টমাস ট্রান্সট্রোমার-আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত by আজীজ রহমান
দেয়াল ভেদ করে গেলে প্রতিটি মানুষ আহত ও রক্তাক্ত হয়, কিন্তু আমাদের কোনো গত্যন্তর নাই। বিশ্বের সর্বত্র তা-ই। দেয়ালের মুখোমুখি আমরা সবাই। জানি বা না জানি আমরা সবাই। তুমি আমি আমরা সবাই দেয়ালের গায়ে একাকার হয়ে যাই। শিশুরাই শুধু ব্যতিক্রম, তাদের সামনে কোনো দেয়াল নাই। উন্মুক্ত আকাশ বসে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে।
যেন প্রার্থনায় মগ্ন এক মহাশূন্যতায়। আর এই মহাশূন্যতায় কে যেন আমাদের চোখে চোখ রেখে বলে যায়, আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত। (ভারমিয়ার, জীবিত ও মৃতদের জন্য, ১৯৭৯) সুইডেনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম টমাস ট্রান্সট্রোমার ২০১১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। যদিও ১৯৯৩ সালে প্রথম মনোনীত হওয়ার পর থেকে দেশে-বিদেশে তাঁর অগণিত পাঠক, ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী প্রতিটি বছর অক্টোবরের প্রথমার্ধে একটি ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে এবং প্রতিবছরই হতাশ হয়। এ বছর ৬ অক্টোবর বিকেলে সুইডিশ একাডেমীর ঘোষণাটি ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে সারা সুইডেন। বাংলাদেশের তিন গুণ আকারের দেশের সাড়ে আট মিলিয়ন মানুষের জন্য এ ছিল বিরাট এক প্রাপ্তি। ইতিমধ্যে ৬০টিরও বেশি ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদের মাধ্যমে পেঁৗছে যাওয়ার ফলে সারা বিশ্বে যে বিশাল ভক্তগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, তাদের মধ্যেও লেগেছে আনন্দের ঢেউ। স্টকহোমে কবির বাড়ির সামনে কিছুক্ষণের মধ্যে মানুষের ঢল নামে। সুইডেনের রাস্তায় পুলিশ দেখতে পাওয়া একটি বিরল ঘটনা। সেদিন পুলিশের আবির্ভাব হয় ট্রাফিক ও দশনার্থীদের ভিড় সামলাতে। কবি ও তাঁর স্ত্রী মনিকা মাত্র কিছুক্ষণ আগে জানতে পারেন সুইডিশ একাডেমী থেকে আসা একটি টেলিফোন কলের মাধ্যমে। যে টেলিফোন আসার কথা ছিল আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে, তা এসে গেল অবশেষে ৬ অক্টোবর। ৮০ বছর বয়সে অসুস্থ শরীরে ট্রান্সট্রোমার দেয়াল ভাঙলেন, উন্মুক্ত হলেন সত্যিকার অর্থে। ১৯৭৪ সালে লেখা 'ভারমিয়ার' কবিতায় তিনি দেয়াল ভাঙার কথা বলেছিলেন। নির্মম এই দেয়ালের নিষ্পেষণে আজ যখন বিশ্বমানবতা নিদারুণভাবে নিপীড়িত, এ সময় ট্রান্সট্রোমারের কাছে আমরা সবাই নিতে পারি দেয়াল ভাঙার দীক্ষা। দেয়ালঘেরা ট্রান্সট্রোমার এক অসীম মহাশূন্যতার মধ্যে তাঁর অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন, কিন্তু প্রমাণ করেছেন, 'আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত'।
টমাস ট্রান্সট্রোমার বাংলাদেশের মতোই কবিতার দেশ সুইডেনের সমসাময়িক কবিদের মধ্যে বহির্বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত ও সর্বজননন্দিত কবি। তিনি নিসর্গ ও নির্জনতার কবি। তাঁর কাব্যরুচি, বাণী ও ভঙ্গির সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের একটা সূক্ষ্ম অথচ অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষণীয়, যদিও দুজন দুই সময়ের দুই প্রান্তের অধিবাসী। ১৯৩১ সালে স্টকহোমে জন্মগ্রহণকারী কবির বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। কবির বাল্যকালেই তাঁর মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। ট্রান্সট্রোমার স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পেশায় একজন মনস্তাত্তি্বক, স্টকহোম থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ভেস্তারস শহরে একটি যুবকল্যাণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯০ সালে পক্ষাঘাতের ফলে তাঁর শরীরের ও মস্তিষ্কের ডান অংশ অবশ হয়ে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই অবস্থাকে বলা হয় 'আফাসিয়া'। তিনি বর্তমানে বাকশক্তিরহিত। সংবেদনশীল স্ত্রী মনিকা তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও মুখপাত্র। পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল সংগীতের একনিষ্ঠ শ্রোতা ও কম্পোজার ট্রান্সট্রোমার একজন দক্ষ পিয়ানোবাদকও বটে। এখন তিনি এক হাতেই করতে পারেন তাঁর নির্জন আবাসে সুগভীর মেলোডির সুরবিস্তার। দুর্ভাগ্যবশত পাশ্চাত্য সংগীতের যে আরেক বৈশিষ্ট্য হারমোনি, তাতে তিনি আর অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৫২ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে '১৭টি কবিতা'র বইটি প্রকাশের মাধ্যমে কবি হিসেবে টমাসের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বইটির প্রথম সংস্করণ রাতারাতি নিঃশেষ হয়ে যায় আর তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কাব্যানুরাগী মহলে জনপ্রিয় হয়ে যান। ট্রান্সট্রোমার লেখেন কম, কিন্তু অনেকটা জীবনানন্দীয় ঠাসবুনন স্টাইলে স্বল্প পরিসরে বলেন অনেক বেশি, যা পেঁৗছে যায় পাঠকের মনের গভীরে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ১১। তা ছাড়া লিখেছেন একটি আত্মকাহিনী। উল্লেখযোগ্য কবিতা সংকলনগুলোর মধ্যে রয়েছে 'গোপন কথাটি' (১৯৫৪), 'অর্ধসমাপ্ত স্বর্গ' (১৯৬২), 'ঘণ্টা ও রেললাইন' (১৯৬৯), 'অন্ধকারে দেখা' (১৯৭০), 'পূর্ব সাগর' (১৯৭৩), 'সত্যের সীমানা' (১৯৭৮), 'জীবিত ও মৃতদের জন্য' (১৯৯০) ও 'বিষণ্ন গন্ডোলা' (১৯৯৬)। তাঁর কবিতা দুজন প্রখ্যাত কবি_রবার্ট ব্লাই ও রবিন ফুল্টন ইংরেজিতে এবং নেদারল্যান্ডসের জে. বার্নলেফের হাতে ডাচ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। দেশে-বিদেশে তাঁর কবিতার মূল্যায়নসংক্রান্ত অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ইতিমধ্যে বহু আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ভেস্তারস সাংস্কৃতিক পরিষদ থেকে লেনার্ট কার্লস্ট্যামের সম্পাদনায় ট্রান্সট্রোমারের লেখা বই ও তাঁর কাজ সম্পর্কে লেখা বইপুস্তক ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ তালিকাভুক্ত করে প্রকাশ করা হয়েছে ৩৩২ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থপঞ্জি।
ট্রান্সট্রোমারের অন্বেষা শব্দ নয়, বাক্য নয়; তিনি চান ভাষা, সম্পূর্ণ, অর্থপূর্ণ ও বক্তব্যপূর্ণ ভাষা। মানুষের দৈনন্দিন মুখের কথায় তিনি কেবল শোনেন শব্দ আর শব্দ। সেখানে ভাষার অভাব, তাই তিনি ছুটে যান প্রকৃতির কাছে, প্রকৃতির অকৃত্রিম সন্তানের কাছে। সেখানেই খুঁজে পান সত্যিকার বোধগম্য ভাষা।
যারা শুধু কথা কয়, ভাষা নয় এবং তা বোধগম্য নয়
তাদের বাকসর্বস্বতায় ক্লান্ত হয়ে শেষে আমাকে যেতে হয় তুষারাচ্ছন্ন দ্বীপে।
প্রকৃতির কোনো শব্দভাণ্ডার বা অভিধান নাই,
অলিখিত পৃষ্ঠা সে ছড়িয়ে দেয় সব দিকে।
বরফের উপর দেখি বুনো হরিণীর পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে
তাতে যদিও শব্দ নাই ভাষা আছে।
(মার্চ ১৯৭৯, অদ্ভুত বাজার প্রাঙ্গণ, ১৯৮৩)
ট্রান্সট্রোমার লেখেন কম, কিন্তু বলেন, 'লাইনের ভেতরে পড়ো', তাঁর নিজস্ব ঠাসবুনন স্টাইলে, প্রধানত চিত্রকল্পের মায়াজাল সৃষ্টি করে। সুইডিশ একাডেমীর ঘোষণায় বলা হয়েছে, ট্রান্সট্রোমার তাঁর ঘনীভূত ভাষা ও স্বকল্পিত রূপকল্পের মাধ্যমে নিসর্গ এও মানবতার বর্তমান তথা চিরন্তন সত্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। সব মহৎ শিল্পকর্মেরই ধর্ম এই যে এর মধ্যে পাঠক, শ্রোতা বা দর্শকের একটা ভূমিকা থাকে। এই কবি চিত্রকল্পের মাধ্যমে একটা আভাস দেন, তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার ভার দেন পাঠককে, যিনি আপন মনের মাধুরী মেশানোর সুযোগ পান। তিনি ভোজসভায় আমন্ত্রণ করেন কিছু অতিথিকে, কিন্তু কিছু আসন খালি রাখেন অনাহূত ও রবাহূতদের জন্য, যাতে কেউ অভুক্ত অবস্থায় ফিরে না যায়। তাঁর লেখা পড়ার পর থেকে মনে হয় 'বৃষ্টির ভিতরে সত্যি সত্যি হেঁটে যাচ্ছে গাছ/তাকে যেতে হবে দূরে বহু দূরে'। আমাদের দেশে যে এত বৃষ্টি হয়, তার ভেতর কি হেঁটে যায় গাছ? আমগাছ, জামগাছ? কী জানি! আসলে গাছ হাঁটে সব দেশে সব কালে। দেখতে পাই না আমরা সাদা চোখে, আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যতক্ষণ না দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন কোনো ট্রান্সট্রোমার বা জীবনানন্দ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।' ট্রান্সটোমার পড়ার পর থেকে নিজের অজান্তেই শুনতে পাই 'অস্তিত্বের ভিতর অবিরাম পাথরপতন'। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে ই-১৮ মহাসড়কে বিকেলে অফিস থেকে ফেরত আসার সময় জটমান ট্রাফিককে মনে হতো, যা এখন ঢাকায় আরো প্রকটভাবে মনে হয়, এ যেন এক শ্লথগতি কিন্তু বিষধর সরীসৃপ, ছোবল দেওয়ার অপেক্ষায় আছে। ড্রয়ার খুলে পুরনো চিঠি দেখলে ভাবি, এত যে টেনশন ভরা এই চিঠি, এর জবাব দিয়েছিলাম তো! চিত্রকল্পের এই অসামান্য রূপকারের সৃষ্টিকে একজন সমালোচক বলেছেন 'চিত্রকল্পসর্বস্ব একজন নির্জন মানুষের স্বপ্নসমৃদ্ধ চিত্রকল্প'। মনে করা হয়, ট্রান্সট্রোমারের কবিতা যতখানি না পঠনীয়, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি কল্পনীয় ও অনুভবনীয়, এমনকি দর্শন দ্বারা তাড়িত।
আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ, বলা যায় ধর্মবিবর্জিত, সুইডেনের নাগরিক ট্রান্সট্রোমারের কবিতার লাইনে, লাইনের ভেতরে ও মার্জিনে যে নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা ও গভীরতার সন্ধান পাওয়া যায়, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে আছে দুটি উৎস থেকে পাওয়া প্রেরণা_সংগীত ও সর্বশক্তিমান। কৈশোর থেকে নিঃসঙ্গতাজনিত কারণে তিনি যে এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলেন এক অদৃশ্য মহাশক্তির কাছে। সেই মহাশক্তির কাছে পেঁৗছানোর জন্য তাঁর মাধ্যম ছিল সংগীত। 'এবং অবশেষে এক অলৌকিক ঐশ্বরিক শক্তি নীলনদের বন্যার মতো আমাকে প্লাবিত করে/বহু যুগের ওপার হতে ভেসে আসে ছন্দে ছন্দে আমার দ্বন্দ্বকে পরাভূত করে/সেই শক্তিমান অসীম অশেষ অদৃশ্য অমর/আমরা তাঁকে দেখেও দেখি না'। আধুনিক রূপকথার কল্যাণ রাষ্ট্রেও তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শঙ্কামুক্ত থাকতে পারেন না। তাঁর মন বিষণ্ন হয়ে যায় যখন ঘন তুষারপাতের মধ্যে অন্ধকার প্রাক-প্রভাতে দেখেন কয়েকটি শিশু স্কুলবাসের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে_'এমন কয়েকটা শিশু যাদের জন্য কেউ প্রার্থনা করে না'। তাই তিনি বলেন, 'গির্জার ভেতরে, পর্যটকের চোখের আড়ালে/আমাদের মনের দারিদ্র্য বসে আছে প্রত্যেক সারিতে/প্রার্থনারত মানুষের দিকে চেয়ে থাকে করুণ দৃষ্টিতে, অদৃশ্য ভিক্ষাপাত্র হাতে'। নিজের অন্তর্নিহিত সংগীতানুরাগ সুইডিশ ভাষার স্বাভাবিক ছন্দোময়তার সঙ্গে একাত্ম করে দিয়ে ট্রান্সট্রোমার তাঁর কাব্যকে করে তুলেছেন সংগীতময়। সংগীত সোপানের রেলিংয়ে হাত রেখে তিনি উঠে যান মহাশূন্যতার মাঝে মহাশক্তির সানি্নধ্যে। চিত্রকল্পের সঙ্গে ধ্বনি ও বাণী একাকার হয়ে তাঁর হাতে সৃষ্টি হয়েছে অনবদ্য কাব্যগীতি। শুবার্টের সিম্ফনি সমুদ্র হতে বিশাল ঢেউ হয়ে উঠে আসে ফ্লোরের ওপর। আজ রাতে তিনি বাজাবেন হাইডেন, পাখির ডানার মতো চঞ্চল হয়ে উঠেছে তাঁর হাতের আঙুল। 'সুরের উত্থান-পতন, তার আবেশ ও রেশ/কখনো কোমল, কখনো চঞ্চল হয়ে পড়ে থাকে সমগ্র পরিবেশ জুড়ে/চিরদিন সেই রেশ আমাদের সহযাত্রী হয়'।
স্টকহোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে কূটনৈতিক পদে যোগদানের পর সহকর্মী আশফাকুর রহমান আমার কবিতানুরাগের কথা জানতেন বলে 'সুইডিশ পোয়েট্রি ইন ট্রান্সলেশন' বইটি উপহার দেন। তাতে অনেক কবির কবিতা ছিল পড়ার মতো। কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে ট্রান্সট্রোমার, যাঁর লেখা আমি বারবার পড়তাম, যাঁর সম্পর্কে আরো জানার আগ্রহে আমি গেলাম স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডিশ ইনস্টিটিউট ও সুইডিশ একাডেমীতে। গেলাম কবি ও কবিপত্নীর সঙ্গে দেখা করতে ভেস্তারস। এই সাক্ষাতে আমার সঙ্গী হয়েছিল আমার স্ত্রী, কন্যা এবং দুই বন্ধু_এবিবির ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী ড. মুরারী মোহন সাহা ও স্টকহোম থেকে প্রকাশিত 'মাসিক পরিক্রমা' পত্রিকার সম্পাদক লিয়াকত হোসেন। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত সাদৃশ্য আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে, আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ট্রান্সট্রোমারের কবিতার বাংলা রূপান্তরের কলেবর। তাঁর কাজ সম্পর্কে বইপত্র সংগ্রহ করি এবং কবিপত্নী ও সুইডেনের বিশিষ্ট কবি এবং কাব্যানুরাগীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি রিভিউ লিখে ফেলি। কবিতার দেশ বাংলাদেশে এই অনন্য কবিকে পরিচিত করার তাগিদ অনুভব করতে থাকি এবং অবশেষে ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ আমার ডিপ্লোমেটিক ট্যুর অব ডিউটির শেষ পর্যায়ে 'শুভ সন্ধ্যা হে সুন্দর গভীরতা : সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমারের নির্বাচিত কবিতা' বইটি প্রকাশ করতে সক্ষম হই। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কবি স্বয়ং ও মনিকা ছাড়াও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নোবেল সাহিত্য কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শেল এস্পমার্ক (নিজেও প্রখ্যাত কবি), উন্নয়ন সহযোগিতা মন্ত্রী পিয়ের শোরি, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জুলিয়েন এবং অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও উপস্থাপক অধ্যাপক অ্যান্ডার্স কুলহেড। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ওলফ পালমের পত্নী সুইডেনের সর্বজনশ্রদ্ধেয় লিজবেথ পালমেসহ সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্কের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমাবেশ অনুষ্ঠানটি সফল এবং আমার প্রচেষ্টা সার্থক করে তুলেছিল। আমার সাক্ষাৎকারসহ ঘটনাটি সুইডেনের সব মিডিয়ায় গুরুত্বসহকারে প্রচার করা হয়। ট্রান্সট্রোমার ১৯৯৩ সাল থেকেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য তালিকাভুক্ত ছিলেন। একই বছর থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। অক্টোবর মাসে বিশিষ্ট সাংবাদিক ইংভার ওজার নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই দুজন নোবেল প্রাইজ না পাওয়ায় আমি গভীর হতাশা প্রকাশ করি। দুজনের জন্যই আমার প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। ইতিমধ্যে 'শুভ সন্ধ্যা হে সুন্দর গভীরতা'র জন্য সেই বছরই আমাকে সুইডিশ কালচার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। আমার পর স্টকহোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব হিসেবে কর্মরত থাকাকালে কবি মোহাম্মদ সাদিক টমাস ও মনিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখেন এবং ট্রান্সট্রোমারের কিছুসংখ্যক কবিতা অনুবাদ করেন।
'শুভ সন্ধ্যা'র প্রথম ঢাকা সংস্করণ পাঠক সমাবেশের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সিরডাপ মিলনায়তনে আরেকটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
সাক্ষাৎকারের সময় আমরা দেখেছি, ট্রান্সট্রোমার আমাদের সব কথাই বোঝেন, কিন্তু জবাব দিতে গিয়ে কথা সম্পূর্ণ করতে পারেন না। তিনি পিয়ানো বাজালেন বাঁ হাতে। অটোগ্রাফও লিখলেন বাঁ হাত দিয়ে। তাঁর এই শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বিবরণ স্পষ্ট হয়েছে 'দুইটি শহর' কবিতায়। মস্তিষ্কের এক অংশ দিয়ে তিনি সৃষ্টি করতে পারেন এমন বিস্ময়কর সুগভীর কবিতা :
নদীর দুই তীরে/দুইটি শহর/একটি নিমজ্জিত অন্ধকারে,/শত্রুর কাছে পরাভূত;/অন্যটি আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত,/এপারের আলোকোজ্জ্বল সৈকত/মোহাবিষ্ট করে রাখে অন্ধকার অন্য পাড়টিকে।
ঘোরের ভিতর আমি সাঁতার কাটি/অন্ধকারে ঝলমল জলের উপর,/লুক্কায়িত বাঁশি ফেটে বিস্ফোরণ ঘটে,/বন্ধুর কণ্ঠস্বর বলে/যাও বন্ধু, যাও তোমার কবরে।
(দুইটি শহর : বিষণ্ন গন্ডোলা, ১৯৯৬)
টমাস ট্রান্সট্রোমার তাঁর কবিতার জগতের মতো যেন সত্যিকার অর্থে এখন বেঁচে আছেন এক গোলকধাঁধায়, স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যবর্তী প্রদেশে, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী করিডরে, শিল্প ও বাস্তাবতার সীমারেখায়। আর তাঁর এই কঠিন অবস্থান থেকে সত্যকে সন্ধান করছেন দুই জগতের মধ্যবর্তী সিংহদ্বারে, সত্যের সীমানায়, যেখানে সদাজাগ্রত প্রহরী যথারীতি প্রবেশাধিকার দেবে একের পর একজন আগন্তুককে। এখানে 'শাণিত তীক্ষ্ন তরবারি নির্মূল করে সব স্মৃতি; মাটিতে পড়ে থাকে বাঁশি আর খাপ, জং ধরে তাতে।' যাত্রাপথে এই অন্তর্বর্তী সময়ে তিনি আবার শুনতে পাচ্ছেন ঘণ্টা বাজছে স্টকহোমের প্রধান গির্জায়, শুনতে পাচ্ছেন কাচের মতো স্পষ্ট দূরাগত সংগীতের স্বর্গীয় সুর। কারা যেন এগিয়ে আসছে প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে তাঁর অভ্যর্থনায়। এগিয়ে আসছে যেন এমন অনেক শিশু, যাদের জন্য কেউ প্রার্থনা করে না। শুভ সন্ধ্যা, হে সুন্দর গভীরতা!
টমাস ট্রান্সট্রোমার বাংলাদেশের মতোই কবিতার দেশ সুইডেনের সমসাময়িক কবিদের মধ্যে বহির্বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত ও সর্বজননন্দিত কবি। তিনি নিসর্গ ও নির্জনতার কবি। তাঁর কাব্যরুচি, বাণী ও ভঙ্গির সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের একটা সূক্ষ্ম অথচ অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষণীয়, যদিও দুজন দুই সময়ের দুই প্রান্তের অধিবাসী। ১৯৩১ সালে স্টকহোমে জন্মগ্রহণকারী কবির বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। কবির বাল্যকালেই তাঁর মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। ট্রান্সট্রোমার স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পেশায় একজন মনস্তাত্তি্বক, স্টকহোম থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ভেস্তারস শহরে একটি যুবকল্যাণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯০ সালে পক্ষাঘাতের ফলে তাঁর শরীরের ও মস্তিষ্কের ডান অংশ অবশ হয়ে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই অবস্থাকে বলা হয় 'আফাসিয়া'। তিনি বর্তমানে বাকশক্তিরহিত। সংবেদনশীল স্ত্রী মনিকা তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও মুখপাত্র। পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল সংগীতের একনিষ্ঠ শ্রোতা ও কম্পোজার ট্রান্সট্রোমার একজন দক্ষ পিয়ানোবাদকও বটে। এখন তিনি এক হাতেই করতে পারেন তাঁর নির্জন আবাসে সুগভীর মেলোডির সুরবিস্তার। দুর্ভাগ্যবশত পাশ্চাত্য সংগীতের যে আরেক বৈশিষ্ট্য হারমোনি, তাতে তিনি আর অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৫২ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে '১৭টি কবিতা'র বইটি প্রকাশের মাধ্যমে কবি হিসেবে টমাসের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বইটির প্রথম সংস্করণ রাতারাতি নিঃশেষ হয়ে যায় আর তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কাব্যানুরাগী মহলে জনপ্রিয় হয়ে যান। ট্রান্সট্রোমার লেখেন কম, কিন্তু অনেকটা জীবনানন্দীয় ঠাসবুনন স্টাইলে স্বল্প পরিসরে বলেন অনেক বেশি, যা পেঁৗছে যায় পাঠকের মনের গভীরে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ১১। তা ছাড়া লিখেছেন একটি আত্মকাহিনী। উল্লেখযোগ্য কবিতা সংকলনগুলোর মধ্যে রয়েছে 'গোপন কথাটি' (১৯৫৪), 'অর্ধসমাপ্ত স্বর্গ' (১৯৬২), 'ঘণ্টা ও রেললাইন' (১৯৬৯), 'অন্ধকারে দেখা' (১৯৭০), 'পূর্ব সাগর' (১৯৭৩), 'সত্যের সীমানা' (১৯৭৮), 'জীবিত ও মৃতদের জন্য' (১৯৯০) ও 'বিষণ্ন গন্ডোলা' (১৯৯৬)। তাঁর কবিতা দুজন প্রখ্যাত কবি_রবার্ট ব্লাই ও রবিন ফুল্টন ইংরেজিতে এবং নেদারল্যান্ডসের জে. বার্নলেফের হাতে ডাচ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। দেশে-বিদেশে তাঁর কবিতার মূল্যায়নসংক্রান্ত অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ইতিমধ্যে বহু আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ভেস্তারস সাংস্কৃতিক পরিষদ থেকে লেনার্ট কার্লস্ট্যামের সম্পাদনায় ট্রান্সট্রোমারের লেখা বই ও তাঁর কাজ সম্পর্কে লেখা বইপুস্তক ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ তালিকাভুক্ত করে প্রকাশ করা হয়েছে ৩৩২ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থপঞ্জি।
ট্রান্সট্রোমারের অন্বেষা শব্দ নয়, বাক্য নয়; তিনি চান ভাষা, সম্পূর্ণ, অর্থপূর্ণ ও বক্তব্যপূর্ণ ভাষা। মানুষের দৈনন্দিন মুখের কথায় তিনি কেবল শোনেন শব্দ আর শব্দ। সেখানে ভাষার অভাব, তাই তিনি ছুটে যান প্রকৃতির কাছে, প্রকৃতির অকৃত্রিম সন্তানের কাছে। সেখানেই খুঁজে পান সত্যিকার বোধগম্য ভাষা।
যারা শুধু কথা কয়, ভাষা নয় এবং তা বোধগম্য নয়
তাদের বাকসর্বস্বতায় ক্লান্ত হয়ে শেষে আমাকে যেতে হয় তুষারাচ্ছন্ন দ্বীপে।
প্রকৃতির কোনো শব্দভাণ্ডার বা অভিধান নাই,
অলিখিত পৃষ্ঠা সে ছড়িয়ে দেয় সব দিকে।
বরফের উপর দেখি বুনো হরিণীর পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে
তাতে যদিও শব্দ নাই ভাষা আছে।
(মার্চ ১৯৭৯, অদ্ভুত বাজার প্রাঙ্গণ, ১৯৮৩)
ট্রান্সট্রোমার লেখেন কম, কিন্তু বলেন, 'লাইনের ভেতরে পড়ো', তাঁর নিজস্ব ঠাসবুনন স্টাইলে, প্রধানত চিত্রকল্পের মায়াজাল সৃষ্টি করে। সুইডিশ একাডেমীর ঘোষণায় বলা হয়েছে, ট্রান্সট্রোমার তাঁর ঘনীভূত ভাষা ও স্বকল্পিত রূপকল্পের মাধ্যমে নিসর্গ এও মানবতার বর্তমান তথা চিরন্তন সত্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। সব মহৎ শিল্পকর্মেরই ধর্ম এই যে এর মধ্যে পাঠক, শ্রোতা বা দর্শকের একটা ভূমিকা থাকে। এই কবি চিত্রকল্পের মাধ্যমে একটা আভাস দেন, তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার ভার দেন পাঠককে, যিনি আপন মনের মাধুরী মেশানোর সুযোগ পান। তিনি ভোজসভায় আমন্ত্রণ করেন কিছু অতিথিকে, কিন্তু কিছু আসন খালি রাখেন অনাহূত ও রবাহূতদের জন্য, যাতে কেউ অভুক্ত অবস্থায় ফিরে না যায়। তাঁর লেখা পড়ার পর থেকে মনে হয় 'বৃষ্টির ভিতরে সত্যি সত্যি হেঁটে যাচ্ছে গাছ/তাকে যেতে হবে দূরে বহু দূরে'। আমাদের দেশে যে এত বৃষ্টি হয়, তার ভেতর কি হেঁটে যায় গাছ? আমগাছ, জামগাছ? কী জানি! আসলে গাছ হাঁটে সব দেশে সব কালে। দেখতে পাই না আমরা সাদা চোখে, আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যতক্ষণ না দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন কোনো ট্রান্সট্রোমার বা জীবনানন্দ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।' ট্রান্সটোমার পড়ার পর থেকে নিজের অজান্তেই শুনতে পাই 'অস্তিত্বের ভিতর অবিরাম পাথরপতন'। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে ই-১৮ মহাসড়কে বিকেলে অফিস থেকে ফেরত আসার সময় জটমান ট্রাফিককে মনে হতো, যা এখন ঢাকায় আরো প্রকটভাবে মনে হয়, এ যেন এক শ্লথগতি কিন্তু বিষধর সরীসৃপ, ছোবল দেওয়ার অপেক্ষায় আছে। ড্রয়ার খুলে পুরনো চিঠি দেখলে ভাবি, এত যে টেনশন ভরা এই চিঠি, এর জবাব দিয়েছিলাম তো! চিত্রকল্পের এই অসামান্য রূপকারের সৃষ্টিকে একজন সমালোচক বলেছেন 'চিত্রকল্পসর্বস্ব একজন নির্জন মানুষের স্বপ্নসমৃদ্ধ চিত্রকল্প'। মনে করা হয়, ট্রান্সট্রোমারের কবিতা যতখানি না পঠনীয়, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি কল্পনীয় ও অনুভবনীয়, এমনকি দর্শন দ্বারা তাড়িত।
আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ, বলা যায় ধর্মবিবর্জিত, সুইডেনের নাগরিক ট্রান্সট্রোমারের কবিতার লাইনে, লাইনের ভেতরে ও মার্জিনে যে নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা ও গভীরতার সন্ধান পাওয়া যায়, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে আছে দুটি উৎস থেকে পাওয়া প্রেরণা_সংগীত ও সর্বশক্তিমান। কৈশোর থেকে নিঃসঙ্গতাজনিত কারণে তিনি যে এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলেন এক অদৃশ্য মহাশক্তির কাছে। সেই মহাশক্তির কাছে পেঁৗছানোর জন্য তাঁর মাধ্যম ছিল সংগীত। 'এবং অবশেষে এক অলৌকিক ঐশ্বরিক শক্তি নীলনদের বন্যার মতো আমাকে প্লাবিত করে/বহু যুগের ওপার হতে ভেসে আসে ছন্দে ছন্দে আমার দ্বন্দ্বকে পরাভূত করে/সেই শক্তিমান অসীম অশেষ অদৃশ্য অমর/আমরা তাঁকে দেখেও দেখি না'। আধুনিক রূপকথার কল্যাণ রাষ্ট্রেও তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শঙ্কামুক্ত থাকতে পারেন না। তাঁর মন বিষণ্ন হয়ে যায় যখন ঘন তুষারপাতের মধ্যে অন্ধকার প্রাক-প্রভাতে দেখেন কয়েকটি শিশু স্কুলবাসের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে_'এমন কয়েকটা শিশু যাদের জন্য কেউ প্রার্থনা করে না'। তাই তিনি বলেন, 'গির্জার ভেতরে, পর্যটকের চোখের আড়ালে/আমাদের মনের দারিদ্র্য বসে আছে প্রত্যেক সারিতে/প্রার্থনারত মানুষের দিকে চেয়ে থাকে করুণ দৃষ্টিতে, অদৃশ্য ভিক্ষাপাত্র হাতে'। নিজের অন্তর্নিহিত সংগীতানুরাগ সুইডিশ ভাষার স্বাভাবিক ছন্দোময়তার সঙ্গে একাত্ম করে দিয়ে ট্রান্সট্রোমার তাঁর কাব্যকে করে তুলেছেন সংগীতময়। সংগীত সোপানের রেলিংয়ে হাত রেখে তিনি উঠে যান মহাশূন্যতার মাঝে মহাশক্তির সানি্নধ্যে। চিত্রকল্পের সঙ্গে ধ্বনি ও বাণী একাকার হয়ে তাঁর হাতে সৃষ্টি হয়েছে অনবদ্য কাব্যগীতি। শুবার্টের সিম্ফনি সমুদ্র হতে বিশাল ঢেউ হয়ে উঠে আসে ফ্লোরের ওপর। আজ রাতে তিনি বাজাবেন হাইডেন, পাখির ডানার মতো চঞ্চল হয়ে উঠেছে তাঁর হাতের আঙুল। 'সুরের উত্থান-পতন, তার আবেশ ও রেশ/কখনো কোমল, কখনো চঞ্চল হয়ে পড়ে থাকে সমগ্র পরিবেশ জুড়ে/চিরদিন সেই রেশ আমাদের সহযাত্রী হয়'।
স্টকহোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে কূটনৈতিক পদে যোগদানের পর সহকর্মী আশফাকুর রহমান আমার কবিতানুরাগের কথা জানতেন বলে 'সুইডিশ পোয়েট্রি ইন ট্রান্সলেশন' বইটি উপহার দেন। তাতে অনেক কবির কবিতা ছিল পড়ার মতো। কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে ট্রান্সট্রোমার, যাঁর লেখা আমি বারবার পড়তাম, যাঁর সম্পর্কে আরো জানার আগ্রহে আমি গেলাম স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডিশ ইনস্টিটিউট ও সুইডিশ একাডেমীতে। গেলাম কবি ও কবিপত্নীর সঙ্গে দেখা করতে ভেস্তারস। এই সাক্ষাতে আমার সঙ্গী হয়েছিল আমার স্ত্রী, কন্যা এবং দুই বন্ধু_এবিবির ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী ড. মুরারী মোহন সাহা ও স্টকহোম থেকে প্রকাশিত 'মাসিক পরিক্রমা' পত্রিকার সম্পাদক লিয়াকত হোসেন। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত সাদৃশ্য আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে, আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ট্রান্সট্রোমারের কবিতার বাংলা রূপান্তরের কলেবর। তাঁর কাজ সম্পর্কে বইপত্র সংগ্রহ করি এবং কবিপত্নী ও সুইডেনের বিশিষ্ট কবি এবং কাব্যানুরাগীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি রিভিউ লিখে ফেলি। কবিতার দেশ বাংলাদেশে এই অনন্য কবিকে পরিচিত করার তাগিদ অনুভব করতে থাকি এবং অবশেষে ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ আমার ডিপ্লোমেটিক ট্যুর অব ডিউটির শেষ পর্যায়ে 'শুভ সন্ধ্যা হে সুন্দর গভীরতা : সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমারের নির্বাচিত কবিতা' বইটি প্রকাশ করতে সক্ষম হই। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কবি স্বয়ং ও মনিকা ছাড়াও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নোবেল সাহিত্য কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শেল এস্পমার্ক (নিজেও প্রখ্যাত কবি), উন্নয়ন সহযোগিতা মন্ত্রী পিয়ের শোরি, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জুলিয়েন এবং অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও উপস্থাপক অধ্যাপক অ্যান্ডার্স কুলহেড। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ওলফ পালমের পত্নী সুইডেনের সর্বজনশ্রদ্ধেয় লিজবেথ পালমেসহ সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্কের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমাবেশ অনুষ্ঠানটি সফল এবং আমার প্রচেষ্টা সার্থক করে তুলেছিল। আমার সাক্ষাৎকারসহ ঘটনাটি সুইডেনের সব মিডিয়ায় গুরুত্বসহকারে প্রচার করা হয়। ট্রান্সট্রোমার ১৯৯৩ সাল থেকেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য তালিকাভুক্ত ছিলেন। একই বছর থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। অক্টোবর মাসে বিশিষ্ট সাংবাদিক ইংভার ওজার নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই দুজন নোবেল প্রাইজ না পাওয়ায় আমি গভীর হতাশা প্রকাশ করি। দুজনের জন্যই আমার প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। ইতিমধ্যে 'শুভ সন্ধ্যা হে সুন্দর গভীরতা'র জন্য সেই বছরই আমাকে সুইডিশ কালচার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। আমার পর স্টকহোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব হিসেবে কর্মরত থাকাকালে কবি মোহাম্মদ সাদিক টমাস ও মনিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখেন এবং ট্রান্সট্রোমারের কিছুসংখ্যক কবিতা অনুবাদ করেন।
'শুভ সন্ধ্যা'র প্রথম ঢাকা সংস্করণ পাঠক সমাবেশের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সিরডাপ মিলনায়তনে আরেকটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
সাক্ষাৎকারের সময় আমরা দেখেছি, ট্রান্সট্রোমার আমাদের সব কথাই বোঝেন, কিন্তু জবাব দিতে গিয়ে কথা সম্পূর্ণ করতে পারেন না। তিনি পিয়ানো বাজালেন বাঁ হাতে। অটোগ্রাফও লিখলেন বাঁ হাত দিয়ে। তাঁর এই শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বিবরণ স্পষ্ট হয়েছে 'দুইটি শহর' কবিতায়। মস্তিষ্কের এক অংশ দিয়ে তিনি সৃষ্টি করতে পারেন এমন বিস্ময়কর সুগভীর কবিতা :
নদীর দুই তীরে/দুইটি শহর/একটি নিমজ্জিত অন্ধকারে,/শত্রুর কাছে পরাভূত;/অন্যটি আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত,/এপারের আলোকোজ্জ্বল সৈকত/মোহাবিষ্ট করে রাখে অন্ধকার অন্য পাড়টিকে।
ঘোরের ভিতর আমি সাঁতার কাটি/অন্ধকারে ঝলমল জলের উপর,/লুক্কায়িত বাঁশি ফেটে বিস্ফোরণ ঘটে,/বন্ধুর কণ্ঠস্বর বলে/যাও বন্ধু, যাও তোমার কবরে।
(দুইটি শহর : বিষণ্ন গন্ডোলা, ১৯৯৬)
টমাস ট্রান্সট্রোমার তাঁর কবিতার জগতের মতো যেন সত্যিকার অর্থে এখন বেঁচে আছেন এক গোলকধাঁধায়, স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যবর্তী প্রদেশে, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী করিডরে, শিল্প ও বাস্তাবতার সীমারেখায়। আর তাঁর এই কঠিন অবস্থান থেকে সত্যকে সন্ধান করছেন দুই জগতের মধ্যবর্তী সিংহদ্বারে, সত্যের সীমানায়, যেখানে সদাজাগ্রত প্রহরী যথারীতি প্রবেশাধিকার দেবে একের পর একজন আগন্তুককে। এখানে 'শাণিত তীক্ষ্ন তরবারি নির্মূল করে সব স্মৃতি; মাটিতে পড়ে থাকে বাঁশি আর খাপ, জং ধরে তাতে।' যাত্রাপথে এই অন্তর্বর্তী সময়ে তিনি আবার শুনতে পাচ্ছেন ঘণ্টা বাজছে স্টকহোমের প্রধান গির্জায়, শুনতে পাচ্ছেন কাচের মতো স্পষ্ট দূরাগত সংগীতের স্বর্গীয় সুর। কারা যেন এগিয়ে আসছে প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে তাঁর অভ্যর্থনায়। এগিয়ে আসছে যেন এমন অনেক শিশু, যাদের জন্য কেউ প্রার্থনা করে না। শুভ সন্ধ্যা, হে সুন্দর গভীরতা!
No comments