ব্লগার নয়, অপরাধীদের জন্যই সাইবার আইন by আইরিন সুলতানা
কেস স্টাডি-১:
জনপ্রিয় অভিনেত্রী জুলিয়া রবার্টস আইনি অভিযোগ আনেন, তার নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন জনৈক রাসেল বয়েড। মোকাদ্দমায় জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাসেল আরও বেশ কিছু সেলিব্রিটির নামে এমন ওয়েবসাইট করেছেন যার সঙ্গে ওই ব্যক্তিরা কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী জুলিয়া রবার্টস আইনি অভিযোগ আনেন, তার নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন জনৈক রাসেল বয়েড। মোকাদ্দমায় জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাসেল আরও বেশ কিছু সেলিব্রিটির নামে এমন ওয়েবসাইট করেছেন যার সঙ্গে ওই ব্যক্তিরা কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন।
অভিযুক্ত ব্যক্তি জুলিয়া রবার্টসের নামে করা ডমেইন ই-কমার্স সাইট ই-বে’তে নিলামের জন্যও তুলেছিলেন। আদালত অভিযুক্তের এ আচরণকে ‘ব্যাড ফেইথ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। আর জুলিয়া বরার্টসকে ডমেইনটি হস্তান্তর করা হয়।
কেস স্টাডি-২:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুরের ব্যক্তিগত ই-মেইল হিসেবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয় একটি ইমেইজ ফাইল। প্রথমত, ইমেইল হ্যাক হয়ে থাকলে তা একটি অপরাধ। দ্বিতীয়ত, ইমেইল গ্রাফিকসটি ভূয়া প্রমাণিত হলে (এরই মধ্যে ব্লগে বিভিন্ন ক্রসচেকিংয়ের মাধ্যমে দেখানো হয় ইমেইল গ্রাফিকসটির ভূয়া হওয়ার সম্ভাবনা), ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে ইন্টারনেটে এ ধরনের অপপ্রচারনা আরেকটি অপরাধ। এমনকি যারা সত্য বিচার না করে ইংরেজিতে লেখা ইমেইলের বাংলা অনুবাদ করে তা ব্লগে ব্লগে প্রচার করছিলেন, তাদেরকেও অপরাধী সাব্যস্ত করা যায়।
কেস স্টাডি-৩:
গণমাধ্যমগুলোতে ফারজানা কর্তৃক হীরনকে তালাক দেওয়ার ঘটনা যখন বেশ আলোচিত। তখন নারী হিসেবে ফারজানাকে সহজেই বিতর্কিত করার আপত্তিকর প্রচেষ্টা দেখা গেল ইন্টারনেটে। হীরনের ফেসবুক ওয়ালে আপত্তিকর বক্তব্যসহ ফারজানার ছবি এবং মোবাইল ফোন নম্বর প্রকাশ করা হয়। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কেস স্টাডি-৪:
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, লেখক জাফর ইকবালকে অপদস্থ করতে একটি বিশেষ চক্র সবসময় সোচ্চার থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলের কোনো অনুষ্ঠানে নিজের স্ত্রী-কন্যার উপস্থিতিতে গানের তালে তাল মেলানোর ভিডিও অসৎ উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হলো ফেসবুক আর বাংলা ব্লগগুলোতে। যদিও সচেতন ব্লগারদের প্রতিবাদের কারণে এরূপ অপপ্রচার থিতু হয়ে এসেছিল, তবে যারা এভাবে ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে ব্যক্তি আক্রমণে উদ্যোত হয়েছিলেন, এদের আচরণকে ক্রাইম হিসেবে গণ্য করতেই হবে।
সাইবার আইন:
সাধারণত ইন্টারনেটে তথ্য-অর্থ-ব্যক্তি-জাতীয় নিরাপত্তা কোনোভাবে বিঘ্নিত হলে তা সাইবার ক্রাইম হিসেবে বিবেচিত হয়। সাইবার আইন ইন্টারনেট আইন হিসেবেও পরিচিত। অন্যদিকে সাইবার ক্রাইম পরিচিত সাইবার টেরোরিজম বা সাইবার সন্ত্রাস হিসেবে। দুটি পর্যায়ে এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে ভাগ করা সম্ভব – (১) ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম্পিউটার, নেটওয়ার্ক অবকাঠামোকে সরাসরি আক্রমণ, (২) ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যক্তি ও জাতীয় নিরাপত্তায় ব্যতয় ঘটানো। এ দু অংশে সাইবার
অপরাধ রূপে যা যা ঘটে বা ঘটতে পারে –
(১) ভাইরাস আক্রমণ
(২) ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় ওয়েব সাইট হ্যাকিং
(৩) স্প্যামিং, মেলওয়্যার
(৪) সাইবার স্টকিং বা সাইবার হয়রানি – ইমেইল বা ব্লগ বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করে হুমকি প্রদান, ব্যক্তির নামে মিথ্যাচার/অপপ্রচার, নারী অবমাননা, যৌন হয়রানি
(৫) ফিশিং – লগইন/অ্যাকসেস তথ্যচুরি, বিশেষত ই-কমার্স, ই-ব্যাংকিং সাইটগুলো ফিশারদের লক্ষবস্তু হয়ে থাকে। র্যাপিডশেয়ার সাইটের প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট অ্যাকসেস তথ্য চুরির মত ফিশিং ঘটেছে। ফিশারদের দ্বারা মাইস্পেসের লগইন তথ্যও চুরি হয়েছিল।
(৬) অর্থ আত্মসাৎ - ইন্টারনেট থেকে তথ্য চুরি করে ব্যাংকের এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর একটি উদাহরণ। ইন্টারনেটে ব্লগ, ইমেইল, ফেসবুক ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অথবা প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনাও ঘটে। যেমন: কিছুদিন আগে ব্লগার হাসনা হেনা ও রোজলীনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বাংলা ব্লগ থেকে অর্থ জোচ্চুরির অভিযোগ উত্থাপিত হয়।
(৭) সাইবার মাদক ব্যবসা – পুলিশের চোখ এড়াতে ইদানীং ইন্টারনেট ব্যবহার করে মাদক চালানের ব্যবসায়িক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে
(৮) পাইরেসি – সদ্য প্রকাশিত গান ও সিনেমার এমপিথ্রি বা মুভি ফাইল ইন্টারনেটে শেয়ার হয়ে যাচ্ছে পলকে
(৯) ইন্টেলেকচুয়্যাল প্রোপার্টি – ব্লগ ও ওয়েব সাইট থেকে কোন লেখা, ফটোগ্রাফ সহজেই কপি-পেস্ট করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে সাইবার কমিউনিটিতে
(১০) পর্নোগ্রাফি – শিশু পর্নোগ্রাফি ইন্টারনেটে ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্নোগ্রাফিতে গোপনে ধারনকৃত, অনুমতিহীন ব্যক্তিগত ছবি/ভিডিও প্রকাশ বৃদ্ধি পেয়েছে
(১১) ব্যক্তিগত তথ্য-পরিচয়-ছবি চুরি ও ইন্টারনেটের অপ্যব্যবহার যারা নিয়মিতভাবে ইন্টারনেটে বিচরণ করেন, তাদের আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থেকে যায়।
বাংলাদেশে সাইবার আইন:
ইংল্যান্ড বিশ্বে প্রথম সাইবার আইন প্রণেতা হিসেবে তৈরি করে ‘কম্পিউটার মিসইউজ অ্যাক্ট ১৯৯০’। ই-ক্রাইম প্রতিরোধে ২০০৮ সালে জাতীয় ই-ক্রাইম ইউনিটও গঠন করা হয়। ভারতে তৈরি হয় ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০০’।
বাংলাদেশে সাইবার আইন প্রণয়ণে মিশ্র আলোচনা জারি থাকলেও, একটা তথ্য অনেকেরই কাছেই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তা হচ্ছে বাংলাদেশে ২০০৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ আইন তৈরি করা হয় এবং ২০০৯ সালে এই আইনে কিছু পরিমার্জনা করা হয়। ধরে নেওয়া যাক, এ তথ্যপ্রযুক্তি আইনই আমাদের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োগ হবে।
সমস্যা হলো, আমাদের দেশে আইন থাকলেও আইনি অব্যবস্থাপনা নিয়ে জনসাধারণের ক্ষোভ হরহামেশাই দেখা গেছে। নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকারই যেখানে নিশ্চিত নয়, সেখানে ইন্টারনেটে ব্যক্তি নিরাপত্তা দাবি করা বাতুলতাই। তদুপরি, রাষ্ট্রীয় প্রচারণার অভাবে নাগরিকদের আইনি অধিকার দিতে কোন আইনে কী প্রতিকার লাভ সম্ভব, তা নাগরিকদের কাছে অজ্ঞাতই থেকে যায়।
অবশ্য ঘোষিত তথ্যপ্রযুক্তি আইন সাইবার অপরাধ শনাক্তকরণ ও বিচারকার্য পরিচালনায় কতটা যুগপযোগী তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাছাড়া প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে, তাতে অপরাধের ধরণও পাল্টে যাচ্ছে। এ জন্য সাইবার আইন বিষয়ে গবেষণার দাবি রাখে।
সাইবার আইন কেবলমাত্র রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন প্রযুক্তি অবকাঠামোতে সংগঠিত সাইবার অপরাধের জন্য প্রযোজ্য হবে তা নয়। একজন বাংলাদেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রবাস থেকেও বাংলাদেশে অপরাধমূলক কাজ পরিচালনা করতে পারেন। তাই সাইবার অপরাধিকে শনাক্তকরণে, প্রয়োজনীয় সাইবার তথ্য বিনিময়ে ও সর্বপরি অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে দুটি দেশের মধ্যে বিশেষ সাইবার নীতিমালা থাকতে হবে।
সাইবার অপরাধ মনিটরিং ও অভিযোগ দায়ের করার জন্য ‘জাতীয় সাইবার সেল’ গঠন করা জরুরী। এ সেলের প্রযুক্তিগত সুবিধা উন্নততর হতে হবে যেন কোনো অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযুক্তের ইন্টারনেট গতিবিধি ট্র্যাকিং, ট্রেসিং করে অকাট্য তথ্য দ্রুততার সঙ্গে আদালতে পেশ করা সম্ভব হয়।
সাইবার আইন ডিসকোর্স:
তৃতীয় বাংলা ব্লগ দিবসে প্রথমবার প্রতিপাদ্য সংযোজিত হয় ‘গণজাগরণে সামাজিকযোগাযোগমাধ্যম ও সাইবার আইন‘।
সোশ্যাল মিডিয়ার গণজাগরণ নিয়ে আমাদের সম্যক ধারণা আছে। কিন্তু এরই মধ্যে সাইবার আইন নিয়ে আমাদের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ ও প্রতিপক্ষ অবস্থান তৈরি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, একটি বিস্তৃত পরিসরের আলোচনা কেবল এবং কেবলমাত্র দুটো বিষয়ে আবদ্ধ হয়ে আছে (১) ব্লগ নিয়ন্ত্রণ (২) বাক স্বাধীনতা হরণ।
এ পর্যন্ত সাইবার আইন প্রসঙ্গে আমরা শূধূ ব্লগ নিয়েই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছি। অথচ ‘সাইবার’ যদি সৌরজগৎ হয় তো ব্লগের একটি গ্রহ মাত্র। কারো কারো ক্ষেত্রে অবশ্য এরূপ আশঙ্কায় স্বাভাবিক অধিকার নিশ্চিতকরণের চাহিদা আছে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে আছে উদ্দেশ্যমূলক উস্কানি। বাক স্বাধীনতার মতো দ্বায়িত্বপূর্ণ আচরণ নিয়ে এমন অনেকেই উচ্চবাচ্য করছেন, যারা মূলত ‘গালি স্বাধীনতা’ চর্চা করেন। এরূপ গোষ্ঠির উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় প্রভাবিত হলে সাইবার আইন সংক্রান্ত সার্বিক সচেতনতা বিঘ্নিত হবে।
সরকার ব্লগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন- এমন আশঙ্কায় নেটিজেনরা আশংকায় পড়তেই পারেন। তবে রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, ব্লগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘটা করে সাইবার আইন প্রণয়ন জরুরী হয়ে ওঠে না। রাষ্ট্র গনতান্ত্রিক আলাপের বিরুদ্ধে গিয়ে একনায়কতন্ত্রে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে সাইবার আইন ছাড়াই। বরং বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিজেদের স্বার্থে সাইবার আইনে বাক স্বাধীনতা বান্ধব বিধি যোগে সচেষ্ট হতে হবে নেটিজেনদেরই।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে যখন প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়, তখন একই সঙ্গে প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার পর্যবেক্ষণ বিধিমালা নীতিনির্ধারণী চিত্রে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। অন্যথা তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও সাইবার আইন ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা প্রণয়ন একটি অপূর্নাঙ্গ রোডম্যাপ।
ব্লগাররা বিভিন্ন কারণেই রাজনৈতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠেন। প্রশ্ন হতেই পারে, ব্লগারদের সমালোচনা করা হলে, তারা এতো প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন কেন? মন্ত্রী আশরাফ সাহেব যখন ব্লগ বলতে পর্নোগ্রাফি বুঝে থাকেন, তখন বুঝতে হবে, তিনি তথ্যগত দিক দিয়ে অন্ধকারে আছেন এবং যেটুকু তার সম্মুখে এসেছে, সেটুকু জুড়ে আপত্তিকর কিছু থাকতেই পারে। ব্লগারদের বরং এ সুবাদে পর্নোগ্রাফি সাইটগুলোকে চিহ্নিত করেও বিশেষ কোন ব্লগে যদি প্রতিনিয়ত অশ্লীলতাকেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয়, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কী কী করণীয় আছে তা জানতে মন্ত্রী সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিৎ।
ব্লগারদের সমালোচনা হলেই বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে এমন গোষ্ঠিবদ্ধ হুজুগ প্রকারান্তরে কোন ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে না। ব্লগাররা সমালোচনার উর্ধ্বে থাকা কেউ নন। ইন্টারনেটবাসীরা তিউনিশিয়ায় বিপ্লব করেছিল বলে, আরব বসন্ত এনেছিল বলে তাবৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বিপ্লবী হয়ে যান না।
আজকাল মাউসের ক্লিকে ক্লিকে বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে বিশ্বে। তাহলে এ যুগের বিপ্লব কী জলবৎ তরল হয়ে যায়নি? ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা আর আমাদের ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধারাও বিপ্লবী ছিলেন। তাদের মত ধৈর্য, আত্মত্যাগ, দূরদর্শীতা, দায়িত্ববোধ, প্রজ্ঞা আদৌ কতটুকু আছে আমাদের মাঝে?
একটা ছোট প্রতীক খুঁজে নেই আলোচনার এ অংশে – ছুরি! সুস্থ মানসিকতার কেউ ছুরি ব্যবহার করে সবজি-ফল কাটতে পারেন, দড়ির প্যাঁচ কাটতে পারেন, আর বেসামাল হলে আঙ্গুল কেটে ফেলতে পারেন। অন্যদিকে অসুস্থ মানসিকতার কেউ ছুরি দিয়ে অপরকে আহত-নিহত করতে পারেন। ব্যবহারকারীর কারণে প্রযুক্তি-ইন্টারনেট ছুরির মত কার্যকরী হতে পারে, আত্মঘাতি হতে পারে, আবার হতে পারে ভয়ংকরও!
দায়িত্বশীলতার কথাটা এখানেই বারবার উত্থাপিত হয়। দায়িত্বশীলতার প্রত্যাশা পারস্পারিকও বটে। ব্লগার-নেটিজেনরা সরকারের কাছে দ্বায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করবে, বিপরীতে সরকার ব্লগার-নেটিজেনদের কাছেও দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া চাইবে। কোন ধরনের অচলাবস্থা এড়াতে দুপক্ষের মুখোমুখি মুক্তালোচনাকে স্বাগত জানানোর পরিসর রাখাটা মত প্রকাশের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে দেবে নিশ্চিত।
প্রকৃতপক্ষে, ইন্টারনেটে বাক স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টি সাইবার আইনের আওতাধীন হলেও সাইবার আইনকে শুধু এবং শুধুমাত্র বাক স্বাধীনতা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করলে সেটা আমাদের পুরো ভার্চুয়াল জগতের বহুবিধ (‘সু’ এবং ‘কু’) কাজকে তুলে ধরতে ও বুঝে উঠতে না পারার ব্যর্থতা হতে পারে। সাইবার আইনের আওতায় কী কী থাকতে পারে, তা না জানার ঘাটতিতে সাইবার আইন নিয়ে আমাদের মধ্যে যে দ্বিধাবোধ জেগেছে, তাতে আমাদের সাইবার আইনকেন্দ্রিক প্রত্যাশা ও আশঙ্কা পুরোটাই বাক স্বাধীনতাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।
অবশ্য প্রত্যাশা ও আশঙ্কা দুটোরই সহাবস্থান এ পর্যায়ে থাকা ভাল। কেবল এর পরিসর একমুখী না করে বহুমুখীকরণ হওয়া চাই। নয়তো আমরা পুরো ইস্যুটিকে আমাদের মাঝেই ‘মিসলিড’ করার সুযোগ করে দিতে পারি। ইন্টারনেট ইউজার মাত্রই যে ব্লগার হবেন এমন কিছু নয়। তাই ইন্টারনেট ব্যবহার মানেই যে ব্লগিং হতে হবে এমনও কারণ নেই। ফলে সাইবার আইন শুধু ও শুধূমাত্র ব্লগ ও ব্লগারদের জন্য নয়।
একথা অনস্বীকার্য, সাইবার আইন নিয়ে আমাদের অজ্ঞতার, ইতস্ততার সবচে বড় ফায়দা নেবেন তারাই যারা ইন্টারনেটে সুস্থ ধারায় মত প্রকাশে বিশ্বাস রাখেন না, যারা ইন্টারনেটে অশ্লীলতাকে ছড়িয়ে দিতে সংঘবদ্ধ। প্রথাগত আইনি ধারনা এড়িয়ে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাইবার আইন মুক্তমত চর্চাকারী নেটিজেন, ব্লগারদের জন্য বান্ধব হয়ে উঠবে আর কাল হয়ে উঠবে শুধু প্রকৃত সাইবার অপরাধীদের জন্য।
কেস স্টাডি-২:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুরের ব্যক্তিগত ই-মেইল হিসেবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয় একটি ইমেইজ ফাইল। প্রথমত, ইমেইল হ্যাক হয়ে থাকলে তা একটি অপরাধ। দ্বিতীয়ত, ইমেইল গ্রাফিকসটি ভূয়া প্রমাণিত হলে (এরই মধ্যে ব্লগে বিভিন্ন ক্রসচেকিংয়ের মাধ্যমে দেখানো হয় ইমেইল গ্রাফিকসটির ভূয়া হওয়ার সম্ভাবনা), ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে ইন্টারনেটে এ ধরনের অপপ্রচারনা আরেকটি অপরাধ। এমনকি যারা সত্য বিচার না করে ইংরেজিতে লেখা ইমেইলের বাংলা অনুবাদ করে তা ব্লগে ব্লগে প্রচার করছিলেন, তাদেরকেও অপরাধী সাব্যস্ত করা যায়।
কেস স্টাডি-৩:
গণমাধ্যমগুলোতে ফারজানা কর্তৃক হীরনকে তালাক দেওয়ার ঘটনা যখন বেশ আলোচিত। তখন নারী হিসেবে ফারজানাকে সহজেই বিতর্কিত করার আপত্তিকর প্রচেষ্টা দেখা গেল ইন্টারনেটে। হীরনের ফেসবুক ওয়ালে আপত্তিকর বক্তব্যসহ ফারজানার ছবি এবং মোবাইল ফোন নম্বর প্রকাশ করা হয়। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কেস স্টাডি-৪:
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, লেখক জাফর ইকবালকে অপদস্থ করতে একটি বিশেষ চক্র সবসময় সোচ্চার থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলের কোনো অনুষ্ঠানে নিজের স্ত্রী-কন্যার উপস্থিতিতে গানের তালে তাল মেলানোর ভিডিও অসৎ উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হলো ফেসবুক আর বাংলা ব্লগগুলোতে। যদিও সচেতন ব্লগারদের প্রতিবাদের কারণে এরূপ অপপ্রচার থিতু হয়ে এসেছিল, তবে যারা এভাবে ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে ব্যক্তি আক্রমণে উদ্যোত হয়েছিলেন, এদের আচরণকে ক্রাইম হিসেবে গণ্য করতেই হবে।
সাইবার আইন:
সাধারণত ইন্টারনেটে তথ্য-অর্থ-ব্যক্তি-জাতীয় নিরাপত্তা কোনোভাবে বিঘ্নিত হলে তা সাইবার ক্রাইম হিসেবে বিবেচিত হয়। সাইবার আইন ইন্টারনেট আইন হিসেবেও পরিচিত। অন্যদিকে সাইবার ক্রাইম পরিচিত সাইবার টেরোরিজম বা সাইবার সন্ত্রাস হিসেবে। দুটি পর্যায়ে এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে ভাগ করা সম্ভব – (১) ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম্পিউটার, নেটওয়ার্ক অবকাঠামোকে সরাসরি আক্রমণ, (২) ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যক্তি ও জাতীয় নিরাপত্তায় ব্যতয় ঘটানো। এ দু অংশে সাইবার
অপরাধ রূপে যা যা ঘটে বা ঘটতে পারে –
(১) ভাইরাস আক্রমণ
(২) ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় ওয়েব সাইট হ্যাকিং
(৩) স্প্যামিং, মেলওয়্যার
(৪) সাইবার স্টকিং বা সাইবার হয়রানি – ইমেইল বা ব্লগ বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করে হুমকি প্রদান, ব্যক্তির নামে মিথ্যাচার/অপপ্রচার, নারী অবমাননা, যৌন হয়রানি
(৫) ফিশিং – লগইন/অ্যাকসেস তথ্যচুরি, বিশেষত ই-কমার্স, ই-ব্যাংকিং সাইটগুলো ফিশারদের লক্ষবস্তু হয়ে থাকে। র্যাপিডশেয়ার সাইটের প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট অ্যাকসেস তথ্য চুরির মত ফিশিং ঘটেছে। ফিশারদের দ্বারা মাইস্পেসের লগইন তথ্যও চুরি হয়েছিল।
(৬) অর্থ আত্মসাৎ - ইন্টারনেট থেকে তথ্য চুরি করে ব্যাংকের এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর একটি উদাহরণ। ইন্টারনেটে ব্লগ, ইমেইল, ফেসবুক ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অথবা প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনাও ঘটে। যেমন: কিছুদিন আগে ব্লগার হাসনা হেনা ও রোজলীনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বাংলা ব্লগ থেকে অর্থ জোচ্চুরির অভিযোগ উত্থাপিত হয়।
(৭) সাইবার মাদক ব্যবসা – পুলিশের চোখ এড়াতে ইদানীং ইন্টারনেট ব্যবহার করে মাদক চালানের ব্যবসায়িক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে
(৮) পাইরেসি – সদ্য প্রকাশিত গান ও সিনেমার এমপিথ্রি বা মুভি ফাইল ইন্টারনেটে শেয়ার হয়ে যাচ্ছে পলকে
(৯) ইন্টেলেকচুয়্যাল প্রোপার্টি – ব্লগ ও ওয়েব সাইট থেকে কোন লেখা, ফটোগ্রাফ সহজেই কপি-পেস্ট করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে সাইবার কমিউনিটিতে
(১০) পর্নোগ্রাফি – শিশু পর্নোগ্রাফি ইন্টারনেটে ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্নোগ্রাফিতে গোপনে ধারনকৃত, অনুমতিহীন ব্যক্তিগত ছবি/ভিডিও প্রকাশ বৃদ্ধি পেয়েছে
(১১) ব্যক্তিগত তথ্য-পরিচয়-ছবি চুরি ও ইন্টারনেটের অপ্যব্যবহার যারা নিয়মিতভাবে ইন্টারনেটে বিচরণ করেন, তাদের আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থেকে যায়।
বাংলাদেশে সাইবার আইন:
ইংল্যান্ড বিশ্বে প্রথম সাইবার আইন প্রণেতা হিসেবে তৈরি করে ‘কম্পিউটার মিসইউজ অ্যাক্ট ১৯৯০’। ই-ক্রাইম প্রতিরোধে ২০০৮ সালে জাতীয় ই-ক্রাইম ইউনিটও গঠন করা হয়। ভারতে তৈরি হয় ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০০’।
বাংলাদেশে সাইবার আইন প্রণয়ণে মিশ্র আলোচনা জারি থাকলেও, একটা তথ্য অনেকেরই কাছেই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তা হচ্ছে বাংলাদেশে ২০০৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ আইন তৈরি করা হয় এবং ২০০৯ সালে এই আইনে কিছু পরিমার্জনা করা হয়। ধরে নেওয়া যাক, এ তথ্যপ্রযুক্তি আইনই আমাদের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োগ হবে।
সমস্যা হলো, আমাদের দেশে আইন থাকলেও আইনি অব্যবস্থাপনা নিয়ে জনসাধারণের ক্ষোভ হরহামেশাই দেখা গেছে। নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকারই যেখানে নিশ্চিত নয়, সেখানে ইন্টারনেটে ব্যক্তি নিরাপত্তা দাবি করা বাতুলতাই। তদুপরি, রাষ্ট্রীয় প্রচারণার অভাবে নাগরিকদের আইনি অধিকার দিতে কোন আইনে কী প্রতিকার লাভ সম্ভব, তা নাগরিকদের কাছে অজ্ঞাতই থেকে যায়।
অবশ্য ঘোষিত তথ্যপ্রযুক্তি আইন সাইবার অপরাধ শনাক্তকরণ ও বিচারকার্য পরিচালনায় কতটা যুগপযোগী তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাছাড়া প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে, তাতে অপরাধের ধরণও পাল্টে যাচ্ছে। এ জন্য সাইবার আইন বিষয়ে গবেষণার দাবি রাখে।
সাইবার আইন কেবলমাত্র রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন প্রযুক্তি অবকাঠামোতে সংগঠিত সাইবার অপরাধের জন্য প্রযোজ্য হবে তা নয়। একজন বাংলাদেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রবাস থেকেও বাংলাদেশে অপরাধমূলক কাজ পরিচালনা করতে পারেন। তাই সাইবার অপরাধিকে শনাক্তকরণে, প্রয়োজনীয় সাইবার তথ্য বিনিময়ে ও সর্বপরি অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে দুটি দেশের মধ্যে বিশেষ সাইবার নীতিমালা থাকতে হবে।
সাইবার অপরাধ মনিটরিং ও অভিযোগ দায়ের করার জন্য ‘জাতীয় সাইবার সেল’ গঠন করা জরুরী। এ সেলের প্রযুক্তিগত সুবিধা উন্নততর হতে হবে যেন কোনো অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযুক্তের ইন্টারনেট গতিবিধি ট্র্যাকিং, ট্রেসিং করে অকাট্য তথ্য দ্রুততার সঙ্গে আদালতে পেশ করা সম্ভব হয়।
সাইবার আইন ডিসকোর্স:
তৃতীয় বাংলা ব্লগ দিবসে প্রথমবার প্রতিপাদ্য সংযোজিত হয় ‘গণজাগরণে সামাজিকযোগাযোগমাধ্যম ও সাইবার আইন‘।
সোশ্যাল মিডিয়ার গণজাগরণ নিয়ে আমাদের সম্যক ধারণা আছে। কিন্তু এরই মধ্যে সাইবার আইন নিয়ে আমাদের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ ও প্রতিপক্ষ অবস্থান তৈরি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, একটি বিস্তৃত পরিসরের আলোচনা কেবল এবং কেবলমাত্র দুটো বিষয়ে আবদ্ধ হয়ে আছে (১) ব্লগ নিয়ন্ত্রণ (২) বাক স্বাধীনতা হরণ।
এ পর্যন্ত সাইবার আইন প্রসঙ্গে আমরা শূধূ ব্লগ নিয়েই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছি। অথচ ‘সাইবার’ যদি সৌরজগৎ হয় তো ব্লগের একটি গ্রহ মাত্র। কারো কারো ক্ষেত্রে অবশ্য এরূপ আশঙ্কায় স্বাভাবিক অধিকার নিশ্চিতকরণের চাহিদা আছে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে আছে উদ্দেশ্যমূলক উস্কানি। বাক স্বাধীনতার মতো দ্বায়িত্বপূর্ণ আচরণ নিয়ে এমন অনেকেই উচ্চবাচ্য করছেন, যারা মূলত ‘গালি স্বাধীনতা’ চর্চা করেন। এরূপ গোষ্ঠির উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় প্রভাবিত হলে সাইবার আইন সংক্রান্ত সার্বিক সচেতনতা বিঘ্নিত হবে।
সরকার ব্লগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন- এমন আশঙ্কায় নেটিজেনরা আশংকায় পড়তেই পারেন। তবে রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, ব্লগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘটা করে সাইবার আইন প্রণয়ন জরুরী হয়ে ওঠে না। রাষ্ট্র গনতান্ত্রিক আলাপের বিরুদ্ধে গিয়ে একনায়কতন্ত্রে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে সাইবার আইন ছাড়াই। বরং বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিজেদের স্বার্থে সাইবার আইনে বাক স্বাধীনতা বান্ধব বিধি যোগে সচেষ্ট হতে হবে নেটিজেনদেরই।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে যখন প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়, তখন একই সঙ্গে প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার পর্যবেক্ষণ বিধিমালা নীতিনির্ধারণী চিত্রে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। অন্যথা তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও সাইবার আইন ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা প্রণয়ন একটি অপূর্নাঙ্গ রোডম্যাপ।
ব্লগাররা বিভিন্ন কারণেই রাজনৈতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠেন। প্রশ্ন হতেই পারে, ব্লগারদের সমালোচনা করা হলে, তারা এতো প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন কেন? মন্ত্রী আশরাফ সাহেব যখন ব্লগ বলতে পর্নোগ্রাফি বুঝে থাকেন, তখন বুঝতে হবে, তিনি তথ্যগত দিক দিয়ে অন্ধকারে আছেন এবং যেটুকু তার সম্মুখে এসেছে, সেটুকু জুড়ে আপত্তিকর কিছু থাকতেই পারে। ব্লগারদের বরং এ সুবাদে পর্নোগ্রাফি সাইটগুলোকে চিহ্নিত করেও বিশেষ কোন ব্লগে যদি প্রতিনিয়ত অশ্লীলতাকেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয়, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কী কী করণীয় আছে তা জানতে মন্ত্রী সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিৎ।
ব্লগারদের সমালোচনা হলেই বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে এমন গোষ্ঠিবদ্ধ হুজুগ প্রকারান্তরে কোন ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে না। ব্লগাররা সমালোচনার উর্ধ্বে থাকা কেউ নন। ইন্টারনেটবাসীরা তিউনিশিয়ায় বিপ্লব করেছিল বলে, আরব বসন্ত এনেছিল বলে তাবৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বিপ্লবী হয়ে যান না।
আজকাল মাউসের ক্লিকে ক্লিকে বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে বিশ্বে। তাহলে এ যুগের বিপ্লব কী জলবৎ তরল হয়ে যায়নি? ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা আর আমাদের ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধারাও বিপ্লবী ছিলেন। তাদের মত ধৈর্য, আত্মত্যাগ, দূরদর্শীতা, দায়িত্ববোধ, প্রজ্ঞা আদৌ কতটুকু আছে আমাদের মাঝে?
একটা ছোট প্রতীক খুঁজে নেই আলোচনার এ অংশে – ছুরি! সুস্থ মানসিকতার কেউ ছুরি ব্যবহার করে সবজি-ফল কাটতে পারেন, দড়ির প্যাঁচ কাটতে পারেন, আর বেসামাল হলে আঙ্গুল কেটে ফেলতে পারেন। অন্যদিকে অসুস্থ মানসিকতার কেউ ছুরি দিয়ে অপরকে আহত-নিহত করতে পারেন। ব্যবহারকারীর কারণে প্রযুক্তি-ইন্টারনেট ছুরির মত কার্যকরী হতে পারে, আত্মঘাতি হতে পারে, আবার হতে পারে ভয়ংকরও!
দায়িত্বশীলতার কথাটা এখানেই বারবার উত্থাপিত হয়। দায়িত্বশীলতার প্রত্যাশা পারস্পারিকও বটে। ব্লগার-নেটিজেনরা সরকারের কাছে দ্বায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করবে, বিপরীতে সরকার ব্লগার-নেটিজেনদের কাছেও দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া চাইবে। কোন ধরনের অচলাবস্থা এড়াতে দুপক্ষের মুখোমুখি মুক্তালোচনাকে স্বাগত জানানোর পরিসর রাখাটা মত প্রকাশের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে দেবে নিশ্চিত।
প্রকৃতপক্ষে, ইন্টারনেটে বাক স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টি সাইবার আইনের আওতাধীন হলেও সাইবার আইনকে শুধু এবং শুধুমাত্র বাক স্বাধীনতা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করলে সেটা আমাদের পুরো ভার্চুয়াল জগতের বহুবিধ (‘সু’ এবং ‘কু’) কাজকে তুলে ধরতে ও বুঝে উঠতে না পারার ব্যর্থতা হতে পারে। সাইবার আইনের আওতায় কী কী থাকতে পারে, তা না জানার ঘাটতিতে সাইবার আইন নিয়ে আমাদের মধ্যে যে দ্বিধাবোধ জেগেছে, তাতে আমাদের সাইবার আইনকেন্দ্রিক প্রত্যাশা ও আশঙ্কা পুরোটাই বাক স্বাধীনতাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।
অবশ্য প্রত্যাশা ও আশঙ্কা দুটোরই সহাবস্থান এ পর্যায়ে থাকা ভাল। কেবল এর পরিসর একমুখী না করে বহুমুখীকরণ হওয়া চাই। নয়তো আমরা পুরো ইস্যুটিকে আমাদের মাঝেই ‘মিসলিড’ করার সুযোগ করে দিতে পারি। ইন্টারনেট ইউজার মাত্রই যে ব্লগার হবেন এমন কিছু নয়। তাই ইন্টারনেট ব্যবহার মানেই যে ব্লগিং হতে হবে এমনও কারণ নেই। ফলে সাইবার আইন শুধু ও শুধূমাত্র ব্লগ ও ব্লগারদের জন্য নয়।
একথা অনস্বীকার্য, সাইবার আইন নিয়ে আমাদের অজ্ঞতার, ইতস্ততার সবচে বড় ফায়দা নেবেন তারাই যারা ইন্টারনেটে সুস্থ ধারায় মত প্রকাশে বিশ্বাস রাখেন না, যারা ইন্টারনেটে অশ্লীলতাকে ছড়িয়ে দিতে সংঘবদ্ধ। প্রথাগত আইনি ধারনা এড়িয়ে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাইবার আইন মুক্তমত চর্চাকারী নেটিজেন, ব্লগারদের জন্য বান্ধব হয়ে উঠবে আর কাল হয়ে উঠবে শুধু প্রকৃত সাইবার অপরাধীদের জন্য।
No comments