সময়ের প্রতিধ্বনি-রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ এবং কিছু কথা by মোস্তফা কামাল

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বা বিলিয়া গত শনিবার বিচারপতি নিয়োগ বিষয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে দেশের সিনিয়র আইনজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকরা অংশ নেন। আলোচনা সভাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী বলে মনে করি। আলোচনা সভায় যেসব বক্তব্য উঠে এসেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। যে দেশের বিচার বিভাগ যত বেশি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও মজবুত, সে দেশে আইনের শাসন,


মানবাধিকার ও গণতন্ত্র তত বেশি সুসংহত। কিন্তু আমাদের দেশের শাসকরা নিজেদের স্বার্থে বিচার বিভাগকে দুর্বল করে রাখতে চান। এ জন্য তাঁরা রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন, যাতে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারেন। এই প্রবণতা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ বলেই আমাদের সিনিয়র আইনজীবীরা উদ্বিগ্ন; উদ্বিগ্ন দেশের সাধারণ মানুষও।
আলোচনা সভায় উপস্থাপিত কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের বক্তব্য এখানে তুলে ধরছি। আমাদের সংবিধান প্রণেতা ও সিনিয়র আইনজীবী ড. কামাল হোসেন দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, 'দলীয়করণ রোগে বিচার বিভাগ আক্রান্ত হয়েছে। দেশ হচ্ছে আমাদের মা। রোগাক্রান্ত মাকে সুস্থ করে তুলতে হবে।' তিনি বিচারপতি নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জোর দাবি জানান।
ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, 'নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে তখন কোনো বিতর্ক হয়নি। গত দশকের শুরুতে বিচারপতির চাকরি স্থায়ী করা নিয়ে সর্বপ্রথম বড় ধরনের বিতর্ক শুরু হয়। ১০ বিচারপতির চাকরি স্থায়ীকরণের বিষয়টি মামলায় গড়ায়। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া এ মামলায় আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় দেন ২০০৮ সালে। হাইকোর্ট বিভাগ বিচারপতি নিয়োগপদ্ধতি নিয়ে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওই রায়ই আপিল বিভাগ বহুলাংশে বহাল রাখেন।' তিনিও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বর্তমানে বিচারপতি নিয়োগ সর্বমহলে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিচারপতি নিয়োগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, 'আমাদের উচ্চ আদালতই দেশের মন্ত্রীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে বেআইনি কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেন কেবল সুপ্রিম কোর্ট। সংসদ প্রণীত কোনো আইনকে বেআইনি ঘোষণার এখতিয়ারও উচ্চ আদালতের রয়েছে।' তিনি বলেন, "কে কত সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ করতে পারে, তা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিযোগিতা করছে। 'জয় বাংলা' ও 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' স্লোগান দিয়ে যেন কেউ বিচারপতি হতে না পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে।"
আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বিগত বিএনপি সরকারের আমলে ৪৫ জন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে তিন বছরেই নিয়োগ পেয়েছেন ৫২ জন বিচারপতি। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগও আছে উভয় সরকারের বিরুদ্ধে। বিএনপি করেছে, তাই আওয়ামী লীগকেও একই কাজ করতে হবে_এ রকম একটা প্রবণতা সর্বক্ষেত্রে লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধির বিষয়টি। কয়েকজন বিচারপতির যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। এ নিয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখিও হয়েছে। বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার চিন্তা থেকেই বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো হয়েছিল। পরে বিএনপির ওই অশুভ চিন্তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা সম্ভব হয়নি। তখন আওয়ামী লীগ ও সমমনা রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বিএনপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
অতীতে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শুধু পুলিশবাহিনী দিয়েই নিপীড়ন-নির্যাতন করা হয়নি, আইনি প্রক্রিয়ায়ও ঘায়েল করা হয়েছে। উভয় দলের মধ্যেই এ প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এ ক্ষেত্রে পাইওনিয়ার হচ্ছে বিএনপি। আর তার পথ ধরে এগিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মিলেমিশে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো উচ্চ আদালতকেও আক্রান্ত করছে। যেকোনো মানুষই যেকোনো দলের সমর্থক হতে পারেন। সেটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সেই পরিচয় প্রভাব ফেলবে কেন? শুধু বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, যেকোনো সরকারি চাকরিতে নিয়োগের মাপকাঠি হবে মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা। দলীয় পরিচয়ে কেউ নিয়োগপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে চাইলে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। তাহলেই বিচার বিভাগ কিংবা প্রশাসন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে।
শাহ্দীন মালিক যা বললেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির কোনো ভূমিকাই নেই। তিনি আছেন নামমাত্র। এ ক্ষেত্রে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আর এর অনুমোদন দিতে বাধ্য হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতা-দক্ষতার চেয়ে দলীয় পরিচয় বড় হয়ে উঠছে। কে কত বেশি দলীয়, তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অথচ এসব নিয়োগ প্রধান বিচারপতিরই করার কথা। তিনি স্বাধীনভাবে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতেন। আর তাহলেই আমরা একটি যোগ্য ও দক্ষ বিচার বিভাগ পেতাম।
সব ক্ষেত্রে দলীয়করণের কারণে আমাদের জনপ্রশাসন ও পুলিশবাহিনী পুরোপুরি দ্বিধাবিভক্ত। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন বছর ধরেই জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের উদ্দেশে বলে আসছেন, 'আপনারা সহায়তা করুন।' তিনি খুব ভালোভাবে টের পেয়েছেন যে প্রশাসনের একটি অংশ সরকারকে কোনো সহযোগিতাই করছে না। আবার একটি অংশ ভেতরে ভেতরে অসহযোগিতাও করছে। এতে সরকার পরিচালনা করতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
আমরা লক্ষ করছি, প্রশাসনে পেশাদারির পরিবর্তে দলীয় পরিচয়ই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। কারণ ১৯৯১ সালের পর থেকে কোনো সরকারই প্রশাসনকে শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী দলীয় লেবাস গায়ে জড়িয়ে ফায়দা হাসিল করছে। সুবিধাভোগীদের কারণে দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তারা ছিটকে পড়ছেন। আর লেবাসধারীরা অতিমাত্রায় রাজনৈতিক সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে।
পুলিশ প্রশাসনে এমনও অভিযোগ আছে, রাজধানী ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার পরিকল্পনা করেই সব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে 'দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা'দের নিয়োগ দিয়েছে। সরকারি পর্যায়ের অন্য ক্ষেত্রগুলোতেও গোপালগঞ্জ-ফরিদপুরের ব্যাপক প্রভাব। কারণ এরা নাকি সবাই আওয়ামী লীগের লোক! তাহলে কি দেশ এভাবেই চলবে? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর আর বিএনপি ক্ষমতায় এলে ফেনী-বগুড়ার প্রভাববলয় তৈরি হবে? ১৯৯১ সালের পর থেকে তো দলীয়করণের বাড়বাড়ন্ত আমরা দেখে আসছি।
উন্নত দেশগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম, আমাদের প্রতিবেশী দেশের কথাই বলি। দেশ বিভাজনের পর ভারতের তৎকালীন সরকার পরিকল্পনা করেই প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিল। তার পর থেকে প্রতিটি সরকার প্রশাসনিক কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করতে যা যা করণীয় তা করেছে। আর আমাদের প্রশাসন সরকারের দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে আইনের শাসন, মানবাধিকার থেকেছে উপেক্ষিত। ভারতে সরকার বদল হলেও জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। আমাদের দেশে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। জাতীয় কোনো ইস্যুতে বড় দুটি দল একসুরে কথা বলেছে, এর নজির নেই বললেই চলে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি_উভয় দলই হয়তো ভাবে, প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয় লোকদের বসিয়ে যেতে পারলে আখেরে তার ভালো ফল আসবে। কিন্তু তা কখনো কখনো যে বুমেরাং হতে পারে, তার প্রমাণও কিন্তু ভূরি ভূরি রয়েছে। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার অতীত থেকে শিক্ষা নেবে এবং শুধু বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, সব ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতাকেই প্রাধান্য দেবে; অন্যথায় ক্ষমতায় গিয়ে কাজ করতে উভয় দলকেই বাধার মুখে পড়তে হবে। তখন 'সহায়তা করুন, সহায়তা করুন' বলে গলা শুকালেও কোনো কাজ হবে না।
আবারও ড. কামাল হোসেনের কথায় ফিরে আসি। তিনি বলেছেন, তিনি যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন দলীয় বিবেচনায় কোনো বিচারপতি নিয়োগ হয়নি। কারণ তিনি দলীয় লোকদের বলে দিয়েছিলেন, তিনি দলের নয়, দেশের মন্ত্রী। কাজেই দেশের স্বার্থ দেখাই ছিল তাঁর প্রধান কর্তব্য। আর এখন আমাদের রাজনীতি মনে হয় উল্টো পথে হাঁটছে। এখন যারা সরকারে যায়, তারা দেশের স্বার্থ নয়, দলের স্বার্থকে বড় করে দেখে। দলীয় লোকদের কিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া যায়, কোথায় কিভাবে বসানো যায়, সেটাই যেন তাদের প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের উচ্চ আদালত এখনো সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল। নিম্ন আদালতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকলেও উচ্চ আদালতে মানুষ সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছে। আর এ কারণে এখনো হয়তো দেশটি টিকে আছে। তাই প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের উদ্দেশেই বলছি, মানুষের এই শেষ আশ্রয়স্থলটুকুও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে কেড়ে নেবেন না। আপনাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.