শেকড়ের ডাক-জলবায়ু পরিবর্তন : উপেক্ষিত মহাবিপদ সংকেত by ফরহাদ মাহমুদ
আমাদের ভাবনায় কিংবা প্রাত্যহিক আলাপ-আলোচনায় স্থানীয় রাজনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিও অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির সর্বশেষ খবর জানার জন্যও আমরা বিশেষ আগ্রহী ছিলাম। বিশ্ব পুঁজিবাদের মূল ঘাঁটি ওয়াল স্ট্রিটে সৃষ্ট ঘূর্ণাবর্তও আমাদের অনেকের চিন্তাজগতে আলোড়ন তোলে। এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে, সেই বিষয়টি আমাদের চিন্তার দুয়ারে তেমনভাবে আঘাত করে কি? সম্ভবত না। সরকারের উচ্চপর্যায়ে কখনো কখনো বিষয়টি আলোচিত হয়, তবে সে আলোচনা হয় মূলত উন্নত দেশগুলোর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কিংবা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে আমাদের করণীয় নিয়ে আলোচনা বা গবেষণা খুব কমই হয়। বাস্তব উদ্যোগ আরো কম দেখা যায়।
২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিডর এবং ২০০৮ সালে আইলা উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় আঘাত হেনেছিল। এর ফলে উপকূল রক্ষাবাঁধের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কেবল খুলনা বিভাগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে থাকা এক হাজার ৬৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটারই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখনো সেসব বাঁধ সম্পূর্ণ মেরামত করা যায়নি। ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে আসা নোনা পানিতে তলিয়ে থাকে বিস্তীর্ণ এলাকা। বিস্তর ফসলি জমি অনাবাদি পড়ে থাকছে। জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিল ৩৮ হাজার, এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার মানুষই বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। অথচ পাকিস্তান আমলে নির্মিত এসব বাঁধের উচ্চতা জরুরি ভিত্তিতে বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের উদ্যোগও নেই। উপকূলীয় কৃষি আজ চরম বিপর্যস্ত। বিকল্প কৃষিব্যবস্থা চালু করারও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। চলতি বর্ষায় টেকনাফ থেকে শুরু করে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকা বারবার প্লাবিত হয়েছে। কেবল উপকূলবর্তী জনপদ নয়, ভোলা-বরগুনা-পটুয়াখালীর মতো শহরগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। গত বর্ষায় কঙ্বাজার কয়েকবার প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারের পানিতেও প্লাবিত হচ্ছে বাগেরহাট ও চট্টগ্রাম শহর। দিন দিন এই প্লাবিত হওয়ার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। উপকূলীয় কৃষি কতটা বিপর্যস্ত হয়েছে, তা এই বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় গেলেই চোখে পড়ে। যে বরিশাল বিভাগকে একসময় বাংলাদেশের ধানের গোলা বলা হতো, সেখানে আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমশ কমছে। কমছে চট্টগ্রাম এবং খুলনা বিভাগেও। গোপালগঞ্জ সদরসংলগ্ন বাগেরহাটের সর্ব-উত্তরের উপজেলা চিতলমারী গিয়ে দেখা যায়, নোনা পানির কারণে মাঠের পর মাঠ অনাবাদি পড়ে রয়েছে। নোনা পানির এই আগ্রাসী চরিত্র ক্রমেই বাড়ছে। উপকূল ছাড়িয়ে ক্রমেই দেশের গভীরে প্রবেশ করবে।
এদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্রমেই সাগর আগ্রাসী হয়ে উঠছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যত বাড়ে, ততই বাড়তে থাকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ। উপর্যুপরি সিডর ও আইলার আঘাত তা-ই প্রমাণ করে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে বঙ্গোপসাগরে ছয়টি ঘূর্ণিঝড় এবং ১০৭টি লঘু ও নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার পাশাপাশি শীতকালে উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরের নদীগুলোতে নোনা পানির অনুপ্রবেশ ক্রমেই বাড়ছে।
গত বুধবার জলবায়ুর ঝুঁকি বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান 'ম্যাপলক্রাফ্ট' ২০১১ সালের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতেও বিশ্বে যে ৩০টি দেশকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সেগুলোর শীর্ষে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে কেবল যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা সাগরের আগ্রাসী আচরণ রয়েছে, তা নয়। অতিরিক্ত খরা, ভয়াবহ বন্যা, মহামারী আকারে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়াসহ আরো অনেক কিছুই এই ঝুঁকির অন্তর্ভুক্ত। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এই লক্ষণগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় ইতিমধ্যেই মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ দিয়েও পানি উঠছে না। ফলে বোরো ধানের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
অথচ উপকূলীয় অঞ্চলের ৪৬ শতাংশ মানুষ বাস করে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ সেন্টিমিটার উচ্চতার মধ্যে, যাদের পক্ষে দুই দশক পর সেখানে বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়বে। তারা জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে বড় শহরগুলোতে গিয়ে ছিন্নমূলের মতো বসবাস করতে বাধ্য হবে। এর মধ্যে দেশের লোকসংখ্যা আরো কয়েক কোটি বাড়বে। অন্যদিকে আবাদি জমি কমে যাওয়ার কারণে দেশের মোট খাদ্য উৎপাদনও যথেষ্ট পরিমাণে কমে যাবে। তখন যে অবস্থা দাঁড়াবে, তার পরিণাম কি দেশের অবশিষ্ট জনসংখ্যাকেও ভোগ করতে হবে না? শুধু কি তা-ই? সাগরের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে বন্যার প্রকোপ এখনকার চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ ও তীব্রতা। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও নেমে আসবে অনেক ধরনের বিপর্যয়। ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে কলেরা ও ডায়রিয়ার প্রকোপ। এই প্রক্রিয়া শুধু বাংলাদেশেই ঘটবে তা নয়, সারা দুনিয়ায়ই ঘটবে এবং ঘটছেও। প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু দ্বীপরাষ্ট্রের বহু মানুষকে ইতিমধ্যেই কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কিছু দেশে স্থানান্তর করা হয়েছে। দুই দশক পর সেসব দেশেও বাংলাদেশিদের স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ থাকবে বলে মনে হয় না।
বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর লক্ষ্যে বিশ্ব উদ্যোগ চলছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধ করার সম্ভাবনাও বাস্তবে অনুপস্থিত। এখন আমাদের একমাত্র করণীয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে চলার মতো নানা কৌশল উদ্ভাবন ও প্রয়োগ। মানুষের দুর্ভোগ যাতে কম হয় সে জন্য এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া। নোনা পানির থাবা থেকে ফসলি জমি যতটুকু পারা যায় রক্ষা করা। অধিক সংখ্যায় মানুষ যাতে বাস্তুচ্যুত না হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। নোনাপানি সহনশীল কৃষিপদ্ধতি উদ্ভাবন করা। এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থাগুলোকে বাস্তবসম্মত ধ্যানধারণা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে এবং তাদের এই গবেষণায় সরকারকে সব রকম সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে। বাস্তবে আমাদের দেশে গবেষণার সীমাবদ্ধতা এখনো এত বেশি যে তা রীতিমতো লজ্জাকর। এ জন্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সর্বোপরি, সরকারকে আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সেসব পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। কেবল কাগজে-কলমে এক শ বা দেড় শ বছরের পরিকল্পনা নিলেই হবে না। সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি যেমন ত্বরান্বিত করতে হবে, তেমনি এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতা যথাসাধ্য ধরে রাখার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাজকর্মের সঙ্গে সরকারি উদ্যোগের সমন্বয় সাধনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমাদের সম্পর্কে অতি পুরনো ও অতি প্রচলিত কিছু শ্লেষ আছে। যেমন_বাঙালি দাঁত থাকতে নাকি দাঁতের মর্যাদা দিতে জানে না কিংবা বিপদ এসে ঘাড়ের ওপর না পড়া পর্যন্ত নাকি আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু অস্তিত্বের প্রয়োজনে অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে আমাদের এসব ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে। সময়ের কাজটি সময় থাকতেই আমাদের সম্পন্ন করার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিডর এবং ২০০৮ সালে আইলা উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় আঘাত হেনেছিল। এর ফলে উপকূল রক্ষাবাঁধের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কেবল খুলনা বিভাগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে থাকা এক হাজার ৬৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটারই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখনো সেসব বাঁধ সম্পূর্ণ মেরামত করা যায়নি। ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে আসা নোনা পানিতে তলিয়ে থাকে বিস্তীর্ণ এলাকা। বিস্তর ফসলি জমি অনাবাদি পড়ে থাকছে। জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাবুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিল ৩৮ হাজার, এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার মানুষই বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। অথচ পাকিস্তান আমলে নির্মিত এসব বাঁধের উচ্চতা জরুরি ভিত্তিতে বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের উদ্যোগও নেই। উপকূলীয় কৃষি আজ চরম বিপর্যস্ত। বিকল্প কৃষিব্যবস্থা চালু করারও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। চলতি বর্ষায় টেকনাফ থেকে শুরু করে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকা বারবার প্লাবিত হয়েছে। কেবল উপকূলবর্তী জনপদ নয়, ভোলা-বরগুনা-পটুয়াখালীর মতো শহরগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। গত বর্ষায় কঙ্বাজার কয়েকবার প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারের পানিতেও প্লাবিত হচ্ছে বাগেরহাট ও চট্টগ্রাম শহর। দিন দিন এই প্লাবিত হওয়ার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। উপকূলীয় কৃষি কতটা বিপর্যস্ত হয়েছে, তা এই বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় গেলেই চোখে পড়ে। যে বরিশাল বিভাগকে একসময় বাংলাদেশের ধানের গোলা বলা হতো, সেখানে আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমশ কমছে। কমছে চট্টগ্রাম এবং খুলনা বিভাগেও। গোপালগঞ্জ সদরসংলগ্ন বাগেরহাটের সর্ব-উত্তরের উপজেলা চিতলমারী গিয়ে দেখা যায়, নোনা পানির কারণে মাঠের পর মাঠ অনাবাদি পড়ে রয়েছে। নোনা পানির এই আগ্রাসী চরিত্র ক্রমেই বাড়ছে। উপকূল ছাড়িয়ে ক্রমেই দেশের গভীরে প্রবেশ করবে।
এদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্রমেই সাগর আগ্রাসী হয়ে উঠছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যত বাড়ে, ততই বাড়তে থাকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ। উপর্যুপরি সিডর ও আইলার আঘাত তা-ই প্রমাণ করে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে বঙ্গোপসাগরে ছয়টি ঘূর্ণিঝড় এবং ১০৭টি লঘু ও নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার পাশাপাশি শীতকালে উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরের নদীগুলোতে নোনা পানির অনুপ্রবেশ ক্রমেই বাড়ছে।
গত বুধবার জলবায়ুর ঝুঁকি বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান 'ম্যাপলক্রাফ্ট' ২০১১ সালের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতেও বিশ্বে যে ৩০টি দেশকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সেগুলোর শীর্ষে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে কেবল যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা সাগরের আগ্রাসী আচরণ রয়েছে, তা নয়। অতিরিক্ত খরা, ভয়াবহ বন্যা, মহামারী আকারে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়াসহ আরো অনেক কিছুই এই ঝুঁকির অন্তর্ভুক্ত। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এই লক্ষণগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় ইতিমধ্যেই মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ দিয়েও পানি উঠছে না। ফলে বোরো ধানের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
অথচ উপকূলীয় অঞ্চলের ৪৬ শতাংশ মানুষ বাস করে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ সেন্টিমিটার উচ্চতার মধ্যে, যাদের পক্ষে দুই দশক পর সেখানে বসবাস করাই কঠিন হয়ে পড়বে। তারা জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে বড় শহরগুলোতে গিয়ে ছিন্নমূলের মতো বসবাস করতে বাধ্য হবে। এর মধ্যে দেশের লোকসংখ্যা আরো কয়েক কোটি বাড়বে। অন্যদিকে আবাদি জমি কমে যাওয়ার কারণে দেশের মোট খাদ্য উৎপাদনও যথেষ্ট পরিমাণে কমে যাবে। তখন যে অবস্থা দাঁড়াবে, তার পরিণাম কি দেশের অবশিষ্ট জনসংখ্যাকেও ভোগ করতে হবে না? শুধু কি তা-ই? সাগরের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে বন্যার প্রকোপ এখনকার চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ ও তীব্রতা। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও নেমে আসবে অনেক ধরনের বিপর্যয়। ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে কলেরা ও ডায়রিয়ার প্রকোপ। এই প্রক্রিয়া শুধু বাংলাদেশেই ঘটবে তা নয়, সারা দুনিয়ায়ই ঘটবে এবং ঘটছেও। প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু দ্বীপরাষ্ট্রের বহু মানুষকে ইতিমধ্যেই কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কিছু দেশে স্থানান্তর করা হয়েছে। দুই দশক পর সেসব দেশেও বাংলাদেশিদের স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ থাকবে বলে মনে হয় না।
বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর লক্ষ্যে বিশ্ব উদ্যোগ চলছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধ করার সম্ভাবনাও বাস্তবে অনুপস্থিত। এখন আমাদের একমাত্র করণীয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে চলার মতো নানা কৌশল উদ্ভাবন ও প্রয়োগ। মানুষের দুর্ভোগ যাতে কম হয় সে জন্য এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া। নোনা পানির থাবা থেকে ফসলি জমি যতটুকু পারা যায় রক্ষা করা। অধিক সংখ্যায় মানুষ যাতে বাস্তুচ্যুত না হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। নোনাপানি সহনশীল কৃষিপদ্ধতি উদ্ভাবন করা। এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থাগুলোকে বাস্তবসম্মত ধ্যানধারণা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে এবং তাদের এই গবেষণায় সরকারকে সব রকম সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে। বাস্তবে আমাদের দেশে গবেষণার সীমাবদ্ধতা এখনো এত বেশি যে তা রীতিমতো লজ্জাকর। এ জন্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সর্বোপরি, সরকারকে আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সেসব পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। কেবল কাগজে-কলমে এক শ বা দেড় শ বছরের পরিকল্পনা নিলেই হবে না। সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি যেমন ত্বরান্বিত করতে হবে, তেমনি এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতা যথাসাধ্য ধরে রাখার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাজকর্মের সঙ্গে সরকারি উদ্যোগের সমন্বয় সাধনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমাদের সম্পর্কে অতি পুরনো ও অতি প্রচলিত কিছু শ্লেষ আছে। যেমন_বাঙালি দাঁত থাকতে নাকি দাঁতের মর্যাদা দিতে জানে না কিংবা বিপদ এসে ঘাড়ের ওপর না পড়া পর্যন্ত নাকি আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু অস্তিত্বের প্রয়োজনে অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে আমাদের এসব ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে। সময়ের কাজটি সময় থাকতেই আমাদের সম্পন্ন করার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
No comments