ব্যবস্থাপনার কালান্তর-সৃজনশীলতা উন্নয়নের ভিত্তি by ইফতেখারুল ইসলাম

র্ব-৩ : সৃজনশীলতা কেন চাই? সৃজনশীলতা একজন সফল ব্যবস্থাপকের অন্যতম শক্তি। অথচ এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রবীণ ব্যবস্থাপকদের সবাই এখনো নিঃসন্দেহ নন। তেমনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান পর্যন্ত সৃজনশীলতা বা উদ্ভাবনীশক্তির কোনো প্রশিক্ষণ বা পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না। বরং প্রচলিত শিক্ষা ও পরীক্ষাপদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মৌলিক সৃষ্টিশীলতাও বিসর্জন দেয়। আরেকটি ভ্রান্ত


ধারণা হচ্ছে, সৃজনশীলতা শুধু শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়ই উপযোগিতা সৃষ্টি করে। বড়জোর নতুন পণ্য উদ্ভাবনে, বিপণনধর্মী কর্মকাণ্ডে অথবা বিজ্ঞাপন-গণযোগাযোগ ধরনের কিছু কাজে সৃজনশীলতার প্রয়োজন হতে পারে। সাধারণ ব্যবস্থাপনায় হিসাব নিরীক্ষণে, তথ্য-প্রযুক্তিতে অথবা মানবসম্পদ উন্নয়নে সৃজনশীলতাকে অনাবশ্যক এবং অনেক সময় পরিত্যাজ্য বিবেচনা করা হয়। অথচ এ রকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই কর্মজীবন শুরুর সময় থেকে উচ্চতর, তত্ত্বাবধায়ক ও সাংগঠনিক নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনে উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করে। এটি নিজের মেধাকে শাণিত করে, অন্যকে প্রাণিত ও যুক্ত করে।
আমরা আজ এমন একটি বিশ্বে বাস করি, যেখানে নতুন প্রযুক্তি ও কৌশলের আয়ু ক্রমেই হ্রস্বতর হয়ে চলেছে। প্রতিযোগিতা অনবরত তীব্রতর হচ্ছে। বাণিজ্যের উদারীকরণ ঘটছে এবং দূর হয়ে যাচ্ছে প্রচলিত নানা ধরনের বাধাবিঘ্ন। ওয়েব বা ইন্টারনেটের ক্ষমতা মেধাস্বত্ব এবং অন্য বহু বাধা অতিক্রম করে সব কিছু সহজলভ্য করে তুলেছে পৃথিবীর মানুষের কাছে। মূল্য ও লাভ-লোকসানের তথ্য হাতের কাছে পেঁৗছে যাওয়ায় আগের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতায়িত বোধ করেন ক্রেতা ও ভোক্তাসাধারণ। তাঁরা আজ সহজেই নিজস্ব বিবেচনা প্রয়োগ করতে পারেন। তাঁদের সীমিত জ্ঞান ও পরিমিত অধিকারের সুযোগ নিয়ে আগের মতো আনুগত্য, উচ্চ মুনাফা ও নিশ্চিত সাফল্য আশা করতে পারে না আজকের কোনো বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান। অনেক ক্ষেত্রেই নতুন উদ্ভাবনী কর্মপদ্ধতি দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পার্থক্য তৈরি করতে হয়। তাই সৃজনশীল হওয়া এখন সবার দায়িত্ব। যদিও আক্ষরিক অর্থে সবার মধ্যে একই উচ্চমানের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো বাস্তবসম্মত নয়, তবু চেষ্টা করতে হয়, যাতে সবার মধ্যেই এর উদ্বোধন ঘটে এবং সবাই তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদানটুকু রাখতে আগ্রহী হন।
কয়েক বছর আগে লন্ডন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক গ্যারি হ্যামেল এ বিষয়ে অত্যন্ত অগ্রসর চিন্তার সূত্রপাত করেন। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল প্রেস থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ বিষয়ক গ্রন্থে তিনি কিছু মানবিক সামর্থ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক সাফল্যে যেসব মানবিক সামর্থ্য বড় অবদান রাখতে পারে, সেগুলো একটি তালিকায় ধাপে ধাপে সাজানো হয়েছে। এর সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে আজ্ঞানুবর্তিতা, যার অর্থ হলো নির্দেশ গ্রহণ ও নিয়ম মেনে চলার সামর্থ্য। এই নিয়মানুবর্তী আনুগত্যকে যদি সর্বনিম্ন ধাপে রাখা হয় তাহলে এর ঠিক ওপরেই আসে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। এ ধরনের কর্মীরা সাধারণত তাঁদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। কাজে তাঁদের অনীহা নেই; তাঁরা বিবেকবান ও সুসংগঠিত। এর ঠিক ওপরের ধাপে রয়েছে মেধা; জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার সমন্বিত রূপ। বেশির ভাগ বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে অগ্রসর বা উৎকৃষ্ট কর্মী সংগ্রহে সচেষ্ট থাকে। এ ধরনের কর্মীরা মূল্যবান। কারণ তাঁরা তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে এবং অন্যদের কাছ থেকে ভালো কাজ শিখে নিতে আগ্রহী হন। মেধা ও বুদ্ধিমত্তার ওপরে স্থান পায় কর্মস্পৃহা বা উদ্যমশীলতা। উদ্যমশীল কর্মীকে কাজের কথা বলে দিতে হয় না; তাঁরা সে জন্য অপেক্ষাও করেন না। তাঁরা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ খুঁজে নেন আর সব সময় নিজের অবদান বাড়ানোর জন্য নতুন কর্মপন্থা খুঁজে বের করেন। এর ওপরের ধাপে আছে সৃষ্টিশীলতা। সৃষ্টিশীল মানুষ সদা-উৎসুক ও অদম্য; তাঁরা আপাত দৃষ্টিতে বোকার মতো প্রশ্ন করতে বা কথা বলতেও দ্বিধা করেন না। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন যে প্রচলিত পন্থাকে প্রশ্ন করে, পুরনোকে বাতিল করেই নতুন পথ উদ্ভাবন করতে হয়। সামর্থ্যের তালিকায় সব শেষে, সবার ওপরে আছে প্যাশন বা প্রবল আবেগ। আন্তরিক ও প্রবল আবেগানুভূতি মানুষকে দিয়ে সরল ও আপাতদৃষ্টে নির্বুদ্ধিতার কাজ করিয়ে নেয়, কিন্তু এই সেই বিশেষ উপাদান, যা আকাঙ্ক্ষা অর্জন করতে সাহায্য করে, স্বপ্ন সত্য করে। আবেগানুভূতিসম্পন্ন মানুষ বাধা ডিঙিয়ে যেতে চান; তাঁরা হাল ছাড়েন না। আবেগ অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হয়, সবাইকে প্রাণিত করে। একজনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ক্রমেই দলবদ্ধ আন্দোলনে পরিণত হয়। ইংরেজ ঔপন্যাসিক ই এম ফর্স্টার বলেছিলেন, 'একজন আবেগানুভূতিসম্পন্ন মানুষ কেবল আগ্রহী ধরনের ৪০ জন লোকের চেয়ে শ্রেয়।'
আজকের ব্যবস্থাপনা সংস্কৃতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এই প্রতিটি মানবিক যোগ্যতা প্রতিষ্ঠানে কতটা মূল্য সংযোজন করে, গ্যারি হ্যামেলের প্রস্তাবনা অনুযায়ী তার একটি পরিমাপ এখানে দেওয়া হলো :
প্রবল আবেগ- ৩৫ শতাংশ
সৃষ্টিশীলতা - ২৫ শতাংশ
উদ্যমশীলতা- ২০ শতাংশ
মেধা ও বুদ্ধিমত্তা- ১৫ শতাংশ
পরিশ্রম ও অধ্যবসায়- ৫ শতাংশ
আজ্ঞানুবর্তিতা- ০ শতাংশ
মোট- ১০০ শতাংশ
এর অর্থ এই নয় যে আজ্ঞানুবর্তিতা আক্ষরিক অর্থেই মূল্যহীন। একটি প্রতিষ্ঠানে কেউই নিয়ম মেনে না চললে তা চরম অরাজক হয়ে উঠবে। কিন্তু সত্য এই যে একজন শুধু আদেশ মেনে চলা কর্মীর মূল্য তাঁর প্রতিষ্ঠানে শূন্যের কাছাকাছি।
আর বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত পৃথিবীতে মেধা ও জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এক দেশে সীমাবদ্ধতা থাকলে আরেক দেশে গড়ে ওঠে শিল্প ও বাণিজ্য, তৈরি হয় কর্মসংস্থান। অল্প কয়েক বছরে ফিলিপাইনে গড়ে ওঠা কল সেন্টারগুলোতে কর্মীর সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে, যেখানে ভারতে দীর্ঘদিন ধরে বিকশিত এই শিল্পে কর্মীর সংখ্যা এখন সাড়ে তিন লাখ। আমাদের দেশ ছাড়াও ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে চীনের গুয়াংঝাও পর্যন্ত অগণিত মেধাবী ও নিয়মানুবর্তী মানুষ নিবিড়ভাবে কাজ করে চলেছেন, যাঁরা কোনো কারণে পদত্যাগ করলে সঙ্গে সঙ্গে অনুরূপ আরো কর্মী খুঁজে নিয়ে নিয়োগ করতে পারে সেসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই বিশাল সংখ্যার মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ কর্মী তাঁদের সৃজনশীলতায়, আবেগানুভূতির সংযোগে, উদ্দীপনা ও উন্মুখতায় প্রতিষ্ঠানের ভেতরে প্রাণসঞ্চার করতে পারেন। তাঁরা দুষ্প্রাপ্য ও অপ্রতিস্থাপনীয়।
সৃজনশীলতার চর্চা ও বিকাশ কিভাবে সম্ভব তা আরো বিশদ আলোচনার বিষয়, তবে কয়েকটি লক্ষণ উল্লেখ করলে বিষয়টি স্পষ্টতর হবে। সাধারণত দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে যাঁরা বয়সে ও অভিজ্ঞতায় নবীন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্ভরস্থল বা কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে এবং নিজ কর্মক্ষেত্রের বাইরের কোনো বিষয়ে পাঠ ও চর্চায় আগ্রহী, তাঁরাই অধিকতর সৃজনশীল হয়ে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন প্রকৌশলী অথবা ব্যবস্থাপনার স্নাতক, যিনি ছাত্রজীবনে পাঠবহির্ভূত কোনো সাংস্কৃতিক বা সাংগঠনিক কাজে যুক্ত ছিলেন অথবা বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের পাঠচক্রের সদস্য ছিলেন, কর্মস্থলের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে পরবর্তী সময় বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর সার্বিক কর্মকুশলতা অন্য একজন স্নাতকের চেয়ে উল্লেখযোগ্যরূপে অগ্রসর ও উৎকৃষ্ট। এর অর্থ এই নয় যে বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র সফল ব্যবস্থাপক তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। আসলে এর তাৎপর্য এখানেই যে একজন অধিকতর আলোকিত মানুষ, তাঁর শিক্ষা ও কাজের ক্ষেত্র যা-ই হোক না কেন, পেশাজীবনে তিনিই আলো এবং সম্পন্নতার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হন। তাঁরা অনেক বেশি সংবেদনশীল ও বিবেকবান মানুষ হিসেবে তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপনার সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন। তাঁদের হাত ধরেই দূর হবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের অপেক্ষাকৃত প্রাচীন অতিব্যবস্থাপনা, দাসত্ব-শৃঙ্খল এবং হৃদয়হীন লোভ ও লাভের নির্মম অপব্যবস্থাপনা। (চলবে)
লেখক : ফার্মাসিস্ট এবং বাণিজ্য ব্যবস্থাপক
একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.