চারদিক-পদ্মায় বিকেলের রং

যেদিন পদ্মায় বেড়াতে যাওয়া নিয়ে আলাপ হলো, সেদিন অনেকেই উৎসাহ দেখালেন। তাৎক্ষণিক ১০-১২ জনের একটা দল তৈরি হলো। আলোচনা করে ঠিক করা হলো দিন-ক্ষণও। কিন্তু পূর্বাভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারি, ১০-১২ জনের দলটি বাঙালির স্বভাবসুলভ নিয়মে সংকুচিত হয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত কতজন টিকে থাকবেন, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। এদিকে আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ভ্রমণের মূল উদ্যোক্তা শাহজাহান মৃধা বেনু।


শেষ পর্যন্ত আমার আশঙ্কাই সত্যি হলো। নানা অজুহাত দেখিয়ে সিংহভাগ কেটে পড়ল। সর্বশেষ উইকেটের পতন ঘটল যাওয়ার দিন সকালবেলা। শেষ পর্যন্ত রইল বাকি চার—আমি, আলী ইমাম, খন্দকার যুবায়ের হাসান আর শাহজাহান মৃধা বেনু।
বুড়িগঙ্গা পার হওয়ার পরপরই শরতের (তখনো শরৎ শেষ হয়নি) অনুপম দৃশ্য ভেসে উঠল। একটু আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। শরতের ভেজা বাতাসে পরিযায়ী ঋতুর আগমনী বারতা ছড়ানো। শুভ্র কাশফুলে ঢেউ তুলছে বাতাস। সড়কের দুই পাশে থই থই পানি। কোথাও বিরান মাঠ, কোথাও সবুজ ধানের গালিচা। নিমতলা বাজারে এসে থামতে হলো আমাদের। বিক্রমপুরের বিখ্যাত পাতক্ষীর খাওয়া হবে। বেনু ভাই একটা খানদানি মিষ্টির দোকানে নিয়ে গেলেন। এ দোকানের মিষ্টি-মণ্ডার খ্যাতি আছে। সময়স্বল্পতার কারণে দ্রুত উঠতে হলো আমাদের। তবে অবশ্যই খাওয়ার পর।
আগে থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল, আমরা সরাসরি মাওয়া ঘাট না গিয়ে প্রথমেই দোহার উপজেলায় অবস্থিত সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বাংলোটি দেখব। এ কারণেই প্রধান সড়ক ছেড়ে ডান দিকে আরেকটি সড়ক ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম। তবে সেখানে যাওয়ার মূল সড়কটা মূলত শ্রীনগর-ভাগ্যকুল সড়ক। একটু পরই বেনু ভাই একটা সুসংবাদ দিলেন, দুজন বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মভিটা দেখার সুযোগ হবে আমাদের। মাসুরগাঁও সেতু পেরিয়ে কোয়ার্টার কিলোমিটার পার হলেই ডান দিকে স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি। গ্রামের নাম রাঢ়িখাল। একই গ্রামে কবি হুমায়ুন আজাদেরও জন্ম। আমরা এ দুজন আলোকিত মানুষের ভিটেমাটি ছুঁয়ে দেখি। আলোর মশাল হাতে তাঁরা উঠেছিলেন স্বর্ণশিখরে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সওজ বিভাগের এ বাংলোয় আরও আগেই আমাদের এসে থাকার কথা ছিল। থাকা মানে এক দিনের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ। বাংলোটা বেশ ছিমছাম, পরিপাটি। সামনে খোলামেলা চত্বর। মাত্র কয়েক গজের মধ্যেই পদ্মা। বাংলো আর পদ্মার মাঝখানে শুধু একটি পথ। বেড়ানোর জায়গা হিসেবে উৎকৃষ্ট। ভরবর্ষায় পদ্মা যখন অনেক প্রশস্ত হয়, তখন চান্নিপসর রাতে তার অন্য রকম সৌন্দর্য দেখার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করে চলেছি দীর্ঘদিন। একদিন হয়তো ভরা পূর্ণিমায় ছুঁয়ে দেখতে পাব তাকে। ওদিকে সুতোয় টান পড়ছে। যেতে হবে পদ্মার আরেক প্রান্তে। তারপর পদ্মা পাড়ি দিয়ে একবারে চরায়।
আবার ছুট। অন্য আরেকটি পথে যখন মাওয়া ঘাটে এসে পৌঁছাই, তখন মধ্যদুপুর। পেটের জন্য খানিকটা সময় বরাদ্দ করা হলো। নদীর পাড়ের একটি হোটেলে গিয়ে বসলাম। পদ্মার তরতাজা ইলিশভাজা দিয়ে সংক্ষিপ্ত ভোজ।
এ পদ্মার পাড়েই বেনু ভাইয়ের জন্ম। সাত পুরুষের ভিটাবাড়িও এখানেই। এ কারণে এখানে দুর্ভেদ্য একটা ঘাঁটিও তৈরি করেছেন তিনি! তাঁর ভাষায় যাবতীয় ‘ষড়যন্ত্রের’ সুবিধাজনক স্থান পদ্মার চর। এখানে সারা বছরে কয়েকবার সদলবলে আসেন ঘুড়ি ওড়াতে। ইতিমধ্যেই তাঁর স্থানীয় ‘ষড়যন্ত্র’ দলের সদস্যরা নৌকায় সবকিছু তুলে দিয়েছেন। তাতে চা-কফি থেকে শুরু করে লাইফ জ্যাকেট পর্যন্ত আছে। সবাই ওঠার পর ছেড়ে দেওয়া হলো নৌকা।
পড়ন্ত বিকেলে আমরা ছোটখাটো ধরনের একটা চরে নামলাম। চারপাশে ঘন কাশবন। সাদা পালকে ঢেউ খেলছিল বাতাস। কোথাও কোথাও কাইচ্চা আর নলখাগড়ার ঝোপ। নৌকা থেকে একের পর এক ঘুড়ি নামতে শুরু করল। তারপর ডানা-পাখা লাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হলো আকাশে। আমার ভাগে পড়ল একটা নাটাই। ওই ঘুড়িটা নাকি নিরীহ ধরনের! আমাকে উড়িয়ে নিয়ে নদীতে ফেলবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নানা রং আর গড়নের ঘুড়ি উড়ল আকাশে। এ চরায় আগে থেকেই দুটো ছোট জেলেনৌকা ভেড়ানো ছিল। ঘুড়ির কায়কারবার দেখে ওই নৌকা থেকে তিনটি কিশোর ছেলে বেরিয়ে এল। ওরাও বেশ আগ্রহ নিয়ে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। তারপর সন্ধ্যার আনমনা বাতাস আমাদের জানিয়ে দিল, এখন আর ঘুড়ি ওড়ানোর সময় নেই। আমরা গোল হয়ে বসি। চা-বিস্কুট আর মটরভাজা খেতে খেতে নানা গল্পে মেতে উঠি। এই বিচ্ছিন্ন পলিভূমি আমাদের ভেতর কিছুক্ষণের জন্য হলেও অন্য রকম এক অনুভূতি তৈরি করে।
এবার ফিরতে হবে। বেনু ভাই জানালেন, তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী মি. ইসমাইল আটকা পড়েছেন অন্য আরেকটা ঘাটে। তিনি আসছিলেন এখানেই, বোটচালক স্থানটি শনাক্ত না করতে পারায় এ বিপত্তি। সুতরাং, তাঁকে উদ্ধার করে তবেই আমাদের ফিরতে হবে। সব মালপত্র বোঝাই করে আমাদের নৌকা চলল সেই মাঝির ঘাটের উদ্দেশে। ইসমাইলকে উঠিয়ে নিয়ে আবার আমাদের নৌকা ঘুরল মাওয়ার দিকে। বিচ্ছিন্ন গল্প-আড্ডায় পদ্মার বুকে রাতের ভ্রমণটা বেশ জমে উঠল আমাদের। অনেক দূর থেকেই ঘাটের আলো দেখা যাচ্ছিল। আমাদের জানা ছিল না যে শেষ ‘ষড়যন্ত্র’ নামে আরেকটা কিছু সবার জন্য অপেক্ষা করছিল। একটু পরই উন্মোচিত হলো রহস্য। রাতের আকাশে উড়ল একটা বাতিওয়ালা ঘুড়ি। অপূর্ব সেই দৃশ্য। বিচিত্র রঙের বাতিগুলো জ্বলছিল আকাশে। নৌকা চলছে, ঘুড়িও চলছে আমাদের সঙ্গে। আশপাশের নৌকার যাত্রীরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে রাতের এ তারকা ঘুড়ির দিকে।
 মোকারম হোসেন
tarupallab@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.