সরকারের কাছে তথ্য চেয়েছে রামসার কর্তৃপক্ষ-সুন্দরবন এলাকায় তিন প্রকল্প দেশে-বিদেশে উদ্বেগ by ইফতেখার মাহমুদ

সুন্দরবন এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ফুলবাড়ী কয়লা খনির কয়লা রাখার ডিপো, জাহাজ নির্মাণের জন্য শিপইয়ার্ড ও খাদ্যগুদাম নির্মাণের উদ্যোগ সম্পর্কে সরকারের কাছে বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা রামসার কনভেনশন কর্তৃপক্ষ। তারা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। দেশে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই এসব প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। বিষয়টি উচ্চ আদালতেও গড়িয়েছে।


সরকারের বন বিভাগ এসব প্রকল্পের বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। রামসার কর্তৃপক্ষ মনে করে, এ তিনটি স্থাপনা হলে তা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর হবে। তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছে।
বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলোকে ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে এ কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষরকারী প্রতিটি রাষ্ট্র নিজ দেশের রামসার এলাকাগুলোর প্রতিবেশব্যবস্থা সংরক্ষণ করতে বাধ্য।
বিশ্বের ১৬০টি দেশের এক হাজার ৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমি রামসার এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৭২ সালে ইরানের রামসার শহরে একটি সম্মেলনের পর বিভিন্ন দেশ এ চুক্তিতে সই করে।
রামসার কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধান বিষয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গতকাল মঙ্গলবার আন্তমন্ত্রণালয় সভা করেছে। সভায় সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলো সুন্দরবন এলাকায় নেওয়া প্রকল্পগুলো সম্পর্কে লিখিত ও মৌখিকভাবে তথ্য জানিয়েছে।
ওই সভায় সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মালবাহী কার্গো ও তেলবাহী ট্যাংকার নিয়মিত চলাচলের ব্যাপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হয়। সভা থেকে দ্রুত এই নৌযানগুলোর চলাচল বন্ধের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, তা না হলে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ডলফিন, হরিণ ও মাছের বিচরণ এলাকা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব মেসবাহ-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবন শুধু রামসার এলাকাই নয়, সুন্দরবন আমাদের জাতীয় সম্পদ, আমাদের গর্ব। তাই এ বনের জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে এ ব্যাপারে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’
রামসার কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ: গত ২২ জুন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবনের এক থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনের সীমান্তবর্তী বাগেরহাটের রামপালের কাছের ওই এলাকাটি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের জন্য দুর্যোগের কারণ হবে উল্লেখ করে রামসার কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে বিপুল পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ ও ধুলা তৈরি হবে। এতে সুন্দরবনের গাছ ও প্রাণিসম্পদ পর্যায়ক্রমে ধ্বংস হবে। রামসার দাবি করেছে, ভারত থেকে আনা নিম্নমানের কয়লা পোড়ালে সেখান থেকে উচ্চমাত্রায় সালফার নির্গত হবে। এখনো এ প্রকল্পের কোনো পরিবেশগত সমীক্ষা করা হয়নি উল্লেখ করে রামসার কর্তৃপক্ষ দ্রুত এ ব্যাপারে তথ্য জানাতে বলেছে।
রামসার কর্তৃপক্ষের ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বন অধিদপ্তর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। তাতে বলা হয়েছে, রামসার এলাকার আইনগত দিক দেখভাল করার দায়িত্ব বন অধিদপ্তরের। এ এলাকায় (ল্যান্ডস্কেপ জোন) এমন কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন করা যাবে না, যা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার তথা সমগ্র জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
রামসারের চিঠিতে বলা হয়, ফুলবাড়ী কয়লা খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা সুন্দরবন ও মংলা বন্দরের কাছে আকরাম পয়েন্টে স্তূপ করে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে কি না, তা জানতে চেয়েছে রামসার কর্তৃপক্ষ।
সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় একটি শিপইয়ার্ড ও বড় খাদ্যগুদাম (সাইলো) নির্মাণ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (১৯৯৭) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) অনুযায়ী, কোনো সংরক্ষিত এলাকায় এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা যায় না।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের বাফার জোন থেকে চার কিলোমিটার এবং মূল সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে হবে। এ ছাড়া এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করায় অল্প কয়লা ব্যবহার করে বেশি পরিমাণে জ্বালানি উৎপাদন করা হবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি করা হতে পারে উল্লেখ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
ফুলবাড়ী কয়লা খনি সম্পর্কে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আকরাম পয়েন্টে কয়লা ওঠানো-নামানোর কোনো ঘাট তৈরির সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি।
আর বড় খাদ্যগুদাম নির্মাণের বিষয়ে খাদ্য বিভাগ থেকে লিখিত কিছু জানানো হয়নি। বাগেরহাটের মংলা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকা জয়মণি গ্রামে খাদ্যগুদামটি নির্মিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে গুদাম এলাকার সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই গুদামে চাল আনতে সুন্দরবনের ভেতর সড়ক নির্মাণের প্রয়োজন হতে পারে। নৌপথে আনতে হলেও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে আসতে হবে। ফলে তা সুন্দরবনের প্রতিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।

No comments

Powered by Blogger.