আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৪৭)-আর পেছন ফিরে তাকাইনি by আলী যাকের
উনিশ শ চৌষট্টি সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তখন রটানো হয়, ভারতের কাশ্মীর রাজ্যে হজরতবাল মসজিদে রক্ষিত হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি চুল স্থানীয় হিন্দুরা চুরি করে নিয়ে যায়। এই গুজবে ভারতের কিছু কিছু জায়গায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। উভয় সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষ মারা যায়।
পরে এ ঘটনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বস্তুতপক্ষে আমি যখন আমার স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে কাশ্মীর গিয়েছিলাম ১৯৮৪-তে, তখন এক মুসলমান ট্যাঙ্ িড্রাইভার আমাদের হজরতবাল মসজিদ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ওই চুরির ব্যাপারটা নিতান্তই গুজব ছিল। তাঁর ভাষায় 'বাকওয়াস'। যা হোক, তখন আইয়ুব খানের মন্ত্রী খুলনা নিবাসী সবুর খান সেখানকার কিছু অভিবাসী কসাইকে দিয়ে প্রথম এই দাঙ্গা শুরু করে। সেটা পরে ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময়ই মায়ের ক্যান্সার ফিরে আসে। আমরা সবাই তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত। তবে গেণ্ডারিয়াপাড়ায় আমরা সব তরুণ মিলে স্কোয়াড তৈরি করে সারা রাত রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতাম। কোথাও কোনো অঘটন ঘটতে দেইনি। এ ব্যাপারে আমাদের প্রান্তিক মুকুল মেলার সহকর্মীরা সত্যি দিন-রাত খেটেছে। এই দাঙ্গায় হিন্দুদের অনেক সম্পত্তি ধ্বংস হয়। বিশেষ করে ওদের ছোটখাটো ব্যবসাগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কালাচাঁদ, মতিলালের মিষ্টির দোকান থেকে শুরু করে পিতাম্বর সাহার পাইকারি দোকান, ফরাশগঞ্জের বালু-সিমেন্টের ব্যবসা_এসব তছনছ করে ফেলা হয়। আমরা গেণ্ডারিয়ার সব মসজিদে গিয়ে অনুরোধ করি যে ইমাম সাহেবরা যেন প্রতিবারের নামাজের আগে দাঙ্গার এই উন্মাদনা প্রশমিত করার জন্য মুসলি্লদের বিশেষ আবেদন জানান। তাঁরা আমাদের অনুরোধ রেখেছিলেন। এতে কাজও হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার যদিও চাইছিল, এ ঘটনা টেনে নিয়ে ভারতের সঙ্গে একটা যুদ্ধাবস্থা বজায় রাখতে; কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের সক্রিয় সহযোগিতায় এই কুৎসিত দাঙ্গা স্তিমিত হয়ে আসতে আসতে শেষ পর্যন্ত থেমে যায়। তবে এই দাঙ্গার ফলে আমরা আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধবের আস্থা হারাই। অনেকেই কাউকে কিছু না বলে ভিটেমাটি ও সহায়-সম্পত্তি ফেলে ভারতে চলে যায়। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আসে আমাদের। একেক সময় বড্ড দুঃখ এবং অভিমান হয়। ভাবি, আমরা তো ছিলামই। কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখি, অনুগৃহীত হয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। এ বড় অপমানজনক। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের এই একটা ব্যাপার ছিল। গণমানুষের মৌলিক দাবিগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখার জন্য তারা আওয়াজ তুলত, ইসলামের মহাবিপদ আসন্ন। এবং এ ব্যাপারে তারা ভারতকে অভিযুক্ত করত। এই করতে করতে উনিশ শ পঁয়ষট্টিতে তো একটা যুদ্ধই বাধিয়ে বসেছিল। ক্ষণস্থায়ী সে যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় প্রায় নাকে খত দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর পড়ব না। অর্থাৎ বিএ অনার্সই আমার জন্য অনেক হয়ে গেছে। কোনো দিন মানসিক অবস্থা ভালো হলে আবার চেষ্টা করা যাবে। এই পড়াশোনা নিয়ে একটা ছোটখাটো চাকরি জুটিয়ে ফেলা যাবে। এই সময় আমরা গেণ্ডারিয়ার বাড়ি ছেড়ে দিলু রোডের একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া নিই। অতিসাধারণ একটা বাসা। কী কারণে আমাদের পৈতৃক ভিটা ছাড়লাম, তাও জানি না। আসলে আমাদের বাড়িতে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মানুষের মৃত্যুতে লোকে বলাবলি করছিল যে ওই বাড়িটাই আমাদের জন্য অমঙ্গল ডেকে এনেছে। তখন আমরা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে। অতএব এই বাসগৃহ পরিবর্তন। এখানে এসে আরো বেশি পুরনো দিনের কথা মনে পড়তে লাগল আমার। এক অদ্ভুত অস্থিরতা পেয়ে বসে আমাকে। এখন হাতে কিছু করার নেই। পড়াশোনাও শেষ। কাজেই কাজের কোনো তাগাদা নেই। মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে ইচ্ছার তাগাদা স্তিমিত হয়ে গেছে। এক বন্ধু প্রস্তাব দিল মন ভালো করার জন্য বিদেশিদের নাচের পার্টিতে যাওয়ার। গেলাম। কিন্তু কিছু ভালো না লাগায় অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে এলাম। এ সময় বিলেতি কম্পানি আইসিআইয়ের একটা বিজ্ঞাপন দেখে সেখানে ইন্টারভিউ দিলাম। চাকরিও হয়ে গেল। উচ্চপদস্থ করণিকের চাকরি। ওরা বলত অ্যাসিস্ট্যান্ট। এই একটা ব্যাপার ছিল এসব সাহেব কম্পানিতে। একেবারে কনিষ্ঠ কেরানির ওপর সবাই অ্যাসিস্ট্যান্ট। কেবল বড় সাহেব হলেন ম্যানেজার। আইসিআই ধরনের কম্পানিগুলো ছিল সেই উপনিবেশবাদী ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির উত্তরসূরি। উচ্চপদস্থ করণিক হিসেবে আমার কাজ ছিল, ওদের আমদানি করা ওষুধপত্রের প্রোফর্মা ইত্যাদি তৈরি করা, আর ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান। এ উপলক্ষে আমাকে ইংরেজিতে লিখতে হতো। আমার কোনো অসুবিধা হতো না। আমি ইংরেজিতে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি গানের জন্য প্রশংসাও কুড়িয়েছি যথেষ্ট। কিন্তু দুই মাসের মাথায় আমার চাকরিটা চলে গেল। আমাকে গোয়ানিজ ম্যানেজার এক সকালে তাঁর ঘরে ডেকে জানালেন যে আমার চাকরিটা চলে গেছে। আমার দোষ_আমি নাকি যথেষ্ট ইংরেজি জানি না। আমার সরাসরি যিনি বস্্ তিনি মনে করছেন, আমার খারাপ ইংরেজির জন্য ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। একটু অবাক হয়েছিলাম। কারণ এই প্রথম আমার খারাপ ইংরেজির জন্য একটা অভিযোগ পেলাম। আর এমনই সে অভিযোগ যে আমার চাকরিটাই গেল। এ জন্য অবশ্য আমি সে সময় কোনো দুঃখ পাইনি। সত্যি বলতে কী, সে সময় আমার বোধশোধ একটু ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। বকেয়া বেতন ছিল কয়েক দিনের, তা নিয়ে গায়ে হাওয়া লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে এলাম। আর পেছন ফিরে তাকাইনি ওই অফিসের দিকে।
(চলবে....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর পড়ব না। অর্থাৎ বিএ অনার্সই আমার জন্য অনেক হয়ে গেছে। কোনো দিন মানসিক অবস্থা ভালো হলে আবার চেষ্টা করা যাবে। এই পড়াশোনা নিয়ে একটা ছোটখাটো চাকরি জুটিয়ে ফেলা যাবে। এই সময় আমরা গেণ্ডারিয়ার বাড়ি ছেড়ে দিলু রোডের একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া নিই। অতিসাধারণ একটা বাসা। কী কারণে আমাদের পৈতৃক ভিটা ছাড়লাম, তাও জানি না। আসলে আমাদের বাড়িতে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মানুষের মৃত্যুতে লোকে বলাবলি করছিল যে ওই বাড়িটাই আমাদের জন্য অমঙ্গল ডেকে এনেছে। তখন আমরা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে। অতএব এই বাসগৃহ পরিবর্তন। এখানে এসে আরো বেশি পুরনো দিনের কথা মনে পড়তে লাগল আমার। এক অদ্ভুত অস্থিরতা পেয়ে বসে আমাকে। এখন হাতে কিছু করার নেই। পড়াশোনাও শেষ। কাজেই কাজের কোনো তাগাদা নেই। মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে ইচ্ছার তাগাদা স্তিমিত হয়ে গেছে। এক বন্ধু প্রস্তাব দিল মন ভালো করার জন্য বিদেশিদের নাচের পার্টিতে যাওয়ার। গেলাম। কিন্তু কিছু ভালো না লাগায় অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে এলাম। এ সময় বিলেতি কম্পানি আইসিআইয়ের একটা বিজ্ঞাপন দেখে সেখানে ইন্টারভিউ দিলাম। চাকরিও হয়ে গেল। উচ্চপদস্থ করণিকের চাকরি। ওরা বলত অ্যাসিস্ট্যান্ট। এই একটা ব্যাপার ছিল এসব সাহেব কম্পানিতে। একেবারে কনিষ্ঠ কেরানির ওপর সবাই অ্যাসিস্ট্যান্ট। কেবল বড় সাহেব হলেন ম্যানেজার। আইসিআই ধরনের কম্পানিগুলো ছিল সেই উপনিবেশবাদী ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির উত্তরসূরি। উচ্চপদস্থ করণিক হিসেবে আমার কাজ ছিল, ওদের আমদানি করা ওষুধপত্রের প্রোফর্মা ইত্যাদি তৈরি করা, আর ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান। এ উপলক্ষে আমাকে ইংরেজিতে লিখতে হতো। আমার কোনো অসুবিধা হতো না। আমি ইংরেজিতে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি গানের জন্য প্রশংসাও কুড়িয়েছি যথেষ্ট। কিন্তু দুই মাসের মাথায় আমার চাকরিটা চলে গেল। আমাকে গোয়ানিজ ম্যানেজার এক সকালে তাঁর ঘরে ডেকে জানালেন যে আমার চাকরিটা চলে গেছে। আমার দোষ_আমি নাকি যথেষ্ট ইংরেজি জানি না। আমার সরাসরি যিনি বস্্ তিনি মনে করছেন, আমার খারাপ ইংরেজির জন্য ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। একটু অবাক হয়েছিলাম। কারণ এই প্রথম আমার খারাপ ইংরেজির জন্য একটা অভিযোগ পেলাম। আর এমনই সে অভিযোগ যে আমার চাকরিটাই গেল। এ জন্য অবশ্য আমি সে সময় কোনো দুঃখ পাইনি। সত্যি বলতে কী, সে সময় আমার বোধশোধ একটু ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। বকেয়া বেতন ছিল কয়েক দিনের, তা নিয়ে গায়ে হাওয়া লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে এলাম। আর পেছন ফিরে তাকাইনি ওই অফিসের দিকে।
(চলবে....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments