পর্যটনশিল্প-বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হবে কীভাবে? by এ জেড এম সাইফুদ্দীন

সীমিত শব্দের কোন লেখায় একটি দেশের সামগ্রিক ‘ব্র্যান্ডিং’ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করাটা অনেকটাই দুঃসাহসের শামিল। কিন্তু সারা পর্যটন ৪.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি শিল্প। সেই তুলনায় এমনকি আইটি শিল্পকেও মনে হবে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ছোটখাটো একটি ‘ব্যবসা’। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটনশিল্প ২৫০ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান করে চলেছে। তুলনামূলকভাবে দেখতে গেলে কর্মসংস্থানের মাধ্যমই হোক অথবা আয়ের উৎসই হোক, বাংলাদেশে


পর্যটনশিল্পের বিশাল সম্ভাবনা আজও রয়ে গেছে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই শিল্পের প্রতি সামান্য একটু মনোযোগী হলেই তা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প নিয়ে ভাবতে গেলে প্রথমেই যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে কেন আমরা এত বেশি পিছিয়ে? আর এর উন্নতির জন্যই বা কী করা প্রয়োজন? প্রথমে কি আমাদের দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে, নাকি বর্তমানে যতটুকু পর্যটনশিল্পের বিকাশ আমাদের দেশে হয়েছে, তা যত অল্পই হোক না কেন, তার প্রতি আরও যত্নশীল হয়ে আরও বেশি পর্যটক আকর্ষণ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে? বিশেষজ্ঞরা তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টির সমাধানের বেশ কিছু পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সাধারণ জনগণও এ ব্যাপারে প্রকাশ করেছে তাদের ব্যক্তিগত মতামত। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আমার মনে হয়েছে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমানে আমাদের দেশে যেসব পর্যটক আসছেন তাঁদের আরও উন্নত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যেতে সাহায্য করার কাজটা একই সঙ্গে চলতে পারে।
আমরা যারা বিজ্ঞাপনশিল্পের সঙ্গে জড়িত তারা সবকিছুকে ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে দেখতে ভালোবাসি। আর সেই বিবেচনা থেকে প্রথম যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হলো, পর্যটনশিল্পের এই বিশাল বিশ্ববাজারে ‘ব্র্যান্ড বাংলাদেশে’র অবস্থানটা কোথায়? আমাদের সবারই একবাক্যে স্বীকার করতে হবে, বিশ্বের যেকোনো পর্যটককে আকর্ষণ করার মতো সব উপাদানই এই সোনার বাংলাদেশে রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভোজনরসিক পর্যটকদের জন্য নতুন স্বাদের বাংলাদেশি নানা রেসিপি থেকে শুরু করে বন্যপ্রাণী—সবই খুঁজে পাওয়া যাবে এই দেশে। তবে কোথাও না কোথাও একটা কোনো সমস্যা নিশ্চয়ই আছে। তা না হলে একজন পশ্চিমা পর্যটক ভ্রমণের কথা ভাবলে প্রথমেই কেন বাংলাদেশের কথা ভাববে না? কেন ভারত, মালয়েশিয়া, এমনকি ভুটান বা মিয়ানমারও পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে? আশা করি সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে আমার এই ‘ব্র্যান্ড’কেন্দ্রিক ভাবনাকে পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। তবে আবারও বলছি, আমার ধারণা বিশ্বের পর্যটন-মানচিত্রে আমরা ‘ব্র্যান্ড-বাংলাদেশ’কে সঠিকভাবে ‘পজিশন’ করতে ব্যর্থ হয়েছি। অন্যভাবে বলতে গেলে, স্বকীয়, একদম স্বতন্ত্র কোনো আকর্ষণ আমরা পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে পারিনি। এশীয় স্বাদের খাবার, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাতছানি বা বন্যপ্রাণীর আকর্ষণ—এর সবই আমাদের বহু আগেই কোনো না কোনো দেশ নিজেদের করে নিয়েছে। এবার যদি আপনি আবার আমাকে প্রশ্ন করেন, এত বছরেও বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের কোনো উন্নতি হলো না কেন, আমার উত্তর হবে, আপনি বিশ্বের কাছে কী উপস্থাপন করছেন তা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কীভাবে আপনি তা উপস্থাপন করছেন। বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে কীভাবে উপস্থাপন করলে তা সত্যিকার অর্থেই পর্যটনশিল্পের উন্নতিতে প্রভাব রাখবে, তা ভেবে বের করে সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করতে হবে এখনই।
জরিপ বলছে, গত বছরের শেষ দিকে ২০ হাজারের কিছু বেশি পর্যটক বাংলাদেশে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন, যা তার আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। এসব পর্যটকের বেশির ভাগই ছিলেন ইউরোপীয় এবং জাপানি। বর্তমানে দেশে কমপক্ষে ১০টি ট্যুর অপারেটর ইউরোপ, আমেরিকা এবং জাপানের ৫০টি অপারেটরের সঙ্গে একত্রে কাজ করে বাংলাদেশের পর্যটকদের সেবা প্রদান করছে। টাকার অঙ্কে তাদের মোট ব্যবসার পরিমাণ ২২ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। গড়ে একজন ইউরোপিয়ান বা জাপানি ট্যুরিস্ট বাংলাদেশে সাত দিনের অবকাশ ভ্রমণে এসে খরচ করেন ৮০০ ডলার। যে কারণেই হোক না কেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আমাকে বেশ কিছুটা কাজ করতে হয়েছে, আর যেসব পর্যটক বাংলাদেশের ভেতরে একবার পা রাখেন তাঁদের বেশির ভাগই যে এই দেশকে ভালোবেসে ফেলেন, তা আমি জানি। ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের অনেককেই গবেষনার প্রয়োজনে জানতে চেয়েছি, ‘আমাদের কোন জিনিসটা তোমার ভালো লেগেছে? খাবারদাবার? প্রকৃতি ?’ প্রতিটা ক্ষেত্রে আমি যে উত্তরটা পেয়েছি তা হলো, ‘এর কোনোটাই না! এর চেয়ে মজাদার খাবার, একই ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমি অমুক দেশে দেখেছি।’ কিন্তু হাল ছাড়িনি। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জর্জরিত করে ফেলেছি বিদেশি অতিথিদের। অন্তত কয়েক হাজার পৃষ্ঠার গবেষনা পত্র ঘেঁটেছি শুধু এই একটি উত্তরের জন্য। পর্যটনশিল্প সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গবেষনা কোম্পানিগুলো দেখেছে যে আজকালকার পর্যটকেরা চায় নতুন কিছু। প্রকৃতি, বিশাল সব অট্টালিকা আর বন্যপ্রাণী দেখতে দেখতে তারা ক্লান্ত। তারা এখন ভ্রমণ করে নতুন কোনো আবিষ্কারের আশায়।
আমাদের অনেকেই নিশ্চয়ই এই দেশের রাস্তাঘাটে এমন অনেক বিদেশির দেখা পেয়েছেন, যাঁকে দেখে মনে হয় পুরোদস্তুর বাঙালি—সাজপোশাক থেকে শুরু করে আচার-আচরণে তাদের অনেকেই মনে হবে আপনার-আমার চেয়ে অনেক বেশি বাংলাদেশপ্রেমী। এধরণের কাউকে পেলে একটু কষ্ট করে জিজ্ঞেস করবেন, ‘এই দেশের কোন বিষয়টা তোমার সবচেয়ে ভালো লাগে?’ উত্তরটা আমি বলে দিচ্ছি, ‘এই দেশের মানুষ এবং তাদের জীবনযাত্রা। এই দেশের মানুষের আতিথেয়তা।’ এবার আবার ফিরে আসি সেই পুরোনো প্রসঙ্গে—ব্র্যান্ড বাংলাদেশকে আমরা কীভাবে পজিশন করব? বুদ্ধিমান পাঠক উত্তরটা ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছেন আশা করি—বাংলাদেশের ‘পজিশনিং’ হতে হবে এই দেশের মানুষকে ঘিরে। আমাদের জীবনযাত্রা আর আনন্দময় ঐতিহ্যকে ঘিরে। আর সেটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ, সঠিক পন্থা। না হলে এত ‘নেই’-এর ভেতরে বছরের পর বছর কীভাবে আমাদের দেশ সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকার একদম ওপর দিকটায় থাকছে? এটাই আমাদের স্বকীয়তা। এটাই একমাত্র বিষয় যা অন্য কোনো দেশ আমাদের আগেই দখল করে নেয়নি। বিশেষত আজকের দিনের পর্যটকেরা যদি আসলেই প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণী দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে থাকেন তাঁদের আমরা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিতে পারব একদম নতুন একটি জিনিস—ছোট্ট এই দেশটির অতিসাধারণ মানুষের হাসিমাখা মুখ, আনন্দময় জীবনপ্রণালি আর আতিথেয়তা।
 এ জেড এম সাইফুদ্দীন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পেপার রাইম বিজ্ঞাপনী সংস্থা।

No comments

Powered by Blogger.