শ্রদ্ধাঞ্জলি-সিরাজ সিকদার-রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে তবু সাহসের পতাকা আজও ওড়ে by আরিফুজ্জামান তুহিন

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতা আছে লাতিন আমেরিকার মহান বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে নিয়ে_'চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়'। চে গুয়েভারা আজ লাতিন আমেরিকা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছেন বিশেষত তরুণ-তরুণীর আইকন হিসেবে। কিন্তু যতটা না তাঁর কমিউনিস্ট বিপ্লব তথা শ্রেণীসংগ্রাম-সমাজতন্ত্র আর শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার নায়ক হিসেবে, এর চেয়ে বেশি পুঁজিবাদের অনুষঙ্গ হিসেবে।


সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট আইকনের বিপরীতে চে হয়ে উঠেছেন পুঁজির পণ্যের মুনাফার সর্বোচ্চকরণের মডেল। এ কারণে মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে দেখা যায় মদের বোতলে অথবা অন্তর্বাসে। পুঁজিবাদের এই হলো শক্তি যে পুঁজি তার মুনাফার জন্য এর বিপরীত আর্দশকেও কাজে লাগিয়ে থাকে।
সিরাজ শিকদার বাংলার রাজনীতিতে অপাঠ্য এক অধ্যায়। আসছে ২ জানুয়ারি সিরাজ সিকদারের ৩৫তম প্রয়াণ দিবস। কেউ তাঁকে বাংলার চে গুয়েভারা, চারু মজুমদার আর কেউবা তাঁকে সন্ত্রাসবাদীদের নেতা মনে করেন। আমাদের ইতিহাস সব সময় সাদা আর বিজয়ীদের পক্ষে ওকালতি করতে করতে বিজয়ীদের সভাকবিতে পরিণত হয়েছে। আর যা-ই হোক, সভাকবির বয়ানে বিজয়ীদের লুণ্ঠন উঠে আসে না। ইতিহাস যা-ই বলে বলুক, ইতিহাস চেতনার জায়গা থেকে দেখলে এ প্রচেষ্টাকে সাহসের পাহাড় ডিঙানোর নায়ক হিসেবেই উত্তর সময় একদিন মূল্যায়ন করবে। ইতিহাস তো বর্ণবাদী উচ্চশ্রেণীর। তা না হলে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাকামী বীর যোদ্ধাদের কি সন্ত্রাসী আর সাদা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দস্যুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনকে বলে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন? এই হলো ইতিহাসের এলেম বোধ! কিন্তু এই জনপদের মানুষ তো জানে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি আর ভগৎ সিংদের সাহস ও ভালোবাসার উপাখ্যান। সিরাজ সিকদারও সেই উপাখ্যানের নায়ক হিসেবে একদিন ছাইচাপা ইতিহাস থেকে ফিনিঙ্ পাখির মতো বেরিয়ে আসবেন।
সাহসের সীমানা কত দূর? যাঁরা ইকারুসের কথা জানেন তাঁরা স্বীকার করবেন যে ইকারুস বাবার ভবিষ্যদ্বাণী অমান্য করে মোমের পাখায় ভর করে উড়ে গেলেন সূর্যের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে গলে গেল তাঁর মোমের পাখা। ইকারুস সাগরে ডুবে মারা গেলেন। তবে মানবজীবনের আজন্ম সাধ স্বাধীনতার প্রশ্নে সেই অমীমাংসিত জনগণের স্বাধীনতা, ক্ষমতায়নের আন্দোলন কিন্তু ইকারুসের মোমের পাখা শক্তি জোগায়, যতটা না জোগায় গান্ধীর শান্তিবাদী আন্দোলন। বাংলার ইকারুসের, সিরাজ সিকদারের বয়স যখন মাত্র ২৩, তখন তিনি তৈরি করলেন মাও সে তুং গবেষণাগার। একবার ভাবুন তো, চুল-দাড়ি পেকে যাওয়া রাজনীতিবিদরা যখন পাকিস্তানের সঙ্গে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের চোরাগলিত হাত-পা ডুবিয়ে হা-পিত্যেশ করছেন, তখন মাত্র ২৪ বছরের যুবক সিরাজ সিকদার বললেন, দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করতে হবে। সিরাজ সিকদার স্বাধীন পূর্ব বাংলার জন্য কারা শত্রু, কারা মিত্র_তার বিস্তারিত তত্ত্বায়ন করে জাতির সামনে হাজির করলেন ঐতিহাসিক পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস। আজকের ডিজে আর ডিজুস প্রজন্মের ২৪ বছর বয়সী বন্ধুরা কী করে_এমন প্রশ্নের উত্তরে কোনো আশাব্যঞ্জক কথা শোনা যাবে না। আজকের তরুণ-তরুণীরা রাজনীতিকে ঘৃণা করে, কারণ আমাদের দেশের প্রধান ধারার দৈনিক পত্রিকাগুলো দেশজুড়ে যে বিরাজনীতিকরণের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে এবং তা সফল হয়েছে বলতেই হয়। ফলে এই তরুণ-তরুণী বড়জোর পত্রিকার পাঠক পাতায় নিজেদের যুক্ত রাখে। ভাবখানা এমন যে রাজনীতি মুক্ত হলে, রাজনীতি থেকে যে যত দূরে থাকবে সে তত বেশি স্মার্ট আর বুদ্ধিমান। অথচ তরুণ-তরুণী জানে না যে রাজনীতির জ্ঞান বর্জিত মানে অসম্পূর্ণ-আনস্মার্ট জীবন।
ইসলামী অথবা কমিউনিস্ট_দুই ঘরানার মানুষই হয় আরব নতুবা চীন-রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে হা-পিত্যেশ করে। সিরাজ সিকদার সেসব পরনির্ভরশীল রাজনীতিকের কাছে বিস্ময়। তিনি এই ভূমির হাজার হাজার বছরের অর্জিত মানুষের জ্ঞান কাঠামোকে কাজে লাগালেন। সিরাজ সিকদার ৩ জুন, ১৯৭১ সালে তৈরি করলেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। প্রলেতারিয়েতের এত সুন্দর বাংলা 'সর্বহারা' এর আগে কোনো বিপ্লবী কল্পনা করতে পেরেছেন কি না, ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না। তিনি জাতিতে খাঁটি বাঙালি। আর পশ্চিম বাংলার দাদাদের ভাষায় বাঙাল। দৃষ্টিভঙ্গিতে মার্কসীয় আন্তর্জাতিক।
বাংলাদেশের চারপাশে দক্ষিণ এশিয়ার আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র ভারত। ভারতের পেটের মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চোখে বিস্ময়। সেই দেশের লাল-সবুজের পতাকা আজও অনমনীয় তেজিভাবে পত পত করে ওড়ে; এই প্রিয় পতাকা সিরাজ সিকদারের নিজের হাতে তৈরি করা। ১৯৭০ সালের ৮ জানুয়ারি সংগঠনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়া এই পতাকায় সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য। অথচ বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামো এমনই অকৃতজ্ঞ যে সিরাজ সিকদারকে সেই স্বীকৃতিটুকুও দেয়নি।
লেখাটির শুরু হয়েছিল আইকন দিয়ে। কার আইকন কে ছিনতাই করে। সিরাজ সিকদার সাহসের একটি নাম। আমাদের কুদো মধ্যবিত্ত স্বপ্নহীন তরুণ-তরুণী কার কাছে স্বপ্ন জমা দিয়ে যাচ্ছে প্রতি দিন, প্রতি রাত? মানুষের জন্ম মানুষ একবারই পায়। সে জীবন যখন আর জীবনের মধ্যে থাকে না, তখন আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।
আজ যখন রাষ্ট্রজুড়ে শাসকশ্রেণীর নৈরাজ্য, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, গুমহত্যা, অনাহারী শীতার্ত মানুষের মৃত্যুর মিছিল; ঠিক তখন আমাদের বেছে নেওয়ার খুব দরকার মানুষের জীবন। একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশের নাগরিক হিসেবে পাওনা বুঝে নেব, নাকি বহুজাতিক করপোরেটের কনিষ্ঠ কেরানি (জুনিয়র এঙ্উিকিউটিভ) হয়ে দিন গুজরান করব? সময় আজ সেই হিসাব-নিকাশের।

No comments

Powered by Blogger.