সহস্র কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান by আশীষ-উর-রহমান

কসঙ্গে সহস্র কণ্ঠে গীত হবে কবিগুরুর গান— কথাটি এখন কমবেশি সবার জানা। অনেক অনুষ্ঠানে তো এক হাজার শ্রোতাই হয় না। সেখানে নানা বয়সী এক হাজার শিল্পী একত্রে মঞ্চে উঠে গান গাইবেন, ঠিকঠাকমতো বাস্তবায়ন করা যাবে তো পরিকল্পনাটি—এমন সন্দেহ ক্ষীণ হলেও আসতেই পারে অনেকের মনে। তবে গতকাল মঙ্গলবার লালমাটিয়া মহিলা কলেজ মাঠে গিয়ে মহড়া দেখে মনে হলো, অপ্রত্যাশিত কোনো বড় দুর্যোগ না ঘটলে এই


প্রথমবার হাজার শিল্পীর গলায় কবিগুরুর গান শোনার বিরল সুযোগ ঘটতে যাচ্ছে শ্রোতাদের। বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত টানা সাত ঘণ্টার মহড়া। তাতে গানের অনুশীলন তো ছিলই, তারও চেয়ে বেশি ছিল মঞ্চে ওঠানামার নিয়ম আর চালচলন রপ্ত করা। রবীন্দ্রসংগীত চর্চা প্রতিষ্ঠান সুরের ধারার উদ্যোগে গীতবিতান-এর সবগুলো গান, গীতি ও নৃত্যনাট্য নিয়ে ২২টি ডিভিডিতে প্রকাশিত হচ্ছে শ্রুতি গীতবিতান। সে উপলক্ষেই ২৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন দিনের রবীন্দ্র উৎসব।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৯ ডিসেম্বর বিকেল চারটায় উৎসবের উদ্বোধন করবেন। শ্রুতি গীতবিতান-এর মোড়ক উন্মোচন করবেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। আয়োজনের সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো ও চ্যানেল আই।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই থাকবে দেশের প্রবীণ-নবীন এক হাজার শিল্পীর কণ্ঠে কবিগুরুর গান। এতে ১২টি গান গাওয়া হবে। গীতবিতান-এর ভূমিকা হিসেবে যে গানটি আছে ‘প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে’—এটি দিয়ে শুরু হবে। শেষ হবে ‘ওই মহামানব আসে’। মাঝের গানগুলো হলো: ‘কান্নাহাসির-দোল-দোলানো’, ‘আকাশভরা সূর্য-তারা’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’, ‘দুই হাতে কালের মন্দিরা’, ‘প্রথম আদি তব শক্তি’, ‘ওহে দয়াময় নিখিল-আশ্রয়’, ‘আলো আমার আলো ওগো’, ‘আগুনের পরশমণি’ এবং ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’।
কলেজের মাঠের উত্তর প্রান্তে লম্বা শামিয়ানা টানিয়ে শিল্পীদের বসার ব্যবস্থা। সারা দেশ থেকে প্রায় ৭০০ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এসেছেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গাইতে। তাঁদের সঙ্গে ঢাকার ও সুরের ধারার ৩০০ শিল্পী। ভারতের প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র মহড়া পরিচালনা করলেন। সহযোগিতায় ছিলেন শিল্পী লিলি ইসলাম ও হিমাদ্রি শেখর।
পাশ্চাত্য যন্ত্রানুষঙ্গের ‘সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা’র সঙ্গে গলা মেলালেন শিল্পীরা ‘আকাশভরা সূর্য-তারা’ গেয়ে। কুয়াশাজড়ানো শীতের সকালের আড়ষ্টতা ভেঙে দিয়ে এক অসাধারণ সুরের ঐকতানে ভরে উঠেছিল প্রাঙ্গণ।
অনুশীলন শেষ করে এসে দেবজ্যোতি প্রথম আলোকে বললেন, ‘এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মনে হলো যেন গোটা দেশে গাইছে। এটা বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ এ দেশের মানুষের মনের গভীরে রয়েছেন। সেই একাত্মবোধ থেকেই শিল্পীরা গান করছেন।’
বেলা দেড়টা নাগাদ গানের অনুশীলন শেষ করে দেবজ্যোতি মার্টিন লাইটেনারের হাতে তুলে দিলেন মঞ্চ মহড়ার দায়িত্ব। অস্ট্রিয়ার মার্টিন লন্ডনে পেশাদার মঞ্চ ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। মহড়ার যথেষ্ট শ্রমসাধ্য পর্বটি শুরু হলো। তিনি জানিয়ে দিলেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে। সেখানে ৬০ মিটার লম্বা মঞ্চ। মঞ্চের মাঝখানে চলাচলের জন্য একটি পথ থাকবে। উভয় পাশে সমান্তরাল ১২টি করে মোট ২৪টি সারি। সারিগুলো সিঁড়ির ধাপের মতো। শিল্পীরা মঞ্চে ওঠা ও নামার জন্য ১০-১২ মিনিটের মতো সময় পাবেন। কোনো তাড়াহুড়ো করা যাবে না। কারণ, অনুষ্ঠানটি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হবে। মঞ্চের যে স্থানেই যিনি থাকুন না কেন, সবাইকেই টিভিতে ভালো করে দেখা যাবে। কাজেই গান গাওয়ার সময় যেন অভিব্যক্তি সঠিক থাকে।
এরপর চালচলনের মহড়ার পালা। সময় ঘড়ি ধরা। তাই বলে দৌড়ে নয়। এগোতে হবে হেঁটেই। তবে দ্রুত ও সুন্দর পদক্ষেপে। কেমন করে হাঁটতে হবে, তাও দেখিয়ে দিলেন। হাঁটার মহড়ার পর শুরু হলো সারিবদ্ধ হওয়ার মহড়া। প্রতি সারিতে ৪৬ জন। কণ্ঠের ঐকতান ঠিক রাখতে পুরুষ শিল্পীরা দাঁড়াবেন দুই সারি, নারী শিল্পীদের মাঝখানে। কে কোথায় দাঁড়াবেন তার নম্বর লেখা টিকিট দেওয়া হলো তাঁদের। সেই টিকিট নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর মহড়া দিতে দিতেই শীতের বেলা গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যার আবছায়া।
অভিভূত মার্টিনও। প্রথম আলোকে তিনি জানালেন, যখন তাঁকে বলা হয়েছিল এক হাজার শিল্পী মঞ্চে একসঙ্গে গান করবেন, তখন তাঁর কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছিল প্রস্তাবটি। এখন এখানে এসে শিল্পীদের অভিনিবেশ দেখে তিনি খুবই আনন্দিত।
মহড়ার ফাঁকেই প্যাকেট করা দুপুরের খাবার গ্রহণ মুখ আঁধারি অপরাহ্নে। তারপর আবার গানের অনুশীলন। মাঠ থেকে ফের শামিয়ানার তলায়।
সুরেরধারার অধ্যক্ষ রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা শিল্পীদের বললেন, ‘আপনাদের অনেক অসুবিধা হয়েছে, ঠিক সময়ে খেতে পারেননি, শীতে কষ্ট করেছেন। সারা দিন পরিশ্রম করেছেন। আমার কাছে এটা মনে হচ্ছে একটা যুদ্ধের মতো। এর শেষ পর্যন্ত আমাদের পৌঁছাতে হবে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের যে গভীর ভালোবাসা, সেই শক্তিতেই এই আয়োজন সুসম্পন্ন করতে পারব।’
সূর্য তখন অস্তাচলে। তারা দেখা যাচ্ছে না। আকাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা। সুরের রেশ ভাসছে সেই কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যার হিমেল হাওয়ায়।

No comments

Powered by Blogger.