ট্রাইব্যুনালে দুই সাক্ষী-সাঈদীসহ রাজাকাররা লুট ও অগ্নিসংযোগ করেছেন

কাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুরের উমেদপুর গ্রামে হিন্দুপাড়ায় সাঈদীসহ কয়েকজন রাজাকার লুট ও অগ্নিসংযোগ করেছেন বলে ট্রাইব্যুনালে জানিয়েছেন মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী মাহতাব (৫৫)।
রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী মানিক পসারি (৬৫) বলেছেন, তাঁর বাড়িতে রাজাকাররা কেরোসিন ছিটানোর পর সাঈদী আগুন


ধরিয়ে দেন। এই দুই সাক্ষী গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন। বেলা পৌনে ১১টার দিকে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগেই সাঈদীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
শুরুতে মাহতাব জবানবন্দি দেন। তিনি বলেন, একাত্তরের ২ জুন সকালে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে দেলাওয়ার হোসাইন শিকদার বর্তমান সাঈদী, দানেশ আলী মোল্লা, সেকান্দার শিকদার, মাওলানা মোসলেমউদ্দিনসহ কয়েকজন রাজাকার সশস্ত্র অবস্থায় উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় যান। সেখানে তাঁরা অনিল মণ্ডল, নলিতা বালী, হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মুকেন চক্রবর্তী, সতীশ বালা, চিত্ত তালুকদার, রবি তালুকদারের ঘরসহ ২০-২২ জনের ঘর লুট ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ সময় রাজাকাররা বিসা বালীকে নারকেলগাছের সঙ্গে বেঁধে পেটায়। সাঈদী এক রাজাকারকে কিছু বলার পর ওই রাজাকার বিসা বালীকে গুলি করে। পরে রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে চলে যায়। তিনি হিন্দুপাড়ার দক্ষিণ পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে ঘটনাটি দেখেন। তিনি জানান, একাত্তরে তিনি স্কুলে পড়তেন।
জবানবন্দি শেষ হলে মাহতাবকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম ও মনজুর আহমেদ আনসারী। মিজানুল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বরিশাল ও পিরোজপুর মহকুমায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে মাহতাব বলেন, তিনি পারেরহাটের বাইরে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনের বিষয়ে কিছু জানেন না। তাঁর বাড়ি পারেরহাট ইউনিয়নের টেংরাখালী গ্রামে।
আইনজীবী মিজানুলের এক প্রশ্নের জবাবে মাহতাব বলেন, তিনি পারেরহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং তাঁর ছেলে আবু বকর সিদ্দিক জিয়ানগর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। মিজানুল সাক্ষীর এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র ও জন্মনিবন্ধনে ভিন্ন জন্মতারিখ উল্লেখ থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। জবাবে তিনি বলেন, ১৯৭৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্রে জন্মতারিখ লেখা ছিল ১৯৫৯ সালের ৬ জুন। নবম শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশন ফরম কেরানি পূরণ করেছিলেন, তিনি শুধু স্বাক্ষর করেন। ২০০৮ সালে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া জন্মনিবন্ধন সনদে জন্মতারিখ ১৯৬৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।
সাঈদীকে কবে থেকে চেনেন—আইনজীবীর এ প্রশ্নে মাহতাব বলেন, সাঈদীকে তিনি ১৯৭০ সাল থেকে চেনেন। ওই সময় সাঈদী পারেরহাটে রাস্তায় তেল, নুন, মরিচ বিক্রি করতেন।
এরপর মাহতাবকে জেরা করেন মনজুর আহমেদ আনসারী। জেরার শেষ পর্যায়ে আইনগত মতামতে তিনি বলেন, মাহতাবের নিজস্ব পেশা নেই। তিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা হওয়ায় স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশে ও সরকারি বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার আশায় রাষ্ট্রপক্ষের শিখিয়ে দেওয়া সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর বিরোধিতা করে মাহতাব বলেন, এটা সত্য নয়।
বিকেল সোয়া তিনটার দিকে জবানবন্দি দেন মানিক পসারি। তিনি বলেন, একাত্তরের ১৮ মে পারেরহাট বন্দর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে দেলাওয়ার হোসাইন শিকদার বর্তমান সাঈদী, দানেশ মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, রাজাকার মমিন, হাকিম কারি, সোবহান মাওলানাসহ অনেক রাজাকার তাঁদের বাড়িতে যান। তিনি ও তাঁর ভাইয়েরা এ সময় বাড়ির পূর্ব পাশে জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা ও রাজাকাররা তাঁদের বাড়ি ভাঙচুর ও প্রায় ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। পরে রাজাকাররা তাঁর বাড়িতে কেরোসিন ছিটিয়ে দিলে সাঈদী আগুন ধরিয়ে দেন। রাজাকাররা তাঁর ফুপাতো ভাই মফিজউদ্দিন ও কাজের লোক ইবরাহিম ওরফে কুট্টিকে বেঁধে ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। পথে সাঈদী ও সেকান্দার শিকদারের পরামর্শে পাকিস্তানি সেনারা কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে। মফিজকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। রাত এক-দুইটার দিকে মফিজ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বাড়ি আসেন।
জবানবন্দির পর মানিককে জেরা শুরু করেন মিজানুল। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় বিকেল চারটার দিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আজ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.