কালান্তরের কড়চা-'রেখেছ আওয়ামী করে, মানুষ করোনি' by আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী
২৫ ডিসেম্বরের ক্রিসমাসের দিনটিতে সারা লন্ডন শহর অচল হয়ে পড়ে। বছরের এই একটি দিনে বাস, ট্রেন, টিউব কিছুই চলে না। প্রাইভেট কার রাস্তায় বেরোয়, তাও খুব কম সংখ্যায়। আমি প্রতিবছর এই দিনে বাসাতেই থাকি। ছেলেমেয়ে, নাতি নানা জায়গা থেকে বাসায় এসে জড়ো হয়। এবার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ছোট মেয়ে ইন্দিরাও কয়েক দিনের জন্য ছুটি কাটাতে লন্ডনে ফিরে এসেছে। সে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছে।
আমার স্ত্রী হুইলচেয়ারে বসে রান্নাবান্না করেন। আমি আমার প্রিয় সোফাটিতে বসে বই ও কাগজ পড়ি, রবীন্দ্রসংগীত শুনি, টেলিফোন রিসিভ করি। নইলে ঘুমাই।
এবার আমার নতুন সঙ্গী জুটেছেন সুইডিশ লেখক স্টিগ লারসন (Stig Larsson)। মাত্র তিনটি থ্রিলার লিখে তিনি জগদ্বিখ্যাত। মারাও গেছেন আকস্মিকভাবে অল্প বয়সে। তাঁর বইগুলো নিয়ে সাড়া জাগানো ছায়াছবি হয়ে গেছে। আমি তাঁর ট্রিলোজির দ্বিতীয় বইটি 'দি গার্ল প্লেইড উইথ ফায়ার' (আগুন নিয়ে যে মেয়েটি খেলেছে) পড়ছিলাম।
টেলিফোন আসছে। ক্রমাগত বাজছে। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক মারা গেছেন। ২৫ ডিসেম্বর তাঁর মরদেহ লন্ডন থেকে ঢাকায় গিয়ে পেঁৗছেছে। ঢাকায় সংসদ ভবনের সাউথ প্লাজায় জানাজা হয়েছে। শহীদ মিনারে মরদেহ রাখা হয়েছে। পরদিন শরীয়তপুরের ডামুড্যায় তাঁর গ্রামে হেলিকপ্টারযোগে তাঁর মৃতদেহ পাঠানো হবে। সেখান থেকে ফিরে এসে বনানীতে তাঁর আদরের কন্যার কবরের পাশে দাফন হবে। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর বাসভবনে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষ, নেতা ও কর্মী।
এসব খবরই ঘরে বসে পাচ্ছিলাম। ঢাকা থেকে টেলিফোন পাচ্ছিলাম অন্তত ডজনখানেক বন্ধুর। তাঁদের মধ্যে বন্ধুবর মোনায়েম সরকার তো আছেনই। তিনি কিছুক্ষণ পর পরই টেলিফোন করছিলেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। একসময় আবদুর রাজ্জাকের তিনি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন; বিশেষ করে শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের সময়টিতে। আওয়ামী লীগে তখন নেতৃত্বের কোন্দল চলছে। আবদুর রাজ্জাক বুঝেছিলেন, এই কোন্দল দূর করে সামরিক জান্তার ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের মুখে দলের ঐক্য ও অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে বঙ্গবন্ধুর 'রিফ্লেকটেড গ্লোরির' অধিকারী শেখ হাসিনাকে ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে আবদুর রাজ্জাকই শেখ হাসিনাকে দলের নেত্রী পদে বসানোর প্রধান উদ্যোক্তার ভূমিকাটি গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য দলের ছোট-বড় নেতারা তাতে সম্মত ছিলেন। মোনায়েম সরকারও ছিলেন আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে দলের নেত্রীপদে বসানোর অতি উৎসাহীদের একজন। তিনি আবদুর রাজ্জাককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা কেন শেখ হাসিনাকে দলের সভানেত্রী করতে যাচ্ছি? রাজ্জাক বলেছেন, এ ছাড়া দলের ঐক্য ও অস্তিত্ব রক্ষার আর কোনো উপায় নেই। মোনায়েম সরকার বলেছেন, 'আমরা আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।'
এ সময় মোনায়েম সরকার দিলি্ল যান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি ছিলেন পিএন হাকসার, একজন পণ্ডিত মানুষ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম সমর্থক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে মোনায়েম সরকারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সরকার সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি কাকে করা হলে ভালো হয়? হাকসার বলেছেন, ড. কামাল হোসেনকে কেন করো না? মোনায়েম সরকার বলেছেন, আমরা এবং দলের সবাই চাইছেন শেখ হাসিনাকে। কথাটা শুনেই হাকসার লাফ দিয়ে উঠেছিলেন। বলেছেন, 'ঠিক, ঠিক, হাসিনাই হবেন আওয়ামী লীগের যোগ্য নেত্রী। বাঙালি জাতির ভাবাবেগকে তিনি নাড়া দিতে পারবেন। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমা এবং গ্লোরি_দুই-ই তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত।' মোনায়েম সরকার দেশে ফিরে আবদুর রাজ্জাককে এসব কথা জানিয়েছিলেন।
গত রবিবার (২৫ ডিসেম্বর) মোনায়েম সরকার আমাকে টেলিফোনে এসব কথা বলছিলেন আর কাঁদছিলেন। একসময় বললেন, 'আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না, আবদুর রাজ্জাকের জানাজায় মানুষের কী ঢল নেমেছে। লক্ষাধিক মানুষ হবে। সাউথ প্লাজা, শহীদ মিনার কোথাও তিলধারণের স্থান নেই। ঢাকায় এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। মনে হয় আবদুর রাজ্জাক কেবল দলীয় নেতা নন, একজন জাতীয় নেতা।'
ঢাকা থেকে আরো যেসব বন্ধু টেলিফোন করেছেন, তাঁরাও বলেছেন এই কথা। আমি টেলিভিশনের সংবাদ-ছবিতেও দেখেছি সেই জনসমুদ্র। একসময় কলকাতার এক সাংবাদিক বন্ধু টেলিফোন করলেন। বললেন, 'ঢাকায় আবদুর রাজ্জাকের মরদেহ কি বিপুল সম্মান পাচ্ছে, তা তো জেনেছেন, আমরাও জেনেছি। শুনেছি, সোনিয়া গান্ধী এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও শোকবাণী পাঠিয়েছেন।'
কলকাতার সাংবাদিক বন্ধু আরো বললেন, 'রাজ্জাক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অগ্রসেনা হলেও দেশটির সাম্প্রতিক রাজনীতিতে তিনি কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর সারা দেশের মানুষ তাঁকে যেভাবে সম্মান দেখাচ্ছে, শোক প্রকাশ করছে, তাতে মনে হয় রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর রিফ্লেক্টেড গ্লোরির একজন উত্তরাধিকারী। বঙ্গবন্ধুর নির্মম মৃত্যুতে বাঙালি জাতিকে কাঁদার ও শোক প্রকাশের সুযোগ দেয়নি বর্বর ঘাতকরা। এখন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির আলোয় আলোকিত তাঁর প্রিয় শিষ্যদের কেউ মারা গেলে বাঙালি দলমতের পার্থক্য ভুলে শোক প্রকাশ করে, সম্মান দেখায়। আবদুর রাজ্জাকের বেলায়ও তা-ই ঘটেছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয় তো ছিলেনই; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি থেকে ভ্রষ্ট না হয়ে তাঁর গৌরব ও জনপ্রিয়তারও একজন উত্তরাধিকারী হয়েছেন। যাঁরা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও আদর্শ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন, তাঁদের অনেকে বেঁচে থেকেও আজ মৃত।'
কলকাতার সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছি, 'আমি তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করি।' ২৫ ডিসেম্বর রবিবার আমার বাসায় সারা দিনই প্রায় টেলিফোন বেজেছে। ঢাকা থেকে তো বটেই, ইউরোপের অনেক শহর থেকেও। সবার মুখেই ঢাকায় জানাজায় অভূতপূর্ব জনসমাবেশের কথা। তাঁরা সবাই সে কথা জেনে গেছেন। ঢাকা যে এ ধরনের জনসমাবেশ হবে, তার আভাস আমি আগেই পেয়েছিলাম। লন্ডনের ব্রিকলেন মসজিদে রাজ্জাকের নামাজে জানাজা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচতলা মসজিদটিতে শুধু লোক আর লোক। লন্ডনের বাইরের শহরগুলো থেকেও অসংখ্য মানুষ এসেছে জানাজায় শরিক হতে। বাংলাদেশেও তা-ই ঘটেছে। ঢাকার বাইরের দূর-দূরান্ত থেকে সব দলমতের মানুষ ছুটে এসেছে প্রয়াত নেতার জানাজায় যোগ দিতে।
রবিবার সন্ধ্যার দিকে যখন ভাবছি টেলিফোন আর আসবে না, তখনই এল এমন একটি টেলিফোন, যে টেলি-বক্তব্য আমি আর ভুলতে পারিনি, বরং তা নিয়ে লেখার জন্য কলম ধরেছি। এই টেলি-বক্তব্যটিও মোনায়েম সরকারের। তিনি বললেন, আজ (রবিবার) শহীদ মিনারে রাজ্জাকের বিশাল শোক জমায়েতে গিয়ে এমন একটি কথা শুনেছি; যা আপনাকে না জানালেই নয়। কথাটা বলেছেন বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত অভিনেতা (মোনায়েম সরকার তাঁর নাম বলেছেন, তবে প্রকাশ করতে বারণ করেছেন)। এই অভিনেতা উত্তাল জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে খেদোক্তি করার মতো রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত কবিতার প্যারোডি উচ্চারণ করেছেন এবং তা হলো
'কয়েক লক্ষ মানুষের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ আওয়ামী করে, মানুষ করোনি।
এই প্যারোডি শুনে চমৎকৃত হয়েছি। বলেছি, কি ভেবে তিনি এই প্যারোডি আবৃত্তি করেছেন, তা জানেন? মোনায়েম সরকার বলেছেন, 'কিছুটা জানি বৈকি। অভিনেতার মতে, আওয়ামী লীগের প্রতি বাংলার মানুষের যে বিশাল ভালোবাসা, আবদুর রাজ্জাকের জানাজায় তার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ এই ভালোবাসা ও সমর্থনকে গ্রহণ করতে জানে না। তারা কচ্ছপের মতো আওয়ামী খোলসের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। আত্মপ্রকাশ করতে পারে না, মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে পারে না। তাকে দূরে ঠেলে দেয়।'
আবদুর রাজ্জাক শেষ জীবনে আওয়ামী লীগ কর্তৃক যে কিছুটা অনাদৃত হয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এ জন্য আবদুর রাজ্জাকের নিজের কিছু ভুলভ্রান্তি দায়ী; আবার আওয়ামী লীগের অনুদারতা ও সংকীর্ণতাও দায়ী। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী এবং দলনেত্রী হিসেবে আবদুর রাজ্জাকের জন্য যথেষ্ট করেছেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য অর্থসাহায্য দিয়েছেন। মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ দেশে নেওয়া, তাঁর স্ত্রী ও পরিজনকে সান্ত্বনা দেওয়া, তাঁর বাড়িতে গিয়ে মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ সব ধরনের রাষ্ট্রীয়, দলীয় ও ব্যক্তিগত সম্মান দেখানো হয়েছে। আবদুর রাজ্জাকের প্রতি শেখ হাসিনা তাঁর সব দায়িত্ব প্রশংসনীয়ভাবে পালন করেছেন। তবু বলব, তাঁর যে মর্যাদা প্রাপ্য ছিল তার সবটা দিতে পারেননি। মর্যাদা দিয়েছে দেশের মানুষ।
আবদুর রাজ্জাকের বিশাল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজনৈতিক জীবনে সাফল্য এবং অসাফল্য_দুই-ই ছিল। তিনি এখন সদ্য প্রয়াত। তাঁকে নিয়ে এখনই বিতর্কমূলক লেখা লিখতে চাই না। তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের যতটা সম্ভব একটি প্রকৃত মূল্যায়ন প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ রাজনীতিতেও তাঁর বিতর্কমূলক ভূমিকার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার দরকার। আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এ সম্পর্কে ভবিষ্যতে তাই একটি বড় লেখার আশা রাখি।
লন্ডন, ২৬ ডিসেম্বর, সোমবার, ২০১১
এবার আমার নতুন সঙ্গী জুটেছেন সুইডিশ লেখক স্টিগ লারসন (Stig Larsson)। মাত্র তিনটি থ্রিলার লিখে তিনি জগদ্বিখ্যাত। মারাও গেছেন আকস্মিকভাবে অল্প বয়সে। তাঁর বইগুলো নিয়ে সাড়া জাগানো ছায়াছবি হয়ে গেছে। আমি তাঁর ট্রিলোজির দ্বিতীয় বইটি 'দি গার্ল প্লেইড উইথ ফায়ার' (আগুন নিয়ে যে মেয়েটি খেলেছে) পড়ছিলাম।
টেলিফোন আসছে। ক্রমাগত বাজছে। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক মারা গেছেন। ২৫ ডিসেম্বর তাঁর মরদেহ লন্ডন থেকে ঢাকায় গিয়ে পেঁৗছেছে। ঢাকায় সংসদ ভবনের সাউথ প্লাজায় জানাজা হয়েছে। শহীদ মিনারে মরদেহ রাখা হয়েছে। পরদিন শরীয়তপুরের ডামুড্যায় তাঁর গ্রামে হেলিকপ্টারযোগে তাঁর মৃতদেহ পাঠানো হবে। সেখান থেকে ফিরে এসে বনানীতে তাঁর আদরের কন্যার কবরের পাশে দাফন হবে। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর বাসভবনে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষ, নেতা ও কর্মী।
এসব খবরই ঘরে বসে পাচ্ছিলাম। ঢাকা থেকে টেলিফোন পাচ্ছিলাম অন্তত ডজনখানেক বন্ধুর। তাঁদের মধ্যে বন্ধুবর মোনায়েম সরকার তো আছেনই। তিনি কিছুক্ষণ পর পরই টেলিফোন করছিলেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। একসময় আবদুর রাজ্জাকের তিনি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন; বিশেষ করে শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের সময়টিতে। আওয়ামী লীগে তখন নেতৃত্বের কোন্দল চলছে। আবদুর রাজ্জাক বুঝেছিলেন, এই কোন্দল দূর করে সামরিক জান্তার ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের মুখে দলের ঐক্য ও অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে বঙ্গবন্ধুর 'রিফ্লেকটেড গ্লোরির' অধিকারী শেখ হাসিনাকে ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে আবদুর রাজ্জাকই শেখ হাসিনাকে দলের নেত্রী পদে বসানোর প্রধান উদ্যোক্তার ভূমিকাটি গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য দলের ছোট-বড় নেতারা তাতে সম্মত ছিলেন। মোনায়েম সরকারও ছিলেন আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে দলের নেত্রীপদে বসানোর অতি উৎসাহীদের একজন। তিনি আবদুর রাজ্জাককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা কেন শেখ হাসিনাকে দলের সভানেত্রী করতে যাচ্ছি? রাজ্জাক বলেছেন, এ ছাড়া দলের ঐক্য ও অস্তিত্ব রক্ষার আর কোনো উপায় নেই। মোনায়েম সরকার বলেছেন, 'আমরা আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।'
এ সময় মোনায়েম সরকার দিলি্ল যান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি ছিলেন পিএন হাকসার, একজন পণ্ডিত মানুষ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম সমর্থক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে মোনায়েম সরকারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সরকার সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি কাকে করা হলে ভালো হয়? হাকসার বলেছেন, ড. কামাল হোসেনকে কেন করো না? মোনায়েম সরকার বলেছেন, আমরা এবং দলের সবাই চাইছেন শেখ হাসিনাকে। কথাটা শুনেই হাকসার লাফ দিয়ে উঠেছিলেন। বলেছেন, 'ঠিক, ঠিক, হাসিনাই হবেন আওয়ামী লীগের যোগ্য নেত্রী। বাঙালি জাতির ভাবাবেগকে তিনি নাড়া দিতে পারবেন। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমা এবং গ্লোরি_দুই-ই তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত।' মোনায়েম সরকার দেশে ফিরে আবদুর রাজ্জাককে এসব কথা জানিয়েছিলেন।
গত রবিবার (২৫ ডিসেম্বর) মোনায়েম সরকার আমাকে টেলিফোনে এসব কথা বলছিলেন আর কাঁদছিলেন। একসময় বললেন, 'আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না, আবদুর রাজ্জাকের জানাজায় মানুষের কী ঢল নেমেছে। লক্ষাধিক মানুষ হবে। সাউথ প্লাজা, শহীদ মিনার কোথাও তিলধারণের স্থান নেই। ঢাকায় এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। মনে হয় আবদুর রাজ্জাক কেবল দলীয় নেতা নন, একজন জাতীয় নেতা।'
ঢাকা থেকে আরো যেসব বন্ধু টেলিফোন করেছেন, তাঁরাও বলেছেন এই কথা। আমি টেলিভিশনের সংবাদ-ছবিতেও দেখেছি সেই জনসমুদ্র। একসময় কলকাতার এক সাংবাদিক বন্ধু টেলিফোন করলেন। বললেন, 'ঢাকায় আবদুর রাজ্জাকের মরদেহ কি বিপুল সম্মান পাচ্ছে, তা তো জেনেছেন, আমরাও জেনেছি। শুনেছি, সোনিয়া গান্ধী এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও শোকবাণী পাঠিয়েছেন।'
কলকাতার সাংবাদিক বন্ধু আরো বললেন, 'রাজ্জাক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অগ্রসেনা হলেও দেশটির সাম্প্রতিক রাজনীতিতে তিনি কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর সারা দেশের মানুষ তাঁকে যেভাবে সম্মান দেখাচ্ছে, শোক প্রকাশ করছে, তাতে মনে হয় রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর রিফ্লেক্টেড গ্লোরির একজন উত্তরাধিকারী। বঙ্গবন্ধুর নির্মম মৃত্যুতে বাঙালি জাতিকে কাঁদার ও শোক প্রকাশের সুযোগ দেয়নি বর্বর ঘাতকরা। এখন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির আলোয় আলোকিত তাঁর প্রিয় শিষ্যদের কেউ মারা গেলে বাঙালি দলমতের পার্থক্য ভুলে শোক প্রকাশ করে, সম্মান দেখায়। আবদুর রাজ্জাকের বেলায়ও তা-ই ঘটেছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয় তো ছিলেনই; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি থেকে ভ্রষ্ট না হয়ে তাঁর গৌরব ও জনপ্রিয়তারও একজন উত্তরাধিকারী হয়েছেন। যাঁরা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও আদর্শ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন, তাঁদের অনেকে বেঁচে থেকেও আজ মৃত।'
কলকাতার সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছি, 'আমি তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করি।' ২৫ ডিসেম্বর রবিবার আমার বাসায় সারা দিনই প্রায় টেলিফোন বেজেছে। ঢাকা থেকে তো বটেই, ইউরোপের অনেক শহর থেকেও। সবার মুখেই ঢাকায় জানাজায় অভূতপূর্ব জনসমাবেশের কথা। তাঁরা সবাই সে কথা জেনে গেছেন। ঢাকা যে এ ধরনের জনসমাবেশ হবে, তার আভাস আমি আগেই পেয়েছিলাম। লন্ডনের ব্রিকলেন মসজিদে রাজ্জাকের নামাজে জানাজা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচতলা মসজিদটিতে শুধু লোক আর লোক। লন্ডনের বাইরের শহরগুলো থেকেও অসংখ্য মানুষ এসেছে জানাজায় শরিক হতে। বাংলাদেশেও তা-ই ঘটেছে। ঢাকার বাইরের দূর-দূরান্ত থেকে সব দলমতের মানুষ ছুটে এসেছে প্রয়াত নেতার জানাজায় যোগ দিতে।
রবিবার সন্ধ্যার দিকে যখন ভাবছি টেলিফোন আর আসবে না, তখনই এল এমন একটি টেলিফোন, যে টেলি-বক্তব্য আমি আর ভুলতে পারিনি, বরং তা নিয়ে লেখার জন্য কলম ধরেছি। এই টেলি-বক্তব্যটিও মোনায়েম সরকারের। তিনি বললেন, আজ (রবিবার) শহীদ মিনারে রাজ্জাকের বিশাল শোক জমায়েতে গিয়ে এমন একটি কথা শুনেছি; যা আপনাকে না জানালেই নয়। কথাটা বলেছেন বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত অভিনেতা (মোনায়েম সরকার তাঁর নাম বলেছেন, তবে প্রকাশ করতে বারণ করেছেন)। এই অভিনেতা উত্তাল জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে খেদোক্তি করার মতো রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত কবিতার প্যারোডি উচ্চারণ করেছেন এবং তা হলো
'কয়েক লক্ষ মানুষের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ আওয়ামী করে, মানুষ করোনি।
এই প্যারোডি শুনে চমৎকৃত হয়েছি। বলেছি, কি ভেবে তিনি এই প্যারোডি আবৃত্তি করেছেন, তা জানেন? মোনায়েম সরকার বলেছেন, 'কিছুটা জানি বৈকি। অভিনেতার মতে, আওয়ামী লীগের প্রতি বাংলার মানুষের যে বিশাল ভালোবাসা, আবদুর রাজ্জাকের জানাজায় তার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ এই ভালোবাসা ও সমর্থনকে গ্রহণ করতে জানে না। তারা কচ্ছপের মতো আওয়ামী খোলসের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। আত্মপ্রকাশ করতে পারে না, মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে পারে না। তাকে দূরে ঠেলে দেয়।'
আবদুর রাজ্জাক শেষ জীবনে আওয়ামী লীগ কর্তৃক যে কিছুটা অনাদৃত হয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এ জন্য আবদুর রাজ্জাকের নিজের কিছু ভুলভ্রান্তি দায়ী; আবার আওয়ামী লীগের অনুদারতা ও সংকীর্ণতাও দায়ী। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী এবং দলনেত্রী হিসেবে আবদুর রাজ্জাকের জন্য যথেষ্ট করেছেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য অর্থসাহায্য দিয়েছেন। মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ দেশে নেওয়া, তাঁর স্ত্রী ও পরিজনকে সান্ত্বনা দেওয়া, তাঁর বাড়িতে গিয়ে মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ সব ধরনের রাষ্ট্রীয়, দলীয় ও ব্যক্তিগত সম্মান দেখানো হয়েছে। আবদুর রাজ্জাকের প্রতি শেখ হাসিনা তাঁর সব দায়িত্ব প্রশংসনীয়ভাবে পালন করেছেন। তবু বলব, তাঁর যে মর্যাদা প্রাপ্য ছিল তার সবটা দিতে পারেননি। মর্যাদা দিয়েছে দেশের মানুষ।
আবদুর রাজ্জাকের বিশাল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজনৈতিক জীবনে সাফল্য এবং অসাফল্য_দুই-ই ছিল। তিনি এখন সদ্য প্রয়াত। তাঁকে নিয়ে এখনই বিতর্কমূলক লেখা লিখতে চাই না। তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের যতটা সম্ভব একটি প্রকৃত মূল্যায়ন প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ রাজনীতিতেও তাঁর বিতর্কমূলক ভূমিকার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার দরকার। আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এ সম্পর্কে ভবিষ্যতে তাই একটি বড় লেখার আশা রাখি।
লন্ডন, ২৬ ডিসেম্বর, সোমবার, ২০১১
No comments