কল্পকথার গল্প-দেশপ্রেম প্রমাণের উপায় by আলী হাবিব
প্রেম জিনিসটা একেবারেই আপেক্ষিক। ভালোবাসতে জানতে হবে। না জানলে ভালোবাসা হবে না। প্রেমের নমুনা তো কতই আছে। শিরি-ফরহাদ, লাইলী-মজনুর গল্প যেমন আমাদের জানা, তেমনি আমরা জানি চণ্ডীদাস-রজকিনির গল্পও। প্রেমের এক-একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। লিজেন্ডারি প্রেমিক এক-একজন। ইতিহাস ঘেঁটে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। না, ভুল বলা হলো। পাওয়া যাবে। সেই যে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড প্রেমের জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন।
হালের প্রিন্স চার্লসই বা কম যাবেন কিসে? বুড়ো বয়সে প্রেমের উদাহরণযোগ্য রেকর্ড তো তিনিও গড়েছেন। এই প্রেমের সঙ্গে দেশপ্রেমের তুলনা করে লাভ নেই। দেশপ্রেম আর এমনি প্রেম এক জিনিস নয়। যে কেউ প্রেমে পড়তে পারে, প্রেমে পড়ার স্বাধীনতা সবার আছে। কিন্তু দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখানোর যোগ্যতা কয়জনের থাকে? ওটা অর্জন করতে হয়। হ্যাঁ, একাত্তরে বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছিল দেশপ্রেম কাকে বলে। বাঙালির দেশপ্রেম আজও তাই উদাহরণ হয়ে আছে। কিন্তু আজকের দিনে কী অবস্থা? আজকের দিনে দেশপ্রেমিক কারা?
একটা বিষয় সবাই স্বীকার করবেন, সময় পাল্টেছে। একুশ শতক বলে কথা! আজকের দিনে তো আর সেই বিংশ শতাব্দীর ধ্যান-ধারণা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আগেকার দিনে প্রেম ভেসে বেড়াত বাতাসে। কেমন করে? গানেই তো আছে, 'এক পলকে একটু দেখা'। সেই একটু দেখা থেকে অনুরাগের সৃষ্টি। আহা কী সব দিন! বারান্দায় হালকা হাওয়ায় একটুখানি আঁচল উড়ল কী প্রেমিকের হৃদয় পুড়ল। ঘরের জানালার পর্দা একটু নড়ল, প্রেমিকের মনের ভেতর ঝড়। এই বুঝি দেখা দিল! কী সে করুণ আর্তি, 'চাঁদ কেন ওঠে না আমার ঘরে।' ওদিকে আরেকজন মনে মনে বলছে, 'ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না'। না, ইশারার দিন গেছে। চিঠি-চাপাটি এখন আর চলে না। কী সব ঝক্কি গেছে। চিঠি একটা লেখা হলো, কিন্তু সেটা কাঙ্ক্ষিতার হাতে কেমন করে পেঁৗছানো যাবে? মাধ্যম খুঁজতে হতো। মাধ্যম পাওয়াটাও কি চাট্টিখানি ব্যাপার? পাওয়া না গেল তো নিজের হাতের নিরিখ পরীক্ষার পালা। চিঠি দলা পাকিয়ে বাড়িতে ছুড়ে মারা। সে চিঠি অন্যের হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই। এসব তো সেদিনের কথা। আজকের দিনে এমন কেউ ভাবতেই পারে না। মোবাইল ফোনে একটা-দুটো শব্দের এসএমএস পাঠালেই হয়ে গেল। ওদিকে রাতভর ফেসবুক তো আছেই। মোট কথা, প্রেমের পথে এখন তেমন কোনো বাধাই নেই। সবাই এখন যুগের তারে বাঁধা পড়েছে। কিন্তু এসএমএস, ফেসবুক দিয়ে তো আর দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পাস করা সম্ভব নয়। জনসেবার ভেতর দিয়ে দেশপ্রেমের প্রমাণ রাখা সম্ভব। কিন্তু জনসেবার সুযোগ তো সবার আসে না। এটা অনেকটা পরীক্ষার মতো। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পাস করার একটা সহজ রাস্তা হচ্ছে রাজনীতি। এই পথ ধরে হাঁটতে হলে ধৈর্য থাকতে হয়। ধৈর্য ধরতে জানতে হয়। অধৈর্য হলে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কাটাই বেশি থাকে। অনেকটা গাছে চড়ার মতো। একটু একটু করে উঠতে হয়। আবুল মুনসুর আহমদের গল্পটা অনেকেরই জানা। সেই যে এক ভদ্রলোকের শখ হয়েছিল জনগণের সেবা করার। তিনি এলাকার মানুষকে সেই কথা বলে বেড়াতে শুরু করলেন। জনসেবার পথ খুঁজতে কিংবা জনসেবা করতে তিনি ভোটে দাঁড়িয়ে গেলেন। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। কিন্তু মেম্বারদের ক্ষমতা অনেক সীমিত। তিনি তাঁর ইচ্ছেমতো জনসেবা করতে পারেন না। নিজের এই দুঃখের কথা এলাকার মানুষকে জানাতেই এলাকার লোকজন তাঁকে চেয়ারম্যান বানিয়ে দিল। কিন্তু তার পরও তিনি ইচ্ছেমতো জনগণের সেবা করতে পারেন না। কেন? ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা আছে। কিন্তু সে ক্ষমতাও খুব বেশি নয়। কী হবে এবার? ভদ্রলোকের জনসেবার, দেশসেবার ইচ্ছে কি মরে যাবে? তাঁর এত দিনের শখ কি পূরণ হবে না! এবার ভদ্রলোককে তাঁর এলাকার লোকজন এমপি বানিয়ে দিল। ভদ্রলোক এমপি হয়ে সংসদে গেলেন। কিন্তু সেবা করতে পারেন না তিনি। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া তখনো বাকি। তিনি এলাকার লোকজনের কাছে সেই দুঃখের কথা বলেন। কেমন করে কেন্দ্রের মন্ত্রীরা সব নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতেই পারছেন না, সেই দুঃখের কথা শোনার পর এলাকায় বিক্ষোভ হলো। এবার তাঁকে মন্ত্রী বানাতে হবে। এলাকার মানুষের চাপে ভদ্রলোককে মন্ত্রী বানিয়ে দেওয়া হলো। এরপর কী হলো? ভদ্রলোক দেশপ্রেমে এতই মশগুল হয়ে গেলেন যে এলাকার মানুষকে আর দেখাই দিতে পারেন না! হতেও তো পারে। প্রেমের জন্য যদি অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়, দেশপ্রেমের জন্য তো আরো বেশি কিছু ত্যাগ করা প্রয়োজন। নিন্দুকদের ভাষায়, এটাই হচ্ছে রাজনীতি। এখানে একবার কেউ ওপরে উঠে গেলে নিচের কথা ভুলে যায়। নাকি পরিবেশটাই এমন যে ভুলে যেতে হয়? ভুলে যেতে বাধ্য করা হয়। দেশের জন্য যাঁদের ভাবনার অন্ত নেই, তাঁদের নিন্দুকের অভাব নেই। নিন্দুকদের কাজই হচ্ছে নিন্দা করা। ভালো কিছু নিন্দুকদের চোখেই পড়ে না। আধুনিক বিশ্বে রাজনীতিবিদদের চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক নেই। কিন্তু রাজনীতি যাঁদের ধ্যান-জ্ঞান, তাঁদের নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। কেউ ভাবেন না, দেশের জন্য কাজ করতে গেলে অন্য কিছু ভাবা যায় না। এমনকি জনগণকেও ভুলে যেতে হয়। দেশপ্রেম বলে কথা! অনেকে বলে থাকেন, ক্ষমতায় যাওয়ার আগে রাজনীতিবিদরা যেসব কথা বলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার পর সব কথা ভুলে যান। এসব নিয়ে সমালোচনা হয়। গল্প লেখা হয়। আজকের দিনের কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল, সেই গোপাল ভাঁড়ের আমলেও এই কথা রাখা-না রাখা নিয়ে গল্প তৈরি হয়েছে। শোনা যাক।
গোপাল ভাঁড়ের এই গল্পটা আপনারা জানেন। রাজা বললেন, শীতের রাতে কেউ কি সারা রাত এই পুকুরে গলাপানিতে ডুবে থাকতে পারবে? যদি কেউ পারে, আমি তাকে অনেক টাকা-পয়সা-ধনরত্ন পুরস্কার দেব।
এক ছিল গরিব-দুঃখী মানুষ। সে বলল, আমি পারব।
সে মাঘ মাসের তীব্র শীতে সারা রাত পুকুরের পানিতে গলা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ভোরে সে উঠল পানি থেকে। রাজার কাছে গিয়ে সে বলল, আমি সারা রাত পুকুরের পানিতে ছিলাম। আপনার সান্ত্রি-সেপাই সাক্ষী। এবার আমার পুরস্কার দিন।
রাজা বললেন, সেকি, তুমি কেমন করে এটা পারলে?
গরিব লোকটা বলল, আমি পানিতে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকলাম। দূরে, অনেক দূরে এক গৃহস্থবাড়িতে আলো জ্বলছিল। আমি সেদিকে তাকিয়ে থেকে সারা রাত কাটিয়ে দিলাম।
মন্ত্রী বলল, পাওয়া গেছে। এই যে দূরের প্রদীপের আলোর দিকে ও তাকিয়ে ছিল, ওই প্রদীপ থেকে তাপ এসে তার গায়ে লেগেছে। তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে এই শীতেও ওই পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
রাজা বললেন, তাই তো! তাহলে তো তুমি আর পুরস্কার পাবে না। তাকে বিদায় করে দেওয়া হলো।
গরিব লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিল। সে গেল গোপাল ভাঁড়ের কাছে। অনুযোগ জানাল তাঁর কাছে। সব শুনে গোপাল ভাঁড় বললেন, ঠিক আছে, তুমি ন্যায়বিচার পাবে।
গোপাল ভাঁড় দাওয়াত করলেন রাজাকে। দুপুরে খাওয়াবেন। রাজা এলেন গোপাল ভাঁড়ের বাড়িতে। গোপাল ভাঁড় বললেন, আসুন, আসুন। আর সামান্যই আছে রান্নার বাকি। কী রাঁধছি দেখবেন, চলুন।
গোপাল ভাঁড় রাজাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির পেছনে। সেখানে একটা তালগাছের ওপর একটা হাঁড়ি বাঁধা আর নিচে একটা কুপিবাতি জ্বালানো।
গোপাল ভাঁড় বললেন, ওই যে হাঁড়ি, ওটাতে পানি, চাল, ডাল, নুন সব দেওয়া আছে। এই তো খিচুড়ি হয়ে এল বলে। শিগগিরই আপনাদের গরম গরম খিচুড়ি খাওয়াচ্ছি।
রাজা বললেন, তোমার বাড়িতে দাওয়াত খাব বলে সকাল থেকে তেমন কিছু খাইনি। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এখন এই রসিকতা ভালো লাগে!
রসিকতা কেন, রান্না হয়ে এল বলে, বললেন গোপাল ভাঁড়।
রাজা বললেন, তোমার ওই খিচুড়ি জীবনেও হবে না, আমার আর খাওয়াও হবে না। চলো মন্ত্রী, ফিরে যাই।
গোপাল বললেন, মহারাজ, কেন খিচুড়ি হবে না। দূরে গৃহস্থবাড়িতে জ্বালানো প্রদীপের আলো যদি পুকুরের পানিতে ডুবে থাকা গরিব প্রজার গায়ে তাপ দিতে পারে, এই প্রদীপ তো হাঁড়ির অনেক কাছে। নিশ্চয়ই খিচুড়ি হবে।
রাজা ভুল বুঝতে পারলেন। এ ঘটনার পর সত্যি সত্যি গরিব লোকটাকে অনেক পুরস্কার দিয়েছিলেন।
কিন্তু এখন? না খুঁজলেও অনেক ভাঁড় পাওয়া যাবে এখন। কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করেন তাঁরা।
যা হোক, দেশপ্রেম নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেখানেই যাওয়া যাক। দেশপ্রেমের নমুনা কেমন হতে পারে? এক ভদ্রলোক রাজনীতিতে নেমেছেন। শুরু করেছেন ঘরোয়া রাজনীতি দিয়ে। অর্থাৎ মাঠের বক্তৃতা তখনো শুরু করেননি। ছোটখাটো হলরুম ভাড়া করে লোকজন ডেকে নিজের কথা বলেন। তো একদিন তাঁর মনে হলো, তিনি দেশপ্রেমের নমুনা দেখাবেন। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। তিনি লোকজন ডেকে বক্তৃতা করতে গেলেন। কেমন সে বক্তৃতা? নমুনা দেওয়া যাক।
'ভাইসব, এই যে আমাকে দেখছেন, আমি পুরোপুরি দেশপ্রেমিক। আমি সব সময় দেশের পণ্য কিনে ধন্য। এই যে কোট পরেছি আমি, এটা দেশের কাপড় দিয়ে দেশের দর্জি তৈরি করেছে।' তিনি কোটটা খুলে ফেললেন। 'গায়ে যে জামাটা দেখছেন, এটাও দেশের কাপড়।' তিনি জামাটা খুলে ফেললেন। 'এই যে প্যান্টটা পরেছি, এটাও দেশের তৈরি।' তিনি প্যান্টটা খুলে ফেললেন। মঞ্চের সামনে এসে বললেন, 'এই যে আন্ডারওয়্যার দেখছেন, এটাও দেশের তৈরি।' দর্শকসারিতে সবাই হাসাহাসি করতে শুরু করলে ভদ্রলোক জামা-প্যান্ট পরে বাড়িতে ফিরে গেলেন।
বাড়িতে ফিরে স্ত্রীকে বললেন, আমি দেশপ্রেমের নমুনা দেখাতে গেলাম, সবাই হাসাহাসি করল কেন? স্ত্রী জানতে চাইলেন, কেমন করে তিনি নমুনা দেখাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক বর্ণনা দিলেন। বললেন, যখনই আন্ডারওয়্যার দেখাতে গেছি, তখনই হাসাহাসি। ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, তোমার তো একটাই আন্ডারওয়্যার। ময়লা হয়ে যাওয়াতে ওটা আজ ধুয়ে দেওয়া হয়েছে। তুমি আজ আন্ডারওয়্যার ছাড়াই প্যান্ট পরে গিয়েছিলে।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : মেকি দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে অরিজিনাল ভেতরটা দেখিয়ে দেবেন না।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
একটা বিষয় সবাই স্বীকার করবেন, সময় পাল্টেছে। একুশ শতক বলে কথা! আজকের দিনে তো আর সেই বিংশ শতাব্দীর ধ্যান-ধারণা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আগেকার দিনে প্রেম ভেসে বেড়াত বাতাসে। কেমন করে? গানেই তো আছে, 'এক পলকে একটু দেখা'। সেই একটু দেখা থেকে অনুরাগের সৃষ্টি। আহা কী সব দিন! বারান্দায় হালকা হাওয়ায় একটুখানি আঁচল উড়ল কী প্রেমিকের হৃদয় পুড়ল। ঘরের জানালার পর্দা একটু নড়ল, প্রেমিকের মনের ভেতর ঝড়। এই বুঝি দেখা দিল! কী সে করুণ আর্তি, 'চাঁদ কেন ওঠে না আমার ঘরে।' ওদিকে আরেকজন মনে মনে বলছে, 'ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না'। না, ইশারার দিন গেছে। চিঠি-চাপাটি এখন আর চলে না। কী সব ঝক্কি গেছে। চিঠি একটা লেখা হলো, কিন্তু সেটা কাঙ্ক্ষিতার হাতে কেমন করে পেঁৗছানো যাবে? মাধ্যম খুঁজতে হতো। মাধ্যম পাওয়াটাও কি চাট্টিখানি ব্যাপার? পাওয়া না গেল তো নিজের হাতের নিরিখ পরীক্ষার পালা। চিঠি দলা পাকিয়ে বাড়িতে ছুড়ে মারা। সে চিঠি অন্যের হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই। এসব তো সেদিনের কথা। আজকের দিনে এমন কেউ ভাবতেই পারে না। মোবাইল ফোনে একটা-দুটো শব্দের এসএমএস পাঠালেই হয়ে গেল। ওদিকে রাতভর ফেসবুক তো আছেই। মোট কথা, প্রেমের পথে এখন তেমন কোনো বাধাই নেই। সবাই এখন যুগের তারে বাঁধা পড়েছে। কিন্তু এসএমএস, ফেসবুক দিয়ে তো আর দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পাস করা সম্ভব নয়। জনসেবার ভেতর দিয়ে দেশপ্রেমের প্রমাণ রাখা সম্ভব। কিন্তু জনসেবার সুযোগ তো সবার আসে না। এটা অনেকটা পরীক্ষার মতো। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পাস করার একটা সহজ রাস্তা হচ্ছে রাজনীতি। এই পথ ধরে হাঁটতে হলে ধৈর্য থাকতে হয়। ধৈর্য ধরতে জানতে হয়। অধৈর্য হলে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কাটাই বেশি থাকে। অনেকটা গাছে চড়ার মতো। একটু একটু করে উঠতে হয়। আবুল মুনসুর আহমদের গল্পটা অনেকেরই জানা। সেই যে এক ভদ্রলোকের শখ হয়েছিল জনগণের সেবা করার। তিনি এলাকার মানুষকে সেই কথা বলে বেড়াতে শুরু করলেন। জনসেবার পথ খুঁজতে কিংবা জনসেবা করতে তিনি ভোটে দাঁড়িয়ে গেলেন। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। কিন্তু মেম্বারদের ক্ষমতা অনেক সীমিত। তিনি তাঁর ইচ্ছেমতো জনসেবা করতে পারেন না। নিজের এই দুঃখের কথা এলাকার মানুষকে জানাতেই এলাকার লোকজন তাঁকে চেয়ারম্যান বানিয়ে দিল। কিন্তু তার পরও তিনি ইচ্ছেমতো জনগণের সেবা করতে পারেন না। কেন? ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা আছে। কিন্তু সে ক্ষমতাও খুব বেশি নয়। কী হবে এবার? ভদ্রলোকের জনসেবার, দেশসেবার ইচ্ছে কি মরে যাবে? তাঁর এত দিনের শখ কি পূরণ হবে না! এবার ভদ্রলোককে তাঁর এলাকার লোকজন এমপি বানিয়ে দিল। ভদ্রলোক এমপি হয়ে সংসদে গেলেন। কিন্তু সেবা করতে পারেন না তিনি। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া তখনো বাকি। তিনি এলাকার লোকজনের কাছে সেই দুঃখের কথা বলেন। কেমন করে কেন্দ্রের মন্ত্রীরা সব নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতেই পারছেন না, সেই দুঃখের কথা শোনার পর এলাকায় বিক্ষোভ হলো। এবার তাঁকে মন্ত্রী বানাতে হবে। এলাকার মানুষের চাপে ভদ্রলোককে মন্ত্রী বানিয়ে দেওয়া হলো। এরপর কী হলো? ভদ্রলোক দেশপ্রেমে এতই মশগুল হয়ে গেলেন যে এলাকার মানুষকে আর দেখাই দিতে পারেন না! হতেও তো পারে। প্রেমের জন্য যদি অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়, দেশপ্রেমের জন্য তো আরো বেশি কিছু ত্যাগ করা প্রয়োজন। নিন্দুকদের ভাষায়, এটাই হচ্ছে রাজনীতি। এখানে একবার কেউ ওপরে উঠে গেলে নিচের কথা ভুলে যায়। নাকি পরিবেশটাই এমন যে ভুলে যেতে হয়? ভুলে যেতে বাধ্য করা হয়। দেশের জন্য যাঁদের ভাবনার অন্ত নেই, তাঁদের নিন্দুকের অভাব নেই। নিন্দুকদের কাজই হচ্ছে নিন্দা করা। ভালো কিছু নিন্দুকদের চোখেই পড়ে না। আধুনিক বিশ্বে রাজনীতিবিদদের চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক নেই। কিন্তু রাজনীতি যাঁদের ধ্যান-জ্ঞান, তাঁদের নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। কেউ ভাবেন না, দেশের জন্য কাজ করতে গেলে অন্য কিছু ভাবা যায় না। এমনকি জনগণকেও ভুলে যেতে হয়। দেশপ্রেম বলে কথা! অনেকে বলে থাকেন, ক্ষমতায় যাওয়ার আগে রাজনীতিবিদরা যেসব কথা বলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার পর সব কথা ভুলে যান। এসব নিয়ে সমালোচনা হয়। গল্প লেখা হয়। আজকের দিনের কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল, সেই গোপাল ভাঁড়ের আমলেও এই কথা রাখা-না রাখা নিয়ে গল্প তৈরি হয়েছে। শোনা যাক।
গোপাল ভাঁড়ের এই গল্পটা আপনারা জানেন। রাজা বললেন, শীতের রাতে কেউ কি সারা রাত এই পুকুরে গলাপানিতে ডুবে থাকতে পারবে? যদি কেউ পারে, আমি তাকে অনেক টাকা-পয়সা-ধনরত্ন পুরস্কার দেব।
এক ছিল গরিব-দুঃখী মানুষ। সে বলল, আমি পারব।
সে মাঘ মাসের তীব্র শীতে সারা রাত পুকুরের পানিতে গলা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ভোরে সে উঠল পানি থেকে। রাজার কাছে গিয়ে সে বলল, আমি সারা রাত পুকুরের পানিতে ছিলাম। আপনার সান্ত্রি-সেপাই সাক্ষী। এবার আমার পুরস্কার দিন।
রাজা বললেন, সেকি, তুমি কেমন করে এটা পারলে?
গরিব লোকটা বলল, আমি পানিতে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকলাম। দূরে, অনেক দূরে এক গৃহস্থবাড়িতে আলো জ্বলছিল। আমি সেদিকে তাকিয়ে থেকে সারা রাত কাটিয়ে দিলাম।
মন্ত্রী বলল, পাওয়া গেছে। এই যে দূরের প্রদীপের আলোর দিকে ও তাকিয়ে ছিল, ওই প্রদীপ থেকে তাপ এসে তার গায়ে লেগেছে। তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে এই শীতেও ওই পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
রাজা বললেন, তাই তো! তাহলে তো তুমি আর পুরস্কার পাবে না। তাকে বিদায় করে দেওয়া হলো।
গরিব লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিল। সে গেল গোপাল ভাঁড়ের কাছে। অনুযোগ জানাল তাঁর কাছে। সব শুনে গোপাল ভাঁড় বললেন, ঠিক আছে, তুমি ন্যায়বিচার পাবে।
গোপাল ভাঁড় দাওয়াত করলেন রাজাকে। দুপুরে খাওয়াবেন। রাজা এলেন গোপাল ভাঁড়ের বাড়িতে। গোপাল ভাঁড় বললেন, আসুন, আসুন। আর সামান্যই আছে রান্নার বাকি। কী রাঁধছি দেখবেন, চলুন।
গোপাল ভাঁড় রাজাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির পেছনে। সেখানে একটা তালগাছের ওপর একটা হাঁড়ি বাঁধা আর নিচে একটা কুপিবাতি জ্বালানো।
গোপাল ভাঁড় বললেন, ওই যে হাঁড়ি, ওটাতে পানি, চাল, ডাল, নুন সব দেওয়া আছে। এই তো খিচুড়ি হয়ে এল বলে। শিগগিরই আপনাদের গরম গরম খিচুড়ি খাওয়াচ্ছি।
রাজা বললেন, তোমার বাড়িতে দাওয়াত খাব বলে সকাল থেকে তেমন কিছু খাইনি। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এখন এই রসিকতা ভালো লাগে!
রসিকতা কেন, রান্না হয়ে এল বলে, বললেন গোপাল ভাঁড়।
রাজা বললেন, তোমার ওই খিচুড়ি জীবনেও হবে না, আমার আর খাওয়াও হবে না। চলো মন্ত্রী, ফিরে যাই।
গোপাল বললেন, মহারাজ, কেন খিচুড়ি হবে না। দূরে গৃহস্থবাড়িতে জ্বালানো প্রদীপের আলো যদি পুকুরের পানিতে ডুবে থাকা গরিব প্রজার গায়ে তাপ দিতে পারে, এই প্রদীপ তো হাঁড়ির অনেক কাছে। নিশ্চয়ই খিচুড়ি হবে।
রাজা ভুল বুঝতে পারলেন। এ ঘটনার পর সত্যি সত্যি গরিব লোকটাকে অনেক পুরস্কার দিয়েছিলেন।
কিন্তু এখন? না খুঁজলেও অনেক ভাঁড় পাওয়া যাবে এখন। কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করেন তাঁরা।
যা হোক, দেশপ্রেম নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেখানেই যাওয়া যাক। দেশপ্রেমের নমুনা কেমন হতে পারে? এক ভদ্রলোক রাজনীতিতে নেমেছেন। শুরু করেছেন ঘরোয়া রাজনীতি দিয়ে। অর্থাৎ মাঠের বক্তৃতা তখনো শুরু করেননি। ছোটখাটো হলরুম ভাড়া করে লোকজন ডেকে নিজের কথা বলেন। তো একদিন তাঁর মনে হলো, তিনি দেশপ্রেমের নমুনা দেখাবেন। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। তিনি লোকজন ডেকে বক্তৃতা করতে গেলেন। কেমন সে বক্তৃতা? নমুনা দেওয়া যাক।
'ভাইসব, এই যে আমাকে দেখছেন, আমি পুরোপুরি দেশপ্রেমিক। আমি সব সময় দেশের পণ্য কিনে ধন্য। এই যে কোট পরেছি আমি, এটা দেশের কাপড় দিয়ে দেশের দর্জি তৈরি করেছে।' তিনি কোটটা খুলে ফেললেন। 'গায়ে যে জামাটা দেখছেন, এটাও দেশের কাপড়।' তিনি জামাটা খুলে ফেললেন। 'এই যে প্যান্টটা পরেছি, এটাও দেশের তৈরি।' তিনি প্যান্টটা খুলে ফেললেন। মঞ্চের সামনে এসে বললেন, 'এই যে আন্ডারওয়্যার দেখছেন, এটাও দেশের তৈরি।' দর্শকসারিতে সবাই হাসাহাসি করতে শুরু করলে ভদ্রলোক জামা-প্যান্ট পরে বাড়িতে ফিরে গেলেন।
বাড়িতে ফিরে স্ত্রীকে বললেন, আমি দেশপ্রেমের নমুনা দেখাতে গেলাম, সবাই হাসাহাসি করল কেন? স্ত্রী জানতে চাইলেন, কেমন করে তিনি নমুনা দেখাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক বর্ণনা দিলেন। বললেন, যখনই আন্ডারওয়্যার দেখাতে গেছি, তখনই হাসাহাসি। ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, তোমার তো একটাই আন্ডারওয়্যার। ময়লা হয়ে যাওয়াতে ওটা আজ ধুয়ে দেওয়া হয়েছে। তুমি আজ আন্ডারওয়্যার ছাড়াই প্যান্ট পরে গিয়েছিলে।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : মেকি দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে অরিজিনাল ভেতরটা দেখিয়ে দেবেন না।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments