সুনেত্র-আমাদের আনন্দ ও আশঙ্কা by হায়দার আকবর খান রনো
আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স তার সক্ষমতা আরেকবার প্রমাণ করল। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা দুটি জেলার সীমান্ত এলাকায় একটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্থা বাপেঙ্। আবিষ্কার করেছেন আমাদের দেশের সন্তানরাই, বাংলাদেশি বৈজ্ঞানিক, প্রকৌশলী ও বাপেঙ্রে অন্য কর্মীরা। দুই জেলার আদ্যাক্ষর নিয়ে গ্যাসক্ষেত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে সুনেত্র। বস্তুত ক্ষেত্রটি পড়েছে ধরমপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নে।
এই গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ আছে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আবিষ্কৃত হয়েছিল এই বছরের আগস্ট মাসে। তার পরপরই তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ওই অঞ্চলে একটি জনসভার আয়োজন করেছিল গত ১৩ আগস্ট। খুবই নির্দোষ জনসভা। বড় ধরনের সুখবরে আনন্দ প্রকাশ ও আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জ্ঞাপন ছিল সভার মূল কথা। সঙ্গে অবশ্য এই দাবিও ছিল যে আমাদের জাতীয় সংস্থা দ্বারা আবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদে যেন বিদেশি কাউকে ভাগ দেওয়া না হয়। আমরা নিজেরা যেন উত্তোলন করি এবং পুরো সম্পদটি যেন দেশের উন্নয়নে কাজে লাগে। সম্ভবত এই দাবিটি কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের, যাদের রয়েছে বিদেশি কম্পানির সঙ্গে যোগসাজশ ও স্বার্থের হীন সম্পর্ক। তাদের পছন্দ হয়নি। হোক না বাংলাদেশি জাতীয় সংস্থা কর্তৃক আবিষ্কৃত। তবু এটাও তুলে দিতে হবে কোনো বিদেশি বহুজাতিক কম্পানির হাতে। এমন মতলব যাদের আছে, তারাই ১৩ আগস্ট জনসভার দিনে জনসভাস্থলে প্রশাসনকে দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করিয়েছিল। শুধু তাই নয়, স্থানীয় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন হামলা চালিয়েছিল সভাস্থলে আগত উদ্যোক্তা ও বক্তাদের ওপর। ঘটনাটি আশ্চর্যজনক মনে হলেও আসলে এটাই ঘটেছিল। ঠিক যেমন ২০০৯ সালে জাতীয় কমিটির শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর অকস্মাৎ লাঠিচার্জ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহম্মদসহ অনেককে আহত করেছিল। মিছিলের দাবি ছিল, সাগরবক্ষে যেন কনোকো ফিলিপসকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য সেই সুযোগ না দেওয়া হয়, যার দ্বারা ওই মার্কিন কম্পানিটি ৮০ শতাংশ গ্যাস দখল করবে এবং বিদেশে রপ্তানিও করতে পারবে। জাতীয় কমিটি অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তারা আবার একই দাবি নিয়ে (অর্থাৎ সুনেত্র যেন আমাদেরই থাকে) সুনেত্র অভিমুখে যাত্রা করার ঘোষণা দিয়েছে। যাত্রা শুরু হবে ২৮ অক্টোবর।
সরকার অবশ্য এখনো সুনেত্রের গ্যাসক্ষেত্রটি অন্য কাউকে দেয়নি। তবু ভয় হয়। গত ১৩ আগস্টের ঘটনা সন্দেহ ও আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে বৈকি।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের স্থলভাগের বেশ কয়টি এলাকা কয়েকটি বিদেশি বহুজাতিক কম্পানিকে লিজ দেওয়া হয়েছিল উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির ভিত্তিতে। যেখানে আমাদের জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা রয়েছে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের, সেখানে বিদেশি কম্পানিকে ডেকে এনে সম্পদে ভাগ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবু এটা হয়ে এসেছে। নব্বইয়ের দশকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই আমলেই হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এ ধরনের উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি পরিপূর্ণরূপে জাতীয় স্বার্থবিরোধী। এ প্রসঙ্গেই আমাদের জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা ও খরচের দিকটি বিচার করে দেখা যাক।
এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, আমাদের জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা বিদেশি বহুজাতিক কম্পানির চেয়ে অনেক বেশি। আর খরচ তো অবশ্যই অনেক কম। সর্বোপরি গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজটি আমরা নিজেরা করলে অন্য কাউকে ভাগ দিতে হবে না। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা ও পরে ১৯৮৯ থেকে এ পর্যন্ত বাপেঙ্ সর্বমোট ১৮টি কূপ খনন করেছে এবং আটটিতে গ্যাসক্ষেত্র পেয়েছে। এ সাফল্যের হার বিদেশি কম্পানির সাফল্যের হারের দ্বিগুণ। বাপেঙ্ কর্তৃক সম্প্রতি আবিষ্কৃত সুন্দলপুর ও সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্রটির কথা বাদ দিলেও বাপেঙ্ চারটি কূপ খনন করে তিনটিতে গ্যাস পেয়েছে। তা ছাড়া বাপেঙ্রে কোনো দুর্ঘটনার রেকর্ড নেই। কিন্তু অঙ্েিডন্টাল ও নাইকো মাগুরছড়া এবং টেংরিটোলায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের গ্যাস সম্পদের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে।
তবু বিদেশি কম্পানিকে ডেকে এনে ভাগ দিতে হবে। বস্তুত বাপেঙ্কে নিষ্ক্রিয় করে রাখাই এ যাবৎ সব সরকারের অঘোষিত নীতি ছিল। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাপেঙ্ শ্রীকাইলের গ্যাসক্ষেত্রটিও আবিষ্কার করেছিল। তারপর বাপেঙ্কে খনন করতে দেওয়া হয়নি। কারণ এর খুব কাছে আছে বাঙ্গোরা ক্ষেত্রটি, যেখানে কাজ করছে আইরিশ বহুজাতিক কম্পানি টাল্লো। শ্রীকাইল থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হলে বিদেশি কম্পানির ক্ষতি হবে_এটাই ছিল আমাদের শাসকবর্গ ও নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা। আমাদের ধনিক শ্রেণী হচ্ছে মুৎসুদ্দি চরিত্রের, যারা বিদেশি কম্পানির মুনাফার উচ্ছিষ্টভোগেই তুষ্ট। সরকার, প্রশাসন ও বড় বড় রাজনৈতিক দল তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
আমাদের সক্ষমতা বিদেশিদের চেয়ে বেশি। এর কারণ কি এই যে আমরা ওদের চেয়ে অধিক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছি? না, তা মোটেও নয়। বরং বাপেঙ্ অনেক ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়। তবু কেন সাদা চামড়ার সাহেবদের বা বিদেশি কম্পানির চেয়ে আমাদের সক্ষমতার রেকর্ড এত ভালো? কারণ আমাদের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা দরদ দিয়ে এবং দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করেন। তাঁদের প্রতিভাও আছে। অন্যদিকে বিদেশি কম্পানির লক্ষ্য হলো যেনতেন প্রকারে সর্বাধিক মুনাফা তুলে আনা। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তো তাই-ই করবে। তারা কি এই দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে? যদিও কখনো কখনো তাদেরকে উন্নয়ন সহযোগী ইত্যাদি গালভরা নাম দেওয়া হয়। বহুজাতিক কম্পানি যে দুনিয়াজোড়া স্রেফ লুণ্ঠনের কাজটিই করে বেড়ায়, এটা এখন বিশ্ববাসীও জানে। সেজন্য সম্প্রতি খোদ আমেরিকাসহ সারা দুনিয়ায় করপোরেট পুঁজিবিরোধী বিশাল আকারের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
এবার আসা যাক খরচ প্রসঙ্গে। বিভিন্ন হিসাব থেকে জানা যায়, আমাদের জাতীয় সংস্থার তুলনায় বিদেশি কম্পানি অনুসন্ধানের জন্য প্রায় ১১-১২ গুণ ব্যয় করে অথবা ব্যয় দেখায়, যেটা তারা প্রথমেই উসুল করে নেয়। উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী অনুসন্ধানকারী কম্পানি অনুসন্ধান বাবদ খরচের সমপরিমাণ গ্যাস নিয়ে নেবে। যাকে বলা হয় কস্ট রিকভারি (ঈড়ংঃ জবপড়াবৎু)। তারপর বাকি অংশ বাংলাদেশ ও বিদেশি কম্পানির মধ্যে আধাআধি হিসাবে ভাগাভাগি হবে। তাতে দেখা যায় আমাদের ভাগে পড়ে আমাদেরই সম্পদের সামান্য অংশ। বাকিটা ওরা লুট করে।
অনুপম সৈকত শান্ত ও কল্লোল মুস্তফা দুজন গবেষক একটা হিসাবে দেখিয়েছেন, বহুজাতিক কম্পানি প্রতি বর্গকিলোমিটার অনুসন্ধানের জন্য খরচ দেখায় ১০ লাখ টাকা (যেটা বাংলাদেশকেই দিতে হবে), সেখানে বাপেঙ্রে খরচ হচ্ছে মাত্র দেড় লাখ টাকা।
এসব বিবেচনা থেকেই ২০০১ সালে হাইকোর্ট এক রিটে রায় দিয়েছিল যে স্থলভাগে কোনো বিদেশি কম্পানিকে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ দেওয়া যাবে না। সেদিন আমাদের উচ্চ আদালত বড় ধরনের দেশপ্রেমিক ভূমিকা রেখেছিলেন। ফলে পরবর্তী কয়েক বছর স্থলভাগে বিদেশি কম্পানি আসতে পারেনি। কিন্তু এ বছর ২৮ জানুয়ারি বিচারপতি এম আনোয়ারুল হক এবং বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত এক বেঞ্চ পূর্ববর্তী রায়কে বাতিল করে নতুন রায় দিয়েছেন, যাতে উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। ফলে এখন আবার বিদেশি কম্পানিগুলো গ্যাস সম্পদ লুট করতে আসতে পারে, এ ভয় আমাদের মনে ঢুকেছে। আমাদের প্রশাসন ও বিদেশি কম্পানির এজেন্টরা তো বসেই আছে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশিদের লুটের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য, যেভাবে একদা মিরজাফর গং ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিকে লুট ও শোষণের সুযোগ করে দিয়েছিল। আধুনিক যুগের ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি হলো বহুজাতিক কম্পানিগুলো আর আধুনিক মিরজাফররাও আমাদের অপরিচিত নয়।
তাই তো ভয় হয়, সুনেত্র গ্যাস আবিষ্কার করার পরও যেন তা হাতছাড়া না হয়। সরকারকে এখনই এ ক্ষেত্রটি উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ করতে হবে। সুনেত্র ক্ষেত্রের উন্নয়ন অর্থাৎ উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, পাইপলাইন ইত্যাদির জন্য বাপেঙ্ ইতিমধ্যেই একটি পরিকল্পনা উপস্থিত করেছে। এ বছর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন বছরের জন্য প্রকল্প, যার নাম দেওয়া হয়েছে ঝঁহধসমড়হল-ঘবঃৎড়শড়হধ (ঝঁহবঃৎধ) ঙরষ/মধং ঊীঢ়ষড়ৎধঃড়ৎু ডবষষ উৎরষষরহম চৎড়লবপঃ. এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র ২৭৯ কোটি টাকা। তিন বছরে এ টাকায় সম্পন্ন হবে পুরো প্রকল্পটি। ঠিক এ ধরনের কাজের জন্য সিলেটের বিবিয়ানায় শেভরন দেখিয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশ সরকারকেই সেই টাকা দিতে হবে। তাহলে একদিকে অনুসন্ধান খরচও কম, উত্তোলন খরচও কম, সর্বোপরি আমাদের সক্ষমতাও বেশি। তাহলে কেন বিদেশির দ্বারস্থ হব? এই প্রশ্নটির সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় এবং আমাদের শাসকশ্রেণীর শ্রেণী-চরিত্র জড়িত আছে।
যে সুনেত্র নিয়ে আমরা আনন্দ করছি, গর্ব অনুভব করছি, তা নিয়ে তাই আশঙ্কাও কম নয়। আবার নাকি হাতছাড়া হয়ে যায়। জাতীয় কমিটির ১৩ আগস্ট জনসভায় হামলা ও ১৪৪ ধারা সেই আশঙ্কাকে ঘনীভূত করেছে।
কামনা করি আশঙ্কা অমূলক হোক। জনগণকে সচেতন করতে হবে। আমাদের জাতীয় সম্পদ আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। সুনেত্র উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দ্রুত দেওয়া হোক। একই সঙ্গে দাবি উঠুক, আর নয় স্থলভাগে কোনো বিদেশি কম্পানি। আর নয় উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি। গ্যাস বা কয়লা রপ্তানিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন প্রণয়ন করা হোক। আমাদের আশঙ্কা দূর হোক। আমাদের ভূগর্ভস্থ সম্পদ আমাদেরই উন্নয়নে কাজে লাগুক।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
সরকার অবশ্য এখনো সুনেত্রের গ্যাসক্ষেত্রটি অন্য কাউকে দেয়নি। তবু ভয় হয়। গত ১৩ আগস্টের ঘটনা সন্দেহ ও আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে বৈকি।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের স্থলভাগের বেশ কয়টি এলাকা কয়েকটি বিদেশি বহুজাতিক কম্পানিকে লিজ দেওয়া হয়েছিল উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির ভিত্তিতে। যেখানে আমাদের জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা রয়েছে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের, সেখানে বিদেশি কম্পানিকে ডেকে এনে সম্পদে ভাগ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবু এটা হয়ে এসেছে। নব্বইয়ের দশকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই আমলেই হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এ ধরনের উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি পরিপূর্ণরূপে জাতীয় স্বার্থবিরোধী। এ প্রসঙ্গেই আমাদের জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা ও খরচের দিকটি বিচার করে দেখা যাক।
এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, আমাদের জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা বিদেশি বহুজাতিক কম্পানির চেয়ে অনেক বেশি। আর খরচ তো অবশ্যই অনেক কম। সর্বোপরি গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজটি আমরা নিজেরা করলে অন্য কাউকে ভাগ দিতে হবে না। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা ও পরে ১৯৮৯ থেকে এ পর্যন্ত বাপেঙ্ সর্বমোট ১৮টি কূপ খনন করেছে এবং আটটিতে গ্যাসক্ষেত্র পেয়েছে। এ সাফল্যের হার বিদেশি কম্পানির সাফল্যের হারের দ্বিগুণ। বাপেঙ্ কর্তৃক সম্প্রতি আবিষ্কৃত সুন্দলপুর ও সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্রটির কথা বাদ দিলেও বাপেঙ্ চারটি কূপ খনন করে তিনটিতে গ্যাস পেয়েছে। তা ছাড়া বাপেঙ্রে কোনো দুর্ঘটনার রেকর্ড নেই। কিন্তু অঙ্েিডন্টাল ও নাইকো মাগুরছড়া এবং টেংরিটোলায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের গ্যাস সম্পদের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে।
তবু বিদেশি কম্পানিকে ডেকে এনে ভাগ দিতে হবে। বস্তুত বাপেঙ্কে নিষ্ক্রিয় করে রাখাই এ যাবৎ সব সরকারের অঘোষিত নীতি ছিল। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাপেঙ্ শ্রীকাইলের গ্যাসক্ষেত্রটিও আবিষ্কার করেছিল। তারপর বাপেঙ্কে খনন করতে দেওয়া হয়নি। কারণ এর খুব কাছে আছে বাঙ্গোরা ক্ষেত্রটি, যেখানে কাজ করছে আইরিশ বহুজাতিক কম্পানি টাল্লো। শ্রীকাইল থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হলে বিদেশি কম্পানির ক্ষতি হবে_এটাই ছিল আমাদের শাসকবর্গ ও নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা। আমাদের ধনিক শ্রেণী হচ্ছে মুৎসুদ্দি চরিত্রের, যারা বিদেশি কম্পানির মুনাফার উচ্ছিষ্টভোগেই তুষ্ট। সরকার, প্রশাসন ও বড় বড় রাজনৈতিক দল তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
আমাদের সক্ষমতা বিদেশিদের চেয়ে বেশি। এর কারণ কি এই যে আমরা ওদের চেয়ে অধিক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছি? না, তা মোটেও নয়। বরং বাপেঙ্ অনেক ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়। তবু কেন সাদা চামড়ার সাহেবদের বা বিদেশি কম্পানির চেয়ে আমাদের সক্ষমতার রেকর্ড এত ভালো? কারণ আমাদের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা দরদ দিয়ে এবং দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করেন। তাঁদের প্রতিভাও আছে। অন্যদিকে বিদেশি কম্পানির লক্ষ্য হলো যেনতেন প্রকারে সর্বাধিক মুনাফা তুলে আনা। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তো তাই-ই করবে। তারা কি এই দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে? যদিও কখনো কখনো তাদেরকে উন্নয়ন সহযোগী ইত্যাদি গালভরা নাম দেওয়া হয়। বহুজাতিক কম্পানি যে দুনিয়াজোড়া স্রেফ লুণ্ঠনের কাজটিই করে বেড়ায়, এটা এখন বিশ্ববাসীও জানে। সেজন্য সম্প্রতি খোদ আমেরিকাসহ সারা দুনিয়ায় করপোরেট পুঁজিবিরোধী বিশাল আকারের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
এবার আসা যাক খরচ প্রসঙ্গে। বিভিন্ন হিসাব থেকে জানা যায়, আমাদের জাতীয় সংস্থার তুলনায় বিদেশি কম্পানি অনুসন্ধানের জন্য প্রায় ১১-১২ গুণ ব্যয় করে অথবা ব্যয় দেখায়, যেটা তারা প্রথমেই উসুল করে নেয়। উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী অনুসন্ধানকারী কম্পানি অনুসন্ধান বাবদ খরচের সমপরিমাণ গ্যাস নিয়ে নেবে। যাকে বলা হয় কস্ট রিকভারি (ঈড়ংঃ জবপড়াবৎু)। তারপর বাকি অংশ বাংলাদেশ ও বিদেশি কম্পানির মধ্যে আধাআধি হিসাবে ভাগাভাগি হবে। তাতে দেখা যায় আমাদের ভাগে পড়ে আমাদেরই সম্পদের সামান্য অংশ। বাকিটা ওরা লুট করে।
অনুপম সৈকত শান্ত ও কল্লোল মুস্তফা দুজন গবেষক একটা হিসাবে দেখিয়েছেন, বহুজাতিক কম্পানি প্রতি বর্গকিলোমিটার অনুসন্ধানের জন্য খরচ দেখায় ১০ লাখ টাকা (যেটা বাংলাদেশকেই দিতে হবে), সেখানে বাপেঙ্রে খরচ হচ্ছে মাত্র দেড় লাখ টাকা।
এসব বিবেচনা থেকেই ২০০১ সালে হাইকোর্ট এক রিটে রায় দিয়েছিল যে স্থলভাগে কোনো বিদেশি কম্পানিকে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ দেওয়া যাবে না। সেদিন আমাদের উচ্চ আদালত বড় ধরনের দেশপ্রেমিক ভূমিকা রেখেছিলেন। ফলে পরবর্তী কয়েক বছর স্থলভাগে বিদেশি কম্পানি আসতে পারেনি। কিন্তু এ বছর ২৮ জানুয়ারি বিচারপতি এম আনোয়ারুল হক এবং বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত এক বেঞ্চ পূর্ববর্তী রায়কে বাতিল করে নতুন রায় দিয়েছেন, যাতে উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। ফলে এখন আবার বিদেশি কম্পানিগুলো গ্যাস সম্পদ লুট করতে আসতে পারে, এ ভয় আমাদের মনে ঢুকেছে। আমাদের প্রশাসন ও বিদেশি কম্পানির এজেন্টরা তো বসেই আছে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশিদের লুটের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য, যেভাবে একদা মিরজাফর গং ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিকে লুট ও শোষণের সুযোগ করে দিয়েছিল। আধুনিক যুগের ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি হলো বহুজাতিক কম্পানিগুলো আর আধুনিক মিরজাফররাও আমাদের অপরিচিত নয়।
তাই তো ভয় হয়, সুনেত্র গ্যাস আবিষ্কার করার পরও যেন তা হাতছাড়া না হয়। সরকারকে এখনই এ ক্ষেত্রটি উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ করতে হবে। সুনেত্র ক্ষেত্রের উন্নয়ন অর্থাৎ উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, পাইপলাইন ইত্যাদির জন্য বাপেঙ্ ইতিমধ্যেই একটি পরিকল্পনা উপস্থিত করেছে। এ বছর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন বছরের জন্য প্রকল্প, যার নাম দেওয়া হয়েছে ঝঁহধসমড়হল-ঘবঃৎড়শড়হধ (ঝঁহবঃৎধ) ঙরষ/মধং ঊীঢ়ষড়ৎধঃড়ৎু ডবষষ উৎরষষরহম চৎড়লবপঃ. এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র ২৭৯ কোটি টাকা। তিন বছরে এ টাকায় সম্পন্ন হবে পুরো প্রকল্পটি। ঠিক এ ধরনের কাজের জন্য সিলেটের বিবিয়ানায় শেভরন দেখিয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশ সরকারকেই সেই টাকা দিতে হবে। তাহলে একদিকে অনুসন্ধান খরচও কম, উত্তোলন খরচও কম, সর্বোপরি আমাদের সক্ষমতাও বেশি। তাহলে কেন বিদেশির দ্বারস্থ হব? এই প্রশ্নটির সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় এবং আমাদের শাসকশ্রেণীর শ্রেণী-চরিত্র জড়িত আছে।
যে সুনেত্র নিয়ে আমরা আনন্দ করছি, গর্ব অনুভব করছি, তা নিয়ে তাই আশঙ্কাও কম নয়। আবার নাকি হাতছাড়া হয়ে যায়। জাতীয় কমিটির ১৩ আগস্ট জনসভায় হামলা ও ১৪৪ ধারা সেই আশঙ্কাকে ঘনীভূত করেছে।
কামনা করি আশঙ্কা অমূলক হোক। জনগণকে সচেতন করতে হবে। আমাদের জাতীয় সম্পদ আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। সুনেত্র উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দ্রুত দেওয়া হোক। একই সঙ্গে দাবি উঠুক, আর নয় স্থলভাগে কোনো বিদেশি কম্পানি। আর নয় উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি। গ্যাস বা কয়লা রপ্তানিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন প্রণয়ন করা হোক। আমাদের আশঙ্কা দূর হোক। আমাদের ভূগর্ভস্থ সম্পদ আমাদেরই উন্নয়নে কাজে লাগুক।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
No comments