স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
২৬৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবু ইউসুফ, বীর বিক্রম হাতের মুঠোয় পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আবু ইউসুফ প্রতিরক্ষা অবস্থানে। সকাল হলেই তাঁরা রওনা হবেন ঢাকার অদূরে। রাতে তাঁরা পালা করে ঘুমালেন। ভোর হওয়ার আগেই বেশির ভাগ উঠে পড়লেন। তখনো সকাল হয়নি। শীতের দিন। চারদিকে কুয়াশা। বেশি দূর দেখা যায় না। এমন সময় তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের পাশের
জঙ্গলে শোনা গেল শব্দ। আবু ইউসুফের মনে হলো জঙ্গলের ভেতর কেউ আছে। সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দিলেন, দ্রুত গোটা এলাকা ঘেরাও করার। তারপর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন জঙ্গলের দিকে। নিঃশব্দে জঙ্গলে ঢুকেই তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। দেখতে পেলেন ভেতরে অনেক পাকিস্তানি সেনা। কেউ শুয়ে, কেউ বসে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি কেউ টের পেল না। আবু ইউসুফ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, এদের আত্মসমর্পণ করাতে হবে। তাদের বুঝতে না দিয়ে প্রথমে নিজেদের নিরাপদ অবস্থান সংহত করলেন। তারপর অস্ত্র উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘হ্যান্ডস আপ।’ হকচকিত পাকিস্তানি সেনারা সবাই হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেল। তিনি নির্দেশ দিলেন আত্মসমর্পণের। পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে থাকল। একজনকে দেখে আবু ইউসুফ চমকিত হলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদের খান তাঁর হাতের মুঠোয়। নীরবে তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করল। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের। ১৪ ডিসেম্বর। মৌচাকে।
মৌচাক গাজীপুর জেলার অন্তর্গত। কালিয়াকৈর-টাঙ্গাইল সড়কে মৌচাকের অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে কামালপুর, জামালপুর মুক্ত করার পর ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন আবু ইউসুফ। এই সময় ওই অঞ্চলে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার দিকে পশ্চাদপসরণ শুরু করে। ময়মনসিংহে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। দায়িত্বে ছিল ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদের খান। সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ময়মনসিংহে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার দিকে রওনা হয়। টাঙ্গাইলে এসে তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়। তিন দিন পর ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদের তার বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হয় গাজীপুরের কলিয়াকৈরে। এদিকে তাদের আগেই বিভিন্ন পথ দিয়ে ওই এলাকায় পৌঁছে যায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী। ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর একটি দল মৌচাকের ঠেঙ্গার বান্দ্রের কাছে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনীর একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন আবু ইউসুফ। রাতে তাঁরা সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেই রাতেই আবদুল কাদের খান তার বাহিনীর একাংশ নিয়ে সেখানে পৌঁছে। সকালে তারা আবু ইউসুফের দলের কাছে বন্দী হয়।
আবু ইউসুফ চাকরি করতেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রকৌশল শাখায়। ১৯৭১ সালে প্রেষণে সৌদি আরবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেখান থেকে পালিয়ে লন্ডনে যান। আগস্ট মাসে ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে যুদ্ধ করেন ছয় নম্বর সেক্টরে। পরে ১১ নম্বর সেক্টরে। জামালপুরের কামালপুর (১৪-১৫ ও ২৭-২৮ নভেম্বর), বকশিগঞ্জ ও জামালপুর যুদ্ধসহ আরও কয়েক স্থানে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করেন। কামালপুর মুক্ত করার পর মিত্রবাহিনী (১ মারাঠা রেজিমেন্ট) ও মুক্তিবাহিনী জামালপুরের দিকে মার্চ করে। আবু ইউসুফ মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও কর্নেল ব্রারের সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে এসে জামালপুর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবু ইউসুফকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৬৭।
আবু ইউসুফ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের ভাই। তাঁরা চার ভাই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৭ সালে কর্নেল তাহেরের সঙ্গে তাঁকেও আটক করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ শিথিল করে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৯৯ সালে তিনি মারা গেছেন।
আবু ইউসুফের পৈতৃক বাড়ি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মহিউদ্দিন তালুকদার। মা আশরাফুননেছা। স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ। তাঁর এক ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর পূর্বধলা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি মো. গোলাম মোস্তফা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com
মৌচাক গাজীপুর জেলার অন্তর্গত। কালিয়াকৈর-টাঙ্গাইল সড়কে মৌচাকের অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে কামালপুর, জামালপুর মুক্ত করার পর ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন আবু ইউসুফ। এই সময় ওই অঞ্চলে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার দিকে পশ্চাদপসরণ শুরু করে। ময়মনসিংহে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। দায়িত্বে ছিল ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদের খান। সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ময়মনসিংহে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার দিকে রওনা হয়। টাঙ্গাইলে এসে তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়। তিন দিন পর ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদের তার বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হয় গাজীপুরের কলিয়াকৈরে। এদিকে তাদের আগেই বিভিন্ন পথ দিয়ে ওই এলাকায় পৌঁছে যায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী। ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর একটি দল মৌচাকের ঠেঙ্গার বান্দ্রের কাছে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনীর একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন আবু ইউসুফ। রাতে তাঁরা সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেই রাতেই আবদুল কাদের খান তার বাহিনীর একাংশ নিয়ে সেখানে পৌঁছে। সকালে তারা আবু ইউসুফের দলের কাছে বন্দী হয়।
আবু ইউসুফ চাকরি করতেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রকৌশল শাখায়। ১৯৭১ সালে প্রেষণে সৌদি আরবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেখান থেকে পালিয়ে লন্ডনে যান। আগস্ট মাসে ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে যুদ্ধ করেন ছয় নম্বর সেক্টরে। পরে ১১ নম্বর সেক্টরে। জামালপুরের কামালপুর (১৪-১৫ ও ২৭-২৮ নভেম্বর), বকশিগঞ্জ ও জামালপুর যুদ্ধসহ আরও কয়েক স্থানে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করেন। কামালপুর মুক্ত করার পর মিত্রবাহিনী (১ মারাঠা রেজিমেন্ট) ও মুক্তিবাহিনী জামালপুরের দিকে মার্চ করে। আবু ইউসুফ মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও কর্নেল ব্রারের সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে এসে জামালপুর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবু ইউসুফকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৬৭।
আবু ইউসুফ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের ভাই। তাঁরা চার ভাই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৭ সালে কর্নেল তাহেরের সঙ্গে তাঁকেও আটক করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ শিথিল করে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৯৯ সালে তিনি মারা গেছেন।
আবু ইউসুফের পৈতৃক বাড়ি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মহিউদ্দিন তালুকদার। মা আশরাফুননেছা। স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ। তাঁর এক ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর পূর্বধলা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি মো. গোলাম মোস্তফা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com
No comments