ও ৪০ দিন বয়েসী ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে আসা সাইফুননাহার বলেন, ‘আল্লায় দিছে, ভাইয়ের বউয়ের বা আমাদের করার কিছু নাই।’
ওয়াক ফর লাইফের ঢাকা বিভাগের তিনটি ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা ফিজিওথেরাপিস্ট সাকিনা সুলতানা বলেন, শতভাগ শিশুই ভালো হয় বা হবে। তবে ক্লিনিকে আনতে দেরি করা যাবে না। বাবা-মাকে নিয়ম মানতে হবে। ক্লিনিক থেকে দেওয়া বিশেষ জুতা (ব্রেস) নিয়মমতো পরাতে হবে।
নোয়াখালি থেকে রাজধানী—ছেলেকে নিয়মিত আনা-নেওয়া করেছেন ফিরোজা বেগম। সন্তানের এক বছর নয় মাস বয়স থেকে ফিরোজা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। ফলোআপে থাকতে হবে আরও কয়েক বছর। বর্তমানে ছেলের বয়স তিন বছর তিন মাস। এই মায়ের চোখেমুখে ক্লান্তি নেই। একগাল হেসে বলেন, ছেলে প্রায় পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে। এখন অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই হাঁটতে পারে।
গতকাল ওয়াক ফর লাইফের দেশীয় পরিচালক কলিন ম্যাফারলেন ও তাঁর কর্মীবাহিনীর তৎপরতা দেখে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কে এইচ আবদুল আউয়াল রিজভী একপর্যায়ে কর্মীবাহিনীর এই কর্মতৎপরতার রহস্যটি কী তা না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারলেন না। সংগঠনের ব্যবস্থাপক (ডোনার রিলেশনস) কাজী প্রিয়াঙ্কা সিলমী বলেন, ‘কাজের ফলাফল দৃশ্যমান। যে হাঁটতে পারত না বা পারবে না বলে ধরে নেওয়া হতো, সেই শিশু চোখের সামনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাবা-মায়ের মুখে হাসির ঝিলিক দেখলে কাজ করতে এমনিতেই মন চায়।’
মানসুরা হোসাইন
এই মায়েরা হাসপাতালটিতে এসেছিলেন দি গ্লেনকো ফাউন্ডেশনের ওয়াক ফর লাইফ পরিচালিত ক্লিনিকে। হাসপাতালের নিচতলায় এ ক্লিনিকে সপ্তাহে দুই দিন মুগুর পায়ের শিশুদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। গতকাল ক্লিনিকে আসা মা ও শিশুদের দেখতে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জাস্টিন লি। অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার গত বছর ওয়াক ফর লাইফের আওতায় আসা আড়াই শ শিশুর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিল। হাইকমিশনার ও কমিশনের কর্মকর্তারা দেখতে এসেছিলেন কার্যক্রমের অগ্রগতি। মুগুর পায়ের শিশুদের আগের ছবি আর গতকাল ক্লিনিকের ভেতরে হেঁটে বেড়ানো, মায়েদের মুখের হাসি দেখে হাইকমিশনারের মুখেও খুশির ঝিলিক লাগে।
দেশে এই ধরনের শিশুর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। প্রতিবছর পাঁচ হাজার শিশু জন্মগতভাবে মুগুর পা নিয়ে জন্মায় বলে ধারণা করা হয়। কম বয়সে চিকিৎসা না করালে তা জটিল হয়। একসময় শিশুটি পুরোপুরি প্রতিবন্ধী হয়ে যায়।
দেশে ২০০৯ সাল থেকে কাজ করা ওয়াক ফর লাইফ গত বছর সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালে মোট ৩৬টি ক্লিনিকের মাধ্যমে পনসেটি মেথডের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে।
সংগঠনের কর্মকর্তারা জানালেন, ১৯৫০-এর দশকে ইগনাকিও পনসেটি নামের একজন চিকিৎসক মেথডটি শুরু করেছিলেন। এ পদ্ধতিতে তিন মাস পর্যন্ত প্রতিদিন অন্তত ২৩ ঘণ্টা শিশুকে বিশেষ জুতা পরিয়ে রাখতে হয়। এরপর পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে সর্বনিম্ন ১২ ঘণ্টা জুতা পরিয়ে রাখতে হয়। যশোরে তৈরি এই বিশেষ জুতাও শিশুদের বিনামূল্যে দিচ্ছে সংগঠনটি। এ পদ্ধতিতে জটিল অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না।
সংগঠনটির দাবি, ২০১০ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ছয় হাজার ৬৯টি মুগুর পা (কোনো শিশুর এক পায়ে, আবার কারও দুই পায়েই হতে পারে) ভালো করতে পেরেছে। তিন বছর বয়সের কম বয়েসী শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছে সংগঠনটি।
বংশগত কারণের পাশাপাশি জমজ শিশুর ক্ষেত্রে মায়ের পেটে জায়গাস্বল্পতায় যেকোনো একজনের বেলায় এ সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সবাই জানান।
কারণ যা-ই হোক না কেন, সন্তানের এ ধরনের সমস্যার পেছনে মায়ের কোনো না কোনো দোষ আছে বলেই এখনো অনেকের ধারণা।
নরসিংদীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মা বলেন, ‘চন্দ্রগ্রহণের সময় এইচএসসি পরীক্ষা ছিল। এ ছাড়া আমি গর্ভবতী—তাও বুঝতে পারিনি। বাইরে গেছি, বাঁকা হয়ে বসে পরীক্ষা দিয়েছি, তাই ছেলের দুই পা এমন হয়েছে বলে শুনতে শুনতে ক্লান্ত।’
একজন মা অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করেই বললেন, ‘জানি, আমার দোষ না, কিন্তু পরের বাড়িতে থেকে প্রতিবাদ করারও সাহস নাই।’
জুরাইনের একজন জানান, দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া মেয়ের পায়ের এ সমস্যাটি গোপন রাখা হয়েছে মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করে।
বিক্রমপুরের ফারহানার জমজ সন্তানের মধ্যে একজনের পায়ে সমস্যা। ফারহানার বোনের ও স্বামীর পরিবারেও একজনের আছে সমস্যাটি। ফলে ফাহিমাকে অন্যদের চেয়ে কিছুটা কম কথা শুনতে হয়েছে।
তবে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাচ্ছে। হাসপাতালে ভাইয়ের বউ ও ৪০ দিন বয়েসী ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে আসা সাইফুননাহার বলেন, ‘আল্লায় দিছে, ভাইয়ের বউয়ের বা আমাদের করার কিছু নাই।’
ওয়াক ফর লাইফের ঢাকা বিভাগের তিনটি ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা ফিজিওথেরাপিস্ট সাকিনা সুলতানা বলেন, শতভাগ শিশুই ভালো হয় বা হবে। তবে ক্লিনিকে আনতে দেরি করা যাবে না। বাবা-মাকে নিয়ম মানতে হবে। ক্লিনিক থেকে দেওয়া বিশেষ জুতা (ব্রেস) নিয়মমতো পরাতে হবে।
নোয়াখালি থেকে রাজধানী—ছেলেকে নিয়মিত আনা-নেওয়া করেছেন ফিরোজা বেগম। সন্তানের এক বছর নয় মাস বয়স থেকে ফিরোজা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। ফলোআপে থাকতে হবে আরও কয়েক বছর। বর্তমানে ছেলের বয়স তিন বছর তিন মাস। এই মায়ের চোখেমুখে ক্লান্তি নেই। একগাল হেসে বলেন, ছেলে প্রায় পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে। এখন অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই হাঁটতে পারে।
গতকাল ওয়াক ফর লাইফের দেশীয় পরিচালক কলিন ম্যাফারলেন ও তাঁর কর্মীবাহিনীর তৎপরতা দেখে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কে এইচ আবদুল আউয়াল রিজভী একপর্যায়ে কর্মীবাহিনীর এই কর্মতৎপরতার রহস্যটি কী তা না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারলেন না। সংগঠনের ব্যবস্থাপক (ডোনার রিলেশনস) কাজী প্রিয়াঙ্কা সিলমী বলেন, ‘কাজের ফলাফল দৃশ্যমান। যে হাঁটতে পারত না বা পারবে না বলে ধরে নেওয়া হতো, সেই শিশু চোখের সামনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাবা-মায়ের মুখে হাসির ঝিলিক দেখলে কাজ করতে এমনিতেই মন চায়।’
মানসুরা হোসাইন
No comments