সহজ-সরল-তাঁদের কিছু ঋণ না হয় শোধ করি by কনকচাঁপা
মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা, বিপন্ন অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দেওয়া, সারা বিশ্বের মানচিত্রে ছোট্ট একটা ঘাসফুলের মতো স্পর্ধার সঙ্গে স্থান করে নেওয়া_এগুলো এক জীবনে অনেক অনেক বেশি পাওয়া। এমন দেশে জন্ম নেওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এ দেশে জন্মে আমি ধন্য। যে দেশে মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দেয়, মা-বাবা অস্ত্র হাতে ছেলেকে যুদ্ধে পাঠান, মমতাময়ী নারীরা শাকপাতা কুড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গরম ভাত খাওয়ান, খুব সাবধানতায় তার গুলিবিদ্ধ
জায়গায় পুলটিস দিয়ে দেন, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহসের গান গান_সেই দেশে নিঃশ্বাস নেওয়ার স্বাদই আলাদা। এই দেশ যেমন লাখো প্রাণের দামে কেনা, ঠিক যারা আমরা বেঁচে আছি, তাদের কাছে হীরক সমান মূল্যবান এবং সবচেয়ে মূল্যবান আমাদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? আসলে তা নয়। আমরা এত দিনে বোধ হয় সবাই তা জানি এবং জেনেও তা না জানার ভান করি। এবং বলি কাব্য করে_তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না! ঋণ নিলে তা শোধ দিতে হয়। তা না হলে জেল-জরিমানা ও পরকালে পাপ হয়। তাঁরা ভালোবেসে জীবন দিয়ে, মা-বোনের ইজ্জত দিয়ে, পঙ্গুত্ববরণ করে আমাদের হাতের তেলোয় একটা উচ্চ স্পর্ধার মানচিত্র এনে দিলেন_আমরা তার কোনো মূল্য পরিশোধ করলাম না এবং সেটা না করেই গ্রহণ করলাম! তাঁদের কিছু উপাধি দেওয়া হলো, সনদপত্র দেওয়া হলো, চাকরিতে কিছু সুবিধা দেওয়া হলো_তারপর তা ধীরে ধীরে ধূসর স্মৃতিতে পরিণত হলো। মুক্তিযুদ্ধের অপ্রতিরোধ্য শক্তি, তাজা প্রাণ, মনোবল_এসব কি ভুলে যাওয়ার? আমাদের অনেক যোদ্ধা আছেন, যাঁরা ভিক্ষুক ও রিকশাচালক! কী বলব_মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু দেখেশুনে ও পড়ে বুঝতে পারি, ভয়ংকর কঠিন ও ঘৃণ্যতম পদ্ধতির এই যুদ্ধকে আমাদের যোদ্ধা ভাইয়েরা 'জলবৎতরল' করে স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়েছেন। রক্ত তো জলবৎতরলই_নাকি! যতসংখ্যক বেঁচে থাকা যোদ্ধা ও শহীদ পরিবার আছেন, তাঁদের জনে জনে বাড়ি, চাকরি, ব্যবসা_সব কিছু দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়, তবে যা দেওয়া হচ্ছে, তার দশ গুণ বেশি দেওয়া যেতেই পারে। একজন মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের একটা গাড়ির দামে কয়টা যোদ্ধা পরিবার কত মাস, বছর খেতে পারেন তার হিসাব করা কি খুবই কঠিন? ইদানীং তো শুনছি, মুক্তিযোদ্ধা সনদও জাল হচ্ছে। ছিঃ ছিঃ! তবে কি আমরা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, তাদের চেয়েও খারাপ হওয়ার স্বাক্ষর রাখব? আমি শুনতে চাই না, 'আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি'। মুক্তিযোদ্ধারা লেমিনেট করা সনদ নিয়ে ভিক্ষুকরূপে কাছে এসে দাঁড়ালে মনে হয়, এ দৃশ্য দেখার চেয়ে পরাধীন থাকাই ভালো ছিল। একেক রাজনৈতিক ঘরানা গদিতে বসে, আর তখনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলে যায়। এ বছর পাঠ্য বইয়ে শিশুরা এক ইতিহাস পড়ে তো আরেক বছর অন্য ইতিহাস পড়ে! কী ভয়ংকর হাস্যকর। আমার মনে হয়, ইতিমধ্যেই নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়ে এই ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আমরা জানি, জাতিগতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের এই ঋণ শোধ করা যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারের পয়সার ঝোলা থেকে এই ঋণের কিছুটা ভার মুক্ত করা খুবই যাবে। পুরো বাঙালি জাতির একজন এই আমি, সবার হয়ে দাবি করছি_কাব্য করে 'তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না' না বলে, তাঁদের ঋণগুলো যতটুকু পারি শোধ করে দিই। সুদে-আসলে এই বেলা কিন্তু অনেক দেনা বেড়ে যাচ্ছে। সময়মতো শোধ না করলে দেউলিয়া হতে হবে! আরেকটা কথা বলি_বরেণ্য মানুষ, শিল্পী, গীতিকার-সুরকার শ্রদ্ধেয় খান আতাউর রহমান এই গানটি লিখেছিলেন তাঁর বাম অলিন্দ থেকে রক্তকে কালি করে_ভালোবাসার ছন্দে। কিন্তু এমন ঋণ শোধ না করার ফন্দির কূটনৈতিক কূটচালের বেড়াজালের কথা জানলে তিনি এ গান লিখতেনই না। তাই সমগ্র জাতি ও সরকারকে বলি_আসুন, আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক প্রাপ্য, সঠিকভাবে যতটা পারি পরিশোধ করে দিই। তাঁরা পেটের ক্ষুধায় লেমিনেট করা সনদ নিয়ে হাত বাড়ালে পুরো জাতিকেই ভিক্ষুকের সারিতে চোখে পড়ে। আরেকটা কথা আমি নিজেকে ও সবাইকে বলি_স্বাধীনতার অর্থ উচ্ছৃঙ্খলতা নয়। স্বাধীনতা মানে শিক্ষিত, বিবেকসম্পন্ন, সত্য, সভ্য, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একটা জীবন_যা অতিক্রান্ত করে সত্যিকারের 'মানুষ' নামের মাইলফলকে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো যায়। আমি সত্যিকারের স্বাধীন হতে চাই।
লেখক : সংগীতশিল্পী
লেখক : সংগীতশিল্পী
No comments