নাটকের পর নাটক-বিকেলে পরিপত্র রাতে প্রত্যাহার by শরীফুল ইসলাম

রকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে গতকাল দিনভর ছিল নানা ধরনের নাটকীয়তা। সকাল ১১টায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনিয়োগ নিয়ে মন্ত্রিসভায় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিকেল ৫টার পরই সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তার বক্তব্য উল্টে যায়।


জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে 'ফটকা কারবারে' সরকারি কর্মকর্তাদের বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে পরিপত্র জারি করা হয়। সন্ধ্যা ৭টার পরই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জরুরি নির্দেশনায় বাতিল করা হয় ওই পরিপত্রটিও। এ সংক্রান্ত কোনো অফিস আদেশ জারি করা হয়নি। মৌখিকভাবে তথ্য অধিদফতরকে জানিয়ে এটি বাতিল করা হয়েছে। আজ বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি হবে। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে
সরকারি কর্মকর্তাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আচরণ বিধিমালা অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারের পরই মঙ্গলবার পুঁজিবাজারে দুর্যোগ নেমে আসে। হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয় লেনদেন। ওই দিন ঘোষণা দেওয়া হয় বুধবার স্বাভাবিক লেনদেন শুরু হবে। সে অনুসারে গতকাল সকাল ১১টায় এসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল ইসলাম দাবি করেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবেন না_ এ মর্মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত সংবাদকে বিভ্রান্তিমূলক দাবি করেন তিনি। বিকেল ৫টার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এক পরিপত্র জারি করে বলা হয়, এখন থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হলো। একই সঙ্গে যেসব বিনিয়োগের ফলে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সরকারি কার্যসম্পাদন প্রভাবান্বিত হতে পারে অথবা সরকারি কর্তব্য সম্পাদনের বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাদের পরিবারের সদস্যদেরও এরূপ বিনিয়োগে অনুমতি প্রদানে সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ করা হয় ওই পরিপত্রে। ২ ঘণ্টা পরই পরিপত্রটি প্রত্যাহার করা হয়।
যে কারণে প্রত্যাহার করা হলো : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল তাতে সরকারি আচরণ বিধিমালার ব্যাখ্যাটা অসামঞ্জস্য ছিল। এটি পুঁজিবাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে এমন চিন্তা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ফোন করে এটি বাতিল করার নির্দেশ দেন। মূলত যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল তা প্রধানমন্ত্রীকে দেখানো হয়নি। সোমবার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছিল সরকারি আচরণবিধিমালা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অফিস আদেশ জারি করা। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরাসরি বিরত থাকার নির্দেশনা না দিয়ে এ আদেশ জারি করতে বলা হয়। কিন্তু সরকারের এক শীর্ষ পর্যায়ের সচিবের নির্দেশে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে এ পরিপত্র জারি করা হয়। গতকাল সকালে ওই কর্মকর্তা জনপ্রশাসন সচিবকে ওই পরিপত্র জারির নির্দেশ দেন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। দ্রুত এ ধরনের প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পরে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের তার রুমে ডেকে নিয়ে এ পরিপত্র তৈরি করেন। ওই সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একটি সেমিনারে অফিসের বাইরে ছিলেন। পরে তিনি অফিসে আসার পরই ওই ঊর্ধ্বতন কর্তা তাকে ডেকে পাঠান। তিনি বলেন, নির্দেশ রয়েছে দ্রুত এ পরিপত্র জারি করতে হবে। পরে জনপ্রশাসন সচিবের স্বাক্ষর নিয়ে জারি করা হয় পরিপত্রটি। পরিপত্রটি গণমাধ্যমে প্রচারের পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ঘুম ভাঙে। একজন উপদেষ্টা পরিপত্রের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনেন। এর নেতিবাচক দিক তিনি তুলে ধরেন। এর পরই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে ফোন আসে প্রধানমন্ত্রীর। তিনি জানতে চান, কেন এ ধরনের পরিপত্র জারি করা হলো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে পরিপত্র জারির আগে কেন তাকে একবার দেখানো হলো না। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়েন এ সচিব। দ্রুত পরিপত্রটি বাতিল করতে নির্দেশ দেনু প্রধানমন্ত্রী। দ্রুত এটি সংশোধন করে জারি করতে বলেন। এরপরই পরিপত্রটি বাতিল করা হয়। গতকাল রাতে ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো সংশোধনী পরিপত্র সরকারিভাবে জারি করা হয়নি। তবে জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার সংশোধনী পরিপত্রটি জারি করা হতে পারে। এ পরিপত্রে সরকারি কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে সরাসরি কোনো নির্দেশনা বা কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হবে না। শুধু পরিপত্রে সরকারি আচরণ বিধিমালার ১৫ ধারাটি তুলে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে এটি অনুসরণ করতে সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হবে। এটি অমান্য করলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং যারা অমান্য করে বিনিয়োগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি-না সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা থাকবে না ওই পরিপত্রে।
এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন সচিব আবদুস সোবহান শিকদার সমকালকে বলেন, সরকারি কর্মচারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি আচরণ বিধিমালা অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল এ পরিপত্রের মূল উদ্দেশ্য। পরিপত্রে কিছু শব্দগত ভুলের কারণে এটি বাতিল করা হয়েছে। পরিপত্রে সরকারি কর্মচারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিরত থাকার যে অপশনটি ছিল তা নিয়ে এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়ায় এটি বহাল রাখা হয়নি।
এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশররাফ হোসাইন ভূইঞার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। একটি ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে জানান, শারীরিক অসুস্থতায় তিনি কথা বলতে পারবেন না।
উল্লেখ্য, সরকারি কর্মকর্তাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে বাধা থাকলেও বর্তমানে লাখ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর বিনিয়োগ রয়েছে। এর আগে এ সংখ্যা ছিল সীমিত। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা শেয়ারবাজারে ব্যাপক বিনিয়োগ করে। ব্রোকারেজ হাউসগুলোর শাখা অফিস বিভিন্ন থানায় পেঁৗছে যাওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তারাও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.