পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের তাগিদ-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর
১৯৪৭ সালের পর থেকে, বিশেষত জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীর পর থেকে পাকিস্তানে যে রাজনীতি চলে আসছে তার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সেখানে জনগণের মধ্যে যে তাগিদ মাঝে মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সেটা কোনো গণতান্ত্রিক দলই আজ পর্যন্ত ধারণ করতে পারেনি। তার ভিত্তিতে রাজনীতি সংগঠিত করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে সামরিক শাসন বারবার ফিরে এসেছে এবং বাহ্যত নির্বাচিত সরকার মাঝে মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও সে দেশে
সামরিক বাহিনীই সবসময় শাসন ক্ষমতা বেশ দৃঢ়ভাবে নিজের আয়ত্তে রেখেছে। এখনও সেখানে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আছে কিন্তু সংকটজনক এই সময়ে আবার সামরিক শাসন পাকিস্তানে ফিরে আসা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে। সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল কায়ানি সামরিক শাসনের সম্ভাবনা নাকচ করছেন; কিন্তু তিনি এ বিষয়ে এমনভাবে কথা বলছেন যাতে মনে হয়, ইচ্ছা করলেই তারা নির্বাচিত সরকার উচ্ছেদ করে সরাসরি ক্ষমতার হাল ধরতে পারেন। কিন্তু এ মুহূর্তে তারা সেটা করছেন না! এর থেকেও বোঝার অসুবিধা নেই যে, পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতায় না থাকলেও তাকে সালাম করেই বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে হচ্ছে।
স্বাধীনতার অল্পদিন পর ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যু হয়। লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু হয় ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর। তার মৃত্যু হয় এভাবে এটা বলা ঠিক নয়। তাকে হত্যা করা হয়। জিন্নাহ ও বিশেষ করে লিয়াকত আলী ছিলেন পাকিস্তানে বহিরাগত। এখানে উল্লেখ করা দরকার, লিয়াকত আলী স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। পূর্ব বাংলার পরিষদের সদস্যদের ভোটে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাকে নিজেদের কোনো প্রদেশ থেকে নির্বাচিত না করে তাকে যেমন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হওয়ার জন্য নমিনেশন দিয়েছিল, তেমনি লিয়াকত আলী নিজেও পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যসংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে এতে সম্মতি দিয়েছিলেন। শুধু লিয়াকত আলীই নয়, আরও কয়েকজন অবাঙালি কেন্দ্রীয় নেতা এভাবে পূর্ব বাংলার আইন পরিষদ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বহিরাগত হিসেবে মুসলিম লীগের মধ্যে পাঞ্জাবের একটি চক্র প্রথম থেকেই মোশতাক আহমদ গুরমানির নেতৃত্বে লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। তারাই ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় গুলি করে তাকে হত্যা করেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের পরমুহূর্তেই তারা অন্য এক হত্যাকারী দিয়ে লিয়াকত আলীর হত্যাকারীকেও ঘটনাস্থলে গুলি করে হত্যা করে। এভাবে লিয়াকত আলীর হত্যাকারীকে খুন করে সব ধরনের প্রমাণ গায়েব করার চেষ্টা করলেও তদন্তের মাধ্যমে কিছু প্রমাণ হাতে আসতে থাকার সময় যে বিমানযোগে প্রমাণের নথিপত্র করাচি আসছিল সেটি আকাশেই টাইম বোমা দিয়ে বিধ্বস্ত করা হয়। এসব সত্ত্বেও পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর গুরমানি যে এই হত্যা চক্রান্তের মধ্যমণি ছিলেন এ বিষয়টি প্রায় সকলেরই জানা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তার এবং চক্রান্তে লিপ্ত অন্যদের কিছুই হয়নি। এই চক্রান্তের মধ্যে সামরিক বাহিনীর লোকজনও সম্পর্কিত ছিল। পাঞ্জাবের যে চক্রটি এভাবে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেছিল তারা পরবর্তীকালে নানাভাবে চক্রান্তে লিপ্ত থেকে পাকিস্তানের সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে এমন সংকট তৈরি করেছিল যা শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন ডেকে এনেছিল। সেই থেকে প্রকাশ্যভাবেই সামরিক বাহিনী পাকিস্তানে প্রকৃত রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। ১৯৭২ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টো নির্বাচিত সরকারের প্রধান হলেও সামরিক বাহিনীকে সালাম করে তাকেও ক্ষমতায় থাকতে হয়েছিল। কিন্তু তাকেও অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেছিল সামরিক বাহিনী। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল জেনারেল জিয়াউল হক। পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের মধ্যে জেনারেল জিয়াউল হকের থেকে নিকৃষ্ট আর কেউ ছিল না।
পাকিস্তানের সামরিক শাসন এভাবে শিকড় গেড়ে বসে থাকার কারণ, স্বাধীনতার সময় মুসলিম লীগ ক্ষমতাসীন হলেও গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে তার বড় রকম দুর্বলতা ছিল। জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলী দু'জন সব থেকে প্রভাবশালী নেতার মধ্যে কেউই মুসলিম লীগে গণতান্ত্রিক কোনো ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিলেন না। কাজেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ কোনো সময়েই শক্তভাবে নিজেকে সংগঠিত রাখার চেষ্টা করেনি। সামন্ত ধ্যান-ধারণায় নিমজ্জিত পাঞ্জাবকেন্দ্রিক মুসলিম লীগ নেতৃত্ব অল্পদিনের মধ্যেই সামরিক বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এরপর আজ পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যই গড়ে ওঠেনি। মুসলিম লীগ, পিপলস পার্টি (পিপিপি) ইত্যাদি দলও সামন্তবাদী চরিত্রসম্পন্ন নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় পাকিস্তানের জনগণ কোনো সময়েই বিগত ৬০ বছরের বেশি সময়েও গণতন্ত্রের কোনো অভিজ্ঞতা লাভ করেনি। গণতান্ত্রিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা বলতে যা বোঝায় পাকিস্তানে তা কোনো সময়েই দেখা যায়নি। এখনও পর্যন্ত সেখানে সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতায় থাকুক অথবা না থাকুক, তারাই ক্ষমতার শীর্ষদেশে অবস্থান করে। তাদের অবজ্ঞা করে, তাদের কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই পাকিস্তানের বেসামরিক কোনো সরকারের নেই। বর্তমান গদিনশিন সরকারেরও একই অবস্থা।
পাকিস্তানে এখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এক অস্থিতিশীল অবস্থা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করার জন্য দেশি-বিদেশি নানা মহল দরজায় কড়া নাড়ছে, যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো এক গণনাযোগ্য বিদেশি শক্তি। কিন্তু এসব বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও তৎপরতার শিকার পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সামরিক শাসন এবং বেসামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে। এই প্রতিরোধের এক সূচক হলো, পাকিস্তানি সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি হতে থাকা। অক্টোবর মাসে তিনি লাহোরে যে জনসভা করেন সেখানে লক্ষাধিক লোক সমবেত হয়েছিল। গতকাল ২৫ ডিসেম্বর তিনি করাচিতে যে জনসভা করেছেন তারও অবস্থা একই প্রকার। বিশাল এক জনতা তার কথা শোনা ও তাকে সমর্থনের জন্য করাচির সভায় জড়ো হয়েছিলেন। করাচির এই সভা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, করাচি হলো বর্তমান ক্ষমতাসীন পিপিপির সব থেকে শক্তিশালী ঘাঁটি।
জনগণের মধ্যে যে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন আছে এবং তারা যে পাকিস্তানের সামরিক শাসনেরও বিরোধী এটা ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির মধ্যে দেখা গেলেও জনগণের দুর্ভাগ্যের অবসান হওয়ার কোনো লক্ষণ এই মুহূর্তে পাকিস্তানে আছে বলে মনে হয় না। কারণ, ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের এক প্রবল তাগিদ থেকে তৈরি হলেও ইমরান খান এই তাগিদের প্রতি সুবিচার করতে সক্ষম হবেন এমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার দল তেহরিকে ইনসাফের কোনো সুগঠিত কর্মসূচি নেই। তার দলে এমন নেতৃত্ব নেই যারা গণতান্ত্রিক শক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। তবে ইমরান খানের প্রতি পাকিস্তানের জনগণের সমর্থনের মাধ্যমে যে পাকিস্তানি জনগণের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বেশ ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা পাকিস্তানের বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করবে সেটাই
দেখার বিষয়।
২৬.১২.২০১১
স্বাধীনতার অল্পদিন পর ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যু হয়। লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু হয় ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর। তার মৃত্যু হয় এভাবে এটা বলা ঠিক নয়। তাকে হত্যা করা হয়। জিন্নাহ ও বিশেষ করে লিয়াকত আলী ছিলেন পাকিস্তানে বহিরাগত। এখানে উল্লেখ করা দরকার, লিয়াকত আলী স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। পূর্ব বাংলার পরিষদের সদস্যদের ভোটে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাকে নিজেদের কোনো প্রদেশ থেকে নির্বাচিত না করে তাকে যেমন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হওয়ার জন্য নমিনেশন দিয়েছিল, তেমনি লিয়াকত আলী নিজেও পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যসংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে এতে সম্মতি দিয়েছিলেন। শুধু লিয়াকত আলীই নয়, আরও কয়েকজন অবাঙালি কেন্দ্রীয় নেতা এভাবে পূর্ব বাংলার আইন পরিষদ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বহিরাগত হিসেবে মুসলিম লীগের মধ্যে পাঞ্জাবের একটি চক্র প্রথম থেকেই মোশতাক আহমদ গুরমানির নেতৃত্বে লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। তারাই ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় গুলি করে তাকে হত্যা করেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের পরমুহূর্তেই তারা অন্য এক হত্যাকারী দিয়ে লিয়াকত আলীর হত্যাকারীকেও ঘটনাস্থলে গুলি করে হত্যা করে। এভাবে লিয়াকত আলীর হত্যাকারীকে খুন করে সব ধরনের প্রমাণ গায়েব করার চেষ্টা করলেও তদন্তের মাধ্যমে কিছু প্রমাণ হাতে আসতে থাকার সময় যে বিমানযোগে প্রমাণের নথিপত্র করাচি আসছিল সেটি আকাশেই টাইম বোমা দিয়ে বিধ্বস্ত করা হয়। এসব সত্ত্বেও পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর গুরমানি যে এই হত্যা চক্রান্তের মধ্যমণি ছিলেন এ বিষয়টি প্রায় সকলেরই জানা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তার এবং চক্রান্তে লিপ্ত অন্যদের কিছুই হয়নি। এই চক্রান্তের মধ্যে সামরিক বাহিনীর লোকজনও সম্পর্কিত ছিল। পাঞ্জাবের যে চক্রটি এভাবে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেছিল তারা পরবর্তীকালে নানাভাবে চক্রান্তে লিপ্ত থেকে পাকিস্তানের সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে এমন সংকট তৈরি করেছিল যা শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন ডেকে এনেছিল। সেই থেকে প্রকাশ্যভাবেই সামরিক বাহিনী পাকিস্তানে প্রকৃত রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। ১৯৭২ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টো নির্বাচিত সরকারের প্রধান হলেও সামরিক বাহিনীকে সালাম করে তাকেও ক্ষমতায় থাকতে হয়েছিল। কিন্তু তাকেও অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেছিল সামরিক বাহিনী। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল জেনারেল জিয়াউল হক। পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের মধ্যে জেনারেল জিয়াউল হকের থেকে নিকৃষ্ট আর কেউ ছিল না।
পাকিস্তানের সামরিক শাসন এভাবে শিকড় গেড়ে বসে থাকার কারণ, স্বাধীনতার সময় মুসলিম লীগ ক্ষমতাসীন হলেও গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে তার বড় রকম দুর্বলতা ছিল। জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলী দু'জন সব থেকে প্রভাবশালী নেতার মধ্যে কেউই মুসলিম লীগে গণতান্ত্রিক কোনো ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিলেন না। কাজেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ কোনো সময়েই শক্তভাবে নিজেকে সংগঠিত রাখার চেষ্টা করেনি। সামন্ত ধ্যান-ধারণায় নিমজ্জিত পাঞ্জাবকেন্দ্রিক মুসলিম লীগ নেতৃত্ব অল্পদিনের মধ্যেই সামরিক বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এরপর আজ পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যই গড়ে ওঠেনি। মুসলিম লীগ, পিপলস পার্টি (পিপিপি) ইত্যাদি দলও সামন্তবাদী চরিত্রসম্পন্ন নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় পাকিস্তানের জনগণ কোনো সময়েই বিগত ৬০ বছরের বেশি সময়েও গণতন্ত্রের কোনো অভিজ্ঞতা লাভ করেনি। গণতান্ত্রিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা বলতে যা বোঝায় পাকিস্তানে তা কোনো সময়েই দেখা যায়নি। এখনও পর্যন্ত সেখানে সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতায় থাকুক অথবা না থাকুক, তারাই ক্ষমতার শীর্ষদেশে অবস্থান করে। তাদের অবজ্ঞা করে, তাদের কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই পাকিস্তানের বেসামরিক কোনো সরকারের নেই। বর্তমান গদিনশিন সরকারেরও একই অবস্থা।
পাকিস্তানে এখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এক অস্থিতিশীল অবস্থা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করার জন্য দেশি-বিদেশি নানা মহল দরজায় কড়া নাড়ছে, যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো এক গণনাযোগ্য বিদেশি শক্তি। কিন্তু এসব বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও তৎপরতার শিকার পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সামরিক শাসন এবং বেসামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে। এই প্রতিরোধের এক সূচক হলো, পাকিস্তানি সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি হতে থাকা। অক্টোবর মাসে তিনি লাহোরে যে জনসভা করেন সেখানে লক্ষাধিক লোক সমবেত হয়েছিল। গতকাল ২৫ ডিসেম্বর তিনি করাচিতে যে জনসভা করেছেন তারও অবস্থা একই প্রকার। বিশাল এক জনতা তার কথা শোনা ও তাকে সমর্থনের জন্য করাচির সভায় জড়ো হয়েছিলেন। করাচির এই সভা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, করাচি হলো বর্তমান ক্ষমতাসীন পিপিপির সব থেকে শক্তিশালী ঘাঁটি।
জনগণের মধ্যে যে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন আছে এবং তারা যে পাকিস্তানের সামরিক শাসনেরও বিরোধী এটা ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির মধ্যে দেখা গেলেও জনগণের দুর্ভাগ্যের অবসান হওয়ার কোনো লক্ষণ এই মুহূর্তে পাকিস্তানে আছে বলে মনে হয় না। কারণ, ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের এক প্রবল তাগিদ থেকে তৈরি হলেও ইমরান খান এই তাগিদের প্রতি সুবিচার করতে সক্ষম হবেন এমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার দল তেহরিকে ইনসাফের কোনো সুগঠিত কর্মসূচি নেই। তার দলে এমন নেতৃত্ব নেই যারা গণতান্ত্রিক শক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। তবে ইমরান খানের প্রতি পাকিস্তানের জনগণের সমর্থনের মাধ্যমে যে পাকিস্তানি জনগণের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বেশ ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা পাকিস্তানের বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করবে সেটাই
দেখার বিষয়।
২৬.১২.২০১১
No comments