ডুবন্ত পাকিস্তানকে ডাঙায় তুলবেন ইমরান! by সাইফুল সামিন

দীর্ঘ ২১ বছর ক্রিকেটের মাঠে অলরাউন্ডার হিসেবে ব্যাটে-বলে ঝড় তুলেছেন। অধিনায়ক হিসেবে ১৯৯২ সালে পাকিস্তানকে এনে দিয়েছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকাপের স্বপ্নের ট্রফি। ক্রিকেট মাঠ ছেড়ে এরপর নামেন রাজনীতির মাঠে; কিন্তু জটিল হিসাব-নিকাশের এ মাঠে এখন পর্যন্ত বড় কোনো চমক দেখাতে পারেননি তিনি। তবে অনেকেই তাঁকে পাকিস্তানের ত্রাণকর্তা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। গত রোববার করাচিতে অনুষ্ঠিত লক্ষাধিক জনতার সভায়


পাকিস্তানের ক্রিকেট কিংবদন্তি থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খানের বক্তব্যের আগে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, ‘এখন আপনাদের সামনে এমন একজন মানুষকে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যিনি পাকিস্তানকে রক্ষা করবেন।’
করাচির ওই সমাবেশ ছিল পাকিস্তানে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির একটি মহড়া। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ আয়োজন করতে পেরে ইমরান সে পরীক্ষায় উতরে গেছেন। জনসভায় অংশ নেওয়া জনতা ছিল ব্যাপক উজ্জীবনী শক্তিতে বলীয়ান এবং সংক্রামক ব্যাধির মতোই তা ছড়িয়ে পড়েছিল সবার মধ্যে।
ইমরান খানের তেহরিক-ই ইনসাফ দলের পতাকা হাতে সেই জনসমুদ্রে হাজির হয়েছিলেন ২৮ বছর বয়সী শোহাইদ সিদ্দিকি। তাঁর মতে, ‘ইমরান খানই আমাদের একমাত্র আশা।’
শোহাইদ সিদ্দিকির ২৩ বছর বয়সী বন্ধু মোহাম্মদ ওমরও এসেছিলেন ওই সভায়। বন্ধু সিদ্দিকির মন্তব্যের সঙ্গে যোগ করে ওমর বলেন, ‘আমাদের আমূল পরিবর্তন দরকার এবং এই পরিবর্তন আসবে ইমরান খানের মাধ্যমে।’
পাকিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের শাসনে যাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, করাচির সমাবেশে তাদের সবার মধ্যেই পরিবর্তনের এই তীব্র ক্ষুধা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির সরকার শুধু জনগণের স্বপ্নই ভঙ্গ করেনি, পুরো দেশকেই এক গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ইমরান প্রসঙ্গে করাচির সমাবেশে আগত ৫২ বছর বয়সী মুসারাত জুমানি বলেন, ‘আমাদের পাকিস্তান ধ্বংস হচ্ছে। এখন আমরা ক্ষমতায় এমন একজনকেই চাই। এটা একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। সম্ভবত এর মধ্য দিয়ে আমরা কিছু পাব।’
ইমরান নিজেই তাঁর এই জনসভাকে ‘শুভ সুনামি’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, ‘এই সুনামিই পাকিস্তান থেকে সব অবিচার ও দুর্নীতি সমূলে উপড়ে ফেলবে।’ করাচির জনসমুদ্রে ইমরান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে ৯০ দিনের মধ্যে দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করবে।
দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসিফ আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির ভূরি ভূরি অভিযোগ। সংগত কারণেই পাকিস্তানে তিনি ‘মিস্টার টেন পারসেন্ট’ নামে পরিচিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইমরান খানের শক্ত অবস্থান তাঁর জনসমর্থন বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।
করাচির সমাবেশে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ইমরান খান পাকিস্তানকে একটি ইসলামি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি—সেই রাষ্ট্রে জনগণ সমানভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ন্যায়বিচার পাবে।
ইসলামাবাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে সমাবেশে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইমরান। অবশ্য এর আগেও তিনি প্রকাশ্যে পাকিস্তানে মার্কিন বিমান হামলার তীব্র বিরোধিতা ও সমালোচনা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি মার্কিন সহায়তার ওপর পাকিস্তানের বর্তমান নির্ভরতার অবসান ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলেছেন ইমরান। তবে কারও কারও মতে, পাকিস্তানের বর্তমান রোগের একমাত্র দাওয়াই ইমরান নন।
ইমরানকে সমর্থন না করেও করাচির সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন সাদিয়া আগা। সমাবেশে বিপুল জনসমাগম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মানুষ এখানে এসেছে গান ও নাচের জন্য। ভালো সময় কাটানোর জন্য। হ্যাঁ, তিনি এটা করতে পেরেছেন। কিন্তু আপনারা কি মনে করেন, এখানে আগত জনতার সবাই ইমরানের সমর্থক?’
একই সঙ্গে ইমরান খানের আদর্শকে ‘বাসি’ বলে অভিহিত করেন সাদিয়া। ইমরান খানের আদর্শ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এতে পাকিস্তানের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন নেই।’ তবে সাদিয়া আগা এটাও স্বীকার করেন, ইমরান জনগণকে নতুন করে উদ্দীপিত করছেন।
করাচি এমন একটি শহর, যেখানে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত সহিংসতা তুঙ্গে। সেই প্রেক্ষাপটে উত্সবমুখর ওই সভা ছিল করাচির স্থিতিশীলতার জন্য বেশ তাত্পর্যপূর্ণ একটা ঘটনা।
ইমরান খান গত ৩০ অক্টোবর একই ধরনের আরেকটি সভা করেছিলেন তাঁর নিজ শহর লাহোরে। সেখানেও লক্ষাধিক জনতার সমাগম ঘটেছিল। সেটাও ছিল লাহোরের ইতিহাসে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশ।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, জনসমর্থন সব সময় রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নির্দেশ করে না। পাকিস্তানের অধিকাংশ ভোটারই গ্রাম পর্যায়ের। ওই ভোটাররা পরিচালিত হন স্থানীয় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা। এ ব্যবস্থাই তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্য ঠিক করে দেয়। করাচি কিংবা লাহোরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে ইমরানের সমর্থনে বড় কোনো সমাবেশ চোখে পড়ে না।
তা ছাড়া ইমরান এখনো তাঁর রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেননি। যদিও আগামী দিনগুলোতে তা প্রকাশ করার বিষয়ে করাচির সমাবেশে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
গত ১৫ বছর ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন ইমরান। তবে পার্লামেন্টে তাঁর দল তেহরিক-ই-ইনসাফ এ পর্যন্ত মাত্র একটি আসন পেয়েছে। সবকিছুর পরও পাকিস্তানে ইমরান খানই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁকে দেশটির উদ্ধারকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইমরান যদি তাঁর এই বেড়ে চলা জনসমর্থন ধরে রাখতে সক্ষম হন, তবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি অবশ্যই একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠবেন।
তবে এই মুহূর্তে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় কথা হলো, পুরো দেশ এখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ। পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ এমন একজন কান্ডারির অপেক্ষায়, যিনি তাদের ডুবু ডুবু জাহাজটিকে উদ্ধার করবেন।
ইউগভ/ক্যামব্রিজ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের শুরুর দিকে পাকিস্তানে একটি জনমত জরিপ করেছে। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, পাকিস্তানে যদি নির্বাচন হয়, তবে ইমরান খানই হচ্ছেন দেশটির পরবর্তী নেতা।
ওই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ১৯ জন সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্য থেকে তাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য নেতা নির্বাচন করতে বলা হয়। জরিপে সর্বাধিক ৬১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ইমরান খানকে তাদের প্রথম পছন্দের নেতা বলে উল্লেখ করেন। আর ৭৭ শতাংশ তাদের প্রথম বা দ্বিতীয় পছন্দের নেতা হিসেবে ইমরানের নাম বেছে নেয়।
এর পরের অবস্থানে ধারাবাহিকভাবে আছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ, বর্তমান সেনাপ্রধান আশফাক পারভেজ কায়ানি এবং তারপর আছেন আসিফ আলী জারদারি। তবে এই জরিপ ছিল শহরকেন্দ্রিক।
পাকিস্তানে ইমরানের যে সমালোচনা নেই, তা নয়। তবে দেশটিতে তিনি ‘পরিচ্ছন্ন’ ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। সেখানকার রাজনীতিতে এমন ঘটনা বিরলই বটে।
২০১৩ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ইমরান আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছেন, ক্ষয়িষ্ণু পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত থেকে তিনি রক্ষা করবেন। দূর করবেন দেশটির সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
দ্য ডন পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাত্কারে ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আগামী নির্বাচনে তিনি লড়বেন কি না? উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনে আমাদের বিপুল বিজয় হবে। আর বলছেন, লড়ব কি না! ভবিষ্যতে যে দলটি ক্ষমতায় যাচ্ছে, তার নাম তেহরিক-ই ইনসাফ।’
এ ধরনের আত্মবিশ্বাসের যথার্থতা প্রমাণে ইমরান বলেছেন, ‘আমি যে কারও সঙ্গে বাজি ধরতে পারি। আমি পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলেছি। শেষ বিশ্বকাপ ছাড়া আমি কখনো কাউকে বলিনি যে আমরা এটা জিততে যাচ্ছি।’
ইমরান অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তান পিপলস পার্টির শাসনে দেশটির রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় ধস নেমেছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে তিনি বিশ্বাস করেন, ক্ষমতা তাঁর হাতের মুঠোয়।
কিন্তু পার্লামেন্টে তাঁর দলের কোনো আসন নেই। তা ছাড়া নির্বাচনে জয়লাভ করার মতো তৃণমূলে তাঁর দলের জনসমর্থন ও দলীয় কাঠামো তেমন জোরালো নয়।
সমালোচকদের মতে, ইমরান পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রিয়পাত্র। তাঁর চোখধাঁধানো ‘প্লে বয়’ ধাঁচের জীবনব্যবস্থা, ব্রিটিশ নাগরিক জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে এবং পরে বিচ্ছেদ নিয়ে পাকিস্তানে তাঁর ব্যাপারে সন্দেহ আছে।
তালেবানদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধে ইমরানের আহ্বান এবং তাঁর জনপ্রিয় মার্কিনবিরোধী মনোভাব বিষয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্লেষক ও পশ্চিমা সাংবাদিকেরা তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তবে গত সপ্তাহে মার্কিন জরিপ সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার তাদের জরিপে ইমরান খানকে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ওই জরিপে পাকিস্তানে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল ৬৮ শতাংশ। সেখানে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির গ্রহণযোগ্যতা ১১ শতাংশ।
ইমরান নিজেও পিউ রিসার্চ সেন্টারের এই পর্যবেক্ষণকে সত্য বা যথার্থ বলে অভিহিত করেছেন। এই জরিপের ফলাফলকে তিনি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ থেকে পাকিস্তানের নেতৃত্বকে সরে আসার আহ্বানের প্রতিফলন বলেই উল্লেখ করেছেন।
ইমরান বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন এলিটরা, শুধু মার্কিন সমর্থনের স্বার্থে এবং ডলারের জন্য নিজেদের লোকদের হত্যা করছে। নিজেদের লোকদের হত্যার জন্য তারা টাকা নিচ্ছে। এটাই আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায়।’
পাকিস্তানের প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান আসকারির মতে, ইমরান খানের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাঁর জনসভার সমাগমকে ভোটে রূপান্তর করা। আর তালেবানদের ব্যাপারে তাঁর নমনীয় অবস্থান এবং বিরোধীরা তাঁকে বেশ ভোগাবে।
ইমরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ সম্পর্কে হাসান আসকারি বলেন, ‘অনেক বিষয় বিবেচনা করে পাকিস্তানের জনগণ তাদের ভোট দেয় এবং ইমরানের সমস্যা হলো তিনি সব নেতাকেই চোর ডাকেন।’

No comments

Powered by Blogger.