জিএম হাটের বিজয় মেলা জাতীয় রাজনীতিতে দৃষ্টান্ত হতে পারে by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

কিছুদিন আগে বন্ধু মহিউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর গ্রামের বাড়ি নুরপুরে গিয়েছিলাম। এটি ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার অন্তর্গত। ইউনিয়নের নাম জিএম হাট। জিএম হাট হাই স্কুলের পক্ষব্যাপী অনুষ্ঠিত বিজয় মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে মহিউদ্দিন বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম। মহিউদ্দিন সাবেক সচিব। পাকিস্তানের অন্যতম এলিট সার্ভিস পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের সদস্য।


১৯৭১ সালে লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং লন্ডনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি এবং পরবর্তী সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে দেশের জন্য কূটনীতিক লড়াই চালিয়ে যান। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। আমরা মানে আমিনুল ইসলাম বেদু ও আমি। বেদু কর্মজীবনে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। জিএম হাট মানে গঙ্গাধর মজুমদার হাট। এখানে অবস্থিত হাই স্কুলটি ১৯২৬ সালে মাইনর হাই স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকে এটি হাই স্কুলে উন্নীত হয়। যদিও জিএম বাবুর নামে বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। কেননা তাঁরই সম্পদ দ্বারা করা হয়েছে, তবে তখন তিনি বেঁচে ছিলেন না, তাঁর উত্তরসূরিরা এগিয়ে এসেছিল। মহিউদ্দিনের বাবা মরহুম আবদুর রশিদ মাইনর হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করে গেছেন। তিনি এলাকায় রশিদ মাস্টার নামে পরিচিত। মহিউদ্দিন এই বিদ্যালয়ে প্রাথমিক অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করছেন। তিনি রাজনীতি করেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক। গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে প্রস্তাব রেখেছিলেন যে প্রতিবছর বিজয় দিবস উপলক্ষে গ্রামাঞ্চলে বিজয় মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে বিজয়ের মাসে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মেলা অনুষ্ঠিত হতো। সেখানে সার্কাস ও যাত্রা গানেরও আয়োজন থাকত। এখন এসবের প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে। সে জন্য মহিউদ্দিনের প্রস্তাব ছিল যে বিজয় দিবস উপলক্ষে আবার চালু করা যেতে পারে মেলা। জিএম হাট হাই স্কুল যথারীতি তা চালু করেছে। আর সে জন্য মেলা কর্তৃপক্ষ তাঁকে সমাপনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আর আমরাও সেই সুযোগে রাজধানীর অসহনীয় যানজটের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে দুই দিনের জন্য ফেনীর একটি অঞ্চল ঘুরে আসি। ফেনী জেলা সদর দপ্তর থেকে জিএম হাট হাই স্কুলটি বেশি দূরে নয়। পাকা সড়ক। মেলাটি বেশ বড়ই ছিল। অনেক স্টল। একটি সার্কাস পার্টিও ছিল। এর অন্যতম আকর্ষণ মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল পরিচালনা। সন্ধ্যার পর সমাপনী অনুষ্ঠান। শীতকে উপেক্ষা করে প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছে। জাফর ইমাম মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে যা বললেন তাতে ফেনীবাসীর গর্বিত হওয়ার কথা। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবার অহংকার।
ফেনীর বিলোনিয়াতে মিত্রবাহিনী অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারতের মিলিত বাহিনী এবং পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই হয়। এই যুদ্ধের কাহিনী বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে সামরিক একাডেমীতে পড়ানো হয়। অতএব, এর গুরুত্ব কতটা তা সহজেই অনুমেয়। কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি যথাযথ স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তিনি মুখে বলেননি বটে; তবে তিনি যখন বক্তৃতা করছিলেন তখন তাঁর চোখ-মুখে গর্বের রশ্মি ফুটে উঠছিল, আর সেটাই স্বাভাবিক। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস থেকে তিনি কখনো সরে যাবেন না। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকবে। সবাই এক দল করবে এমন কথা নয়। কিন্তু তাই বলে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য পাল্টে যাবে, এমন তো হতে পারে না। বাবার নাম কি পরিবর্তন করা যায়? ফেনীবাসীর আরো একটি গর্ব শোভাপুর ব্রিজের দখল নিয়ে লড়াই। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে বেশ কয়েকবার এই যুদ্ধের কথা শুনেছি। এই সমাপনী সভায় মহিউদ্দিন তো বটেই; আমরা দুই বন্ধুও কিঞ্চিৎ বক্তব্য দিয়েছিলাম।
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উত্তরীয় বিতরণ করা হয়। আমরাও পেয়েছি। এই অনুষ্ঠানের যেটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য তা হলো, একই মঞ্চে তিনটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএনপির। তাঁর স্ত্রী শিরিন আক্তার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের। এ মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না। স্থানীয় একজন জাতীয় পার্টির নেতাও মঞ্চে ছিলেন। সত্যিকার অর্থে এটি একটি বিজয় মেলা ছিল। কেননা, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় তো কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়। ৯টি মাস দেশের আপামর জনসাধারণ অকথ্য নির্যাতন সয়েছে পাকিস্তানিদের। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে, সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণ করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের সাহায্য করেছে, পথ দেখিয়ে এনেছে এ দেশি কিছু দোসর, যাদের কারো কারো এত দিন পর বিচার শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করেছে বাংলার কৃষক, শ্রমিক এবং সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ।
পাকিস্তানি বাহিনী জানত যে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন সফল হয়েছে কাদের জন্য। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে যখন পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তারা ধানমণ্ডি, গুলশান বনানীর অভিজাত এলাকা জ্বালিয়ে দেয়নি। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছিল বস্তিবাসীদের। বেইলি রোড, মিন্টু রোডের বাসিন্দারা কাগজে-কলমে অসহযোগ আন্দোলনে সমর্থন জানালেও পাকিস্তানি শাসকরা জানত যে তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে না। তাই তো মুক্তিযুদ্ধের সময় এক মাস সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক এ কে সামসুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছিলেন, ইতিমধ্যে সব রাজনীতিক সিরাজগঞ্জ ছেড়ে গেছেন। সর্বশেষ যখন সিরাজগঞ্জ ত্যাগ করেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন এসডি, পিও, ওসি ও আমি। তাঁকে তৎকালীন চিফ সেক্রেটারি শফিউল আযম পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন। আত্মসমর্পণের পর অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে পাকিস্তানিরা সামসুদ্দিনকে হত্যা করে। ফিরে আসি সমাপনী অনুষ্ঠানে। যদিও সমাপনী বক্তৃতায় সবারই আরো একটু সংযত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কেননা, এ ধরনের সমাবেশে কট্টর পার্টি লাইনে বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়, তার পরও যেটা লক্ষণীয় তা হলো, মেলাটি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে যে বিভাজনের রাজনীতি চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটি খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কেননা, আজ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরের প্রতি যে ধরনের মানসিকতা তথা আচরণ প্রদর্শন করছে, তাতে আমার ষাটের দশকের সাইপ্রাসের কথা মনে হয়। তখনো সাইপ্রাস ভাগ হয়ে দুটি রাষ্ট্র হয়নি। গ্রিক সাইপ্রট এবং তুর্কি সাইপ্রটদের ভেতর তীব্র কলহ। গ্রিক সাইপ্রটরা খেত কোকা-কোলা, আর তুর্কিরা খেত পেপসি-কোলা। আমাদের তো অরিজিন নিয়ে সমস্যা নেই। লক্ষ্য তো আমাদের একটাই, তা হলো বাংলাদেশের উন্নতি। আমাদের ভাষা, কৃষ্টি-ঐতিহ্য সবই তো একটা। লক্ষ্যে পেঁৗছার পথ হয়তো আলাদা। সেখানে যার যার পথে চলবেন, কলহের তো কোনো কারণ নেই। তবে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বা কুৎসা ছড়ানোর কোনো প্রয়োজন আছে কি? চূড়ান্ত রায় তো জনগণ দেবে। বরং বৃহত্তর কোনো ইস্যুতে সবাই এক হতে পারে। যেমনটি ঘটেছে জিএম হাট হাই স্কুলের বিজয় মেলায়।
অনুষ্ঠান শেষে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের সভাকক্ষে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরিষদ ভবনটি বেশ বড়। আহার সামগ্রীর ভেতর একটি আইটেমের নাম খোলাঝা পিঠা। এটা বোধ হয় এ অঞ্চলের। আমি উত্তরবঙ্গের। এর আগে আমি এ পিঠা দেখিনি। এর ব্যবস্থা করেছিলেন উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শিরিন আক্তার। মহিউদ্দিনের বাড়িতে রাত যাপন করি। পরদিন আমরা বিলোনিয়া স্থলবন্দরে বেড়াতে যাই। স্থলবন্দর বলতে একটি ছোট ভবন, যেখানে কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশনের কাজ হয়। আর রয়েছে বর্ডার গার্ডের ক্যাম্প। কোনো ওয়ারহাউস দেখলাম না। মহিউদ্দিনের পরিচয়ের সুবাদে বর্ডার গার্ডের লোকজন আমাদের এলাকাটা দেখালেন। আঙুলের ইশারায় দেখালেন দূরের সেই এলাকা, যার পরিমাণ ৯২ দশমিক ৮৭ একর। এটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। বিলোনিয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার নির্বাচনী এলাকায় অন্তর্ভুক্ত।
১৯৭১ সালে দিনাজপুর জেলার হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলাম। একটা ভূমি, একটা পরিবেশ, একটা ভাষার মানুষ, কেবল পিলার বলে দেয় দুটি ভিন্ন দেশ। এই উপমহাদেশে কোনো দিন এলাকাভিত্তিক জাতির বসতি ছিল না। যেমন অমুক জেলা শুধু হিন্দু বা মুসলমানের জন্য। আমার নিজ গ্রামের পেছনের বাড়িই ছিল হিন্দুদের বসতি। ঘটনাচক্রে কোনো কোনো অঞ্চলে বৃহত্তর আঙ্গিক যথা প্রদেশে একটি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক যুগ যুগ ধরে বাস করে আসছে। ভারতের উত্তর প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বেশ এগিয়েছিল অনেক পরিবার। বেশ আগের কথা। পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন একজন মুসলমান। উত্তর প্রদেশের। তিনি ভারতের পক্ষে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। চুক্তিতে পাকিস্তানের পক্ষে যে আমলা সই করেছিলেন তিনি হাইকমিশনারের খালাতো ভাই। ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিক মওলানা আজাদ যথার্থ বলেছিলেন, পাকিস্তান হলে উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের মুসলমানদের কী লাভ? এই দুই প্রদেশে বেশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলমান সম্প্রদায়ের বসবাস। ব্রিটিশের কূটচাল এবং উপমহাদেশের রাজনীতিকদের ব্যর্থতায় এমনভাবে উপমহাদেশ ভাগ হলো যে ভয়াবহ দাঙ্গায় লাখ লাখ প্রাণ গেল, অগণিত নারী তাঁদের সম্ভ্রম হারালেন। অদ্ভুত ঘটনা। রাতে শোবার সময় যেটাকে জানত নিজ আবাসভূমি, পরের দিন সেটি হলো পরভূমি। অথচ যুগ যুগ ধরে পূর্বপুরুষের বসতভিটা এটি। মহাত্মা গান্ধীর পৌত্র রামমোহন গান্ধীর একটি বইতে দাঙ্গার কারণ বর্ণিত হয়েছে। আগের দিন রাতে যে পরিবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে, পরের দিন সূর্যাস্তের আগে সব সদস্য নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে। এই বিভাজনের ফলে চিরদিনের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হলো। বহু ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য আছে, কিন্তু পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। বিলোনিয়া থেকে ফেরার পথে মহাত্মা গান্ধী ট্রাস্টের অফিসে বসেছিলাম। ১৯৭১ সালে এই ট্রাস্টের জমি বেহাত হয়ে যায়। এখনো সব জমি উদ্ধার করা যায়নি। ৪০ বছরে একটি মানুষও জোটেনি তিনি আমলা হোক বা রাজনীতিক হোক, ট্রাস্টের জমি উদ্ধার করে তা একটি মহৎ কাজে লাগাবেন। কোনো মন্তব্যের প্রয়োজন আছে কি?

লেখক : সাবেক ইপিএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.