আমার যন্ত্রণা আমার আনন্দ ও বিজয় by ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

বুকের মধ্যে যখন '৭১-এর উত্তাল যন্ত্রণার ঢেউ আছড়ে পড়ছিল, কখনও সবার আড়ালে নিজের একান্ত প্রান্তে এসে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছি। খুঁজে ফিরেছি সামাজিকভাবে আমার বারবার অসম্মানিত হওয়ার সঠিক কারণগুলো। উত্তর সহজেই মিলেছিল। স্বাধীনতার মহান মুক্তিযুদ্ধের আমি পলে পলে সাক্ষী। নয়টি মাসের কলঙ্ক মুছে ফেলে আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।


অসাড় সমাজকে প্রবল আঘাতে প্রত্যাখ্যান করে মহান স্বাধীনতার মূল্যবোধে নির্মাণ করতে সচেষ্ট ছিলাম। শপথ নিলাম 'সকল গর্ব দূর করি দিনু/ তোমার গর্ব ছাড়িব না।' নিজেকে নিজের বন্ধুরূপে, ১৯৭১-এর নির্যাতনের যন্ত্রণাগুলোকে ভুলে যেতে চেষ্টা করি। আমার সৃজনে সান্ত্বনা, মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত চেতনা আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। সেদিনের উত্তাল ফাল্গুন যেন আর কখনোই আমার আপন হলো না। পৃথিবীর আকাশে-বাতাসে যেন ধ্বংসের পরোয়ানা। একদিন গাইতাম_ 'সেকি আমায় নিবে চিনে/এই নব ফাল্গুনের দিনে।' সেই কবিতাময় বসন্ত বাতাস আমাকে শঙ্কিত করে তোলে। শক্তিধর করে কখনও-বা। ১৯৯৪ সালের শেষভাগে অসুস্থ হয়ে ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হলাম। মেডিসিন বিভাগের তরুণ ডাক্তার আলী আরশাদ সুইট আমার History নিতে নিতে প্রশ্ন করেন, আমার আর কোনো না বলা তথ্য আছে কিনা; চিকিৎসার সুবিধার্থে যা আমি আপত্তি না থাকলে নিঃসংকোচে বলতে পারি। আমার বুকের ভেতর তোলপাড় হতে শুরু করল। '৭১-এর নয় মাসের সাক্ষীরূপে আমার তো নিদারুণ অভিজ্ঞতা, যা আমি চিৎকার করে জানাতে চাই। আমি প্রত্যাখ্যাত নিভৃত সমাজের নির্জনতম মানুষ। তাই সবকিছু আড়াল করে উত্তর দিলাম, 'ডাক্তার সাহেব, আমি ঠিক আছি। আমার সংসার জীবন সুস্থ।' তবু সেদিন বলা হয়নি।
আবারও ভাবতে শুরু করি। '৭১-এর এত বড় নির্যাতনের বোঝা কোথাও নামাতে চাই। কে সেই পরম জন, যার কাছে প্রাণ খুলে তুলে ধরব আমার সেই কালিমাখা কান্নাগুলোর কথা! বুকের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের গর্ব। জীবনব্যাপী কলঙ্কধারার গান। জীবনপথের কোন সড়কে দাঁড়াতে হবে আমাকে। ইতিমধ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ড. হামিদা হোসেন, লেখিকা শাহীন আখতার_ অনেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে শুরু করেছে। কোনো এক পর্যায়ে সুযোগ হলো '৭১-এর সেই দুর্যোগের কথা বলার। লেখিকা শাহীন আখতারের কাছে 'ওরাল হিস্ট্রি' হিসেবে বলতে শুরু করি। ইতিমধ্যে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, লেখক; একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির অত্যন্ত আন্তরিকভাবে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই মর্মান্তিক দিনগুলোর জবানবন্দি নিতে শুরু করেন। তার 'একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি' বইতে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার বিজয়গাথা ও অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে। বইটিতে আমার যন্ত্রণাগুলোও লিপিবদ্ধ হয়েছে। বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে নির্মূল কমিটি আমাকেসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা যাদের নির্যাতনের কথা তিনি তার বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন; সবাইকে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ১৯৯১ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় জাদুঘরের মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান হয়। নির্মূল কমিটির এই সম্মাননা আমাকে নতুন করে জীবনবোধে অনুপ্রাণিত করেছে। এই সম্মাননা অনুষ্ঠানের উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বহু বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীসহ আরও অনেকে। মন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, সাংসদ, সাংবাদিক, তরুণ সমাজ_ সবাই সেদিন উপস্থিত থেকে আমাদের সম্মান জানিয়েছিলেন। 'নির্মূল কমিটির' এই মহতী উদ্যোগ আমি চিরকৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। সেই থেকে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে আমি দৃঢ় পদক্ষেপে কাজ করে চলেছি।
২০০০ সালে জাপানের টোকিও শহরে Criminals Tribunal for Violence against Woman’ -এর একটি বিশাল সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সঙ্গে মহামিলন ঘটে। এদের মধ্যে এক কোরিয়ান প্রবীণ মহিলার সঙ্গে আমার পরম বন্ধুত্ব হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নির্যাতনের শিকার ৮৫ বছরের এই কোরিয়ান মহিলা বাগানের মালির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ফিরে আসার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। যুদ্ধের তাণ্ডবলীলার ইতিহাস, বিশেষ করে নারীদের ওপর সহিংসতার ভাষা সর্বত্র একই। একই ঘটনা। আমি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে '৭১ সালের যুদ্ধে নারীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের বিষয়টি বিশদভাবে বর্ণনা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি জানিয়েছি। বিশাল ক্যানভাসে যুদ্ধের নির্যাতনের শিকার প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ বর্ণমালায় সই করেছিলেন। আমিও বাংলায় সই করে যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি জানিয়ে এসেছিলাম। সেদিন গর্বের অন্ত ছিল না। এরপর থেকে নির্মূল কমিটির সহ-সভানেত্রী পদে দায়িত্ব পালন করে চলেছি। এখন '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমি মনে করি, নির্মূল কমিটির আপসহীন আন্দোলনের কারণেই এই বিচার সম্ভব হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও ৭১টি সংগঠন, যার পুরোভাগে রয়েছে 'নির্মূল কমিটি'।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অজস্র কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি অংশগ্রহণ করে উপলব্ধি করেছি, সভ্যতার বোধ ও মানবতা অর্জনের চলমান সংগ্রামের লক্ষ্যে হাজার বছর ধরে আমরা পথ চলব। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় নির্মূল কমিটির অন্যান্য নেতার সঙ্গে আমি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় নির্বাচনী প্রচার ও পর্যবেক্ষণ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দলটির পক্ষে 'নির্মূল কমিটি'র সদস্যরা অবস্থান নিয়েছিলেন। বিশেষভাবে বিগত নির্বাচনে এ দেশের তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য নির্মূল কমিটির আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। নির্মূল কমিটির ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাদের শপথ হবে _ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা। গোলাম আযমের গ্রেফতারের দিনটি আমার কাছে বিজয় দিবসের মতো মনে হয়েছে। মানবতা অর্জনের লক্ষ্যে আমরা সবাই এক হবো। একসঙ্গে পথ চলবো_
এই শুভ কামনায়।

No comments

Powered by Blogger.