দুটি মতাদর্শ, দুই নেত্রী ও দুটি সংলাপ by ডা. ওয়াহিদ নবি

দুটি সংলাপ শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য রাষ্ট্রপতি আলোচনা শুরু করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ আলোচনা শুরু করেছে 'স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলোর' সঙ্গে। আমাদের দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় সংলাপ দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নির্বাচনী সংলাপটির সাফল্য সম্পর্কে।


স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলোর সংলাপ সম্পর্কে এখনো খুব বেশি প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি বিভিন্ন মহলের। এই ধারণাটি হয়েছে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের মাধ্যমে। হয়তো বাস্তব অবস্থা অন্য রকম। সংলাপ সম্পর্কে উন্নাসিকতা প্রকাশ হয়তো আমাদের অভিজ্ঞতার কারণে। হয়তো এই উন্নাসিকতার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। কিন্তু এই উন্নাসিকতা পরিহার করে সংলাপের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার মানসিকতা আমাদের গড়ে তুলতে হবে। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা গড়ে তোলার মানসিকতা গড়ে না তুললে আমাদের অনেক মূল্য দিতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতায় আমরা তা দেখেছি। গত পর্যবেক্ষক সরকার গঠনের আগের কথাই ধরা যাক। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদকদ্বয়ের আলোচনায় যদি একটা সমঝোতা গড়ে উঠত তবে দেশ, জাতি, রাজনৈতিক দলগুলো, রাজনীতিবিদরা এবং আরো অনেকে অনেক ভোগান্তির হাত থেকে রেহাই পেতেন। সেদিনের সংলাপে কোনো সাফল্য না আসায় কী হয়েছিল তা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। 'উদ্দিনদের' খপ্পরে পড়ে জাতি ভুগেছে। ছাত্ররা ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে নির্যাতিত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা দৈহিক ও মানসিকভাব নির্যাতিত হয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে সরকারি হেফাজতে প্রাণ দিতে হয়েছে সংখ্যা না জানা তরুণদের। সাধারণ সম্পাদকদ্বয়ের একজন ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আরেকজন রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়েছেন।
আলোচনা ও দর কষাকষি গণতান্ত্রিক রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গ। শুধু রাজনীতি কেন, আলোচনার মাধ্যমে দর কষাকষি হয়তো মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার একটা অংশ। পৃথিবীতে কোনো দুজন ব্যক্তি এক রকম চিন্তা করে না। মানুষের কাম্যবস্তু বিভিন্ন রকমের। সমষ্টিগত স্বার্থ তাই ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। মতের ও পথের পার্থক্য তাই স্বাভাবিক। এসব কারণেই সমঝোতা মানুষের জীবনে অপরিহার্য। নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে বিলেতের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে 'ট্রাস্ট ব্যবস্থা' চালু হলে ট্রাস্টের ম্যানেজারদের সরকার অনেক ক্ষমতা দেয়। ম্যানেজাররা ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনকে ডাক্তারদের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। প্রত্যুত্তরে ডাক্তাররা 'লোকাল নেগোসিয়েশন কমিটি' গড়ে তোলে। আমাদের ট্রাস্টে আমি 'লোকাল নেগোসিয়েশন কমিটির' চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন চেয়ারম্যানদের প্রশিক্ষণদান করে দর কষাকষির দক্ষতা বাড়াতে। এমনি এক প্রশিক্ষণ সেশনে বিএমএর অভিজ্ঞ কর্মকর্তা আমাদের বললেন, যেকোনো দর কষাকষির বৈঠকে যাওয়ার সময় আমরা যেন একটা সমঝোতায় আসার মনোভাব নিয়ে সেখানে যাই। ম্যানেজারদের সঙ্গে কনসালটেন্টদের সম্পর্ক তখন খুবই খারাপ। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আমরা এর প্রতিবাদ করি। বিএমএর অভিজ্ঞ কর্মকর্তা আমাদের বোঝালেন যে দর কষাকষির কোনো বৈঠকে যদি সমঝোতার সৃষ্টি না হয় তাহলে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি আমাদের আরো বোঝালেন, যে বিষয়গুলোতে সমঝোতা সম্ভব, সেখানে সমঝোতাভিত্তিক চুক্তি করে নেওয়া ভালো। আর যে বিষয়গুলোতে সমঝোতা একেবারেই সম্ভব নয়, সেখানে আলোচনা করার জন্য সময় নেওয়া বাঞ্ছনীয়। সংলাপ দুটির কথা ভাবতে গেলে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে আমাদের দেশের পটভূমির কথা। উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয় সরকার গণপরিষদের সম্মতিসাপেক্ষে। বিরোধী দল এটা মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে তারা জানিয়ে দেয়। তারা আন্দোলন ও হরতাল শুরু করে। এতে ভাঙচুর ও প্রাণহানি ঘটে। যা-ই হোক, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে গেলে বিএনপির লাভ ছাড়া ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা আছে এমনটা মনে হয় না। যদি খারাপটাই আমরা ধরে নিই, অর্থাৎ যদি সমঝোতা যদি না হয় তবে সমঝোতা না হওয়ার কারণটা মানুষ বিবেচনা করে দেখবে। কিন্তু সংলাপে না গেলে একগুঁয়েমির অভিযোগে অভিযুক্ত হবে তারা। রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা নেই ইত্যাদি অজুহাত মানুষ কানে তুলবে না। আপসহীন নেত্রী গৌরবান্বিত হয়েছিলেন ভিন্ন পরিবেশে। আর তা ছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপসের ব্যাপারটা মানুষের চোখ এড়াতে পারবে না। যদি অন্য সব দল রাষ্ট্রপতির সংলাপে যায় এবং বিএনপি সমর্থিত দলগুলো না যায়, তবে জনসাধারণ তা ভালোভাবে নেবে বলে মনে হয় না।
বিএনপি সংসদ বর্জন করছে_এটা অনেকে পছন্দ করছে না। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরাও অতীতে সংসদে যায়নি_এ কথা বলে তারা পার পাবে না। দুটি কারণে তারা পার পাবে না। একটি কারণ হচ্ছে, সময় বদলে গেছে; আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, সংসদ বর্জন করার জন্য আওয়ামী লীগকেও অপছন্দ করেছে অনেকে। নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাবেন না, কিন্তু সব সুযোগ-সুবিধা নেবেন এটা গ্রহণযোগ্য নয়। বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছোট দলগুলোর কথায় সব সময় কর্ণপাত করেছে, সেটাও বলা যায় না। হয়তো কাজটি খুব কঠিন। কিন্তু এটা ঠিক যে নানা কারণে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আজ সোচ্চার। তারা সক্রিয়। রাজনীতিতে রাজপথ প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে চলে গেলে সেটা সুখবর নয়। এসব কারণে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মধ্যে একতা প্রয়োজন। খালেদা জিয়া ইদানীংকালে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করেছেন। এর মধ্যে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে অভিযুক্তরা নিরপরাধ। ব্যারিস্টার মওদুদ আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন যে বিচারের কাজটাই বন্ধ করে দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে তারা যে ভূমিকা নিয়েছে তা তাদের অপূরণীয় ক্ষতি করবে। গণতন্ত্রে একটা কথা মেনে নিতে হবে যে নির্বাচিত সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে।
আমাদের এই নতুন গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক দলগুলো সংলাপের মাধ্যমে নিজেদের মতানৈক্য দূর করুক_এটাই আমরা চাই। কিন্তু এটাও আমরা বুঝি যে আমরা আদর্শ পৃথিবীতে বাস করি না। এক ধরনের সবজান্তা মুরবি্বরা আদর্শ জগতের কথা বলেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক নেতাদের সমালোচনা করেন। অগণতান্ত্রিক সরকারের আমলে তাঁরা 'ফুল ফর্মে' থাকেন। তাঁরা দুই নেত্রীকে এক টেবিলে বসতে উপদেশ দেন। কিন্তু বুঝতে চান না যে গণতন্ত্র বিকাশে সময় লাগে। দুই নেত্রী দুটি বিপরীতধর্মী মতাদর্শের প্রতিনিধিত্বকারী। এ ছাড়াও রয়েছে হত্যার ব্যাপারে জটিলতা। আমরা মনে করি যে আমাদের উচিত সংলাপে অংশগ্রহণ করতে কাউকে নিরুৎসাহিত না করা। আমাদের উচিত আমাদের নিজেদের সময় দেওয়া গণতন্ত্রের বিকাশে। অতি তাড়াতাড়ি গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে না বলে অস্থির হয়ে পড়লে অগণতান্ত্রিক শক্তিকে সাহায্য করা হবে।
লেখক : লন্ডনে বসবাসরত বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.