অধিক ফলনে বাজারে স্বস্তি কৃষকের মাথায় হাত-ভারত by পার্থ চট্টোপাধ্যায়
কংগ্রেস মনে করে, খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশিরা এলে ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রি হতো, ক্রেতা ও চাষির উপকার হতো। কিন্তু বিরোধীরা এমন প্রচার শুরু করল যে, খুচরা দোকানিদের মনে হতে লাগল বিদেশি লগি্ন হলে ছোট ব্যবসাদাররা লাটে উঠবে। কিন্তু কমিউনিস্টরা সম্ভবত জানে না যে, ১৫ বছর ধরে চীন খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগি্ন ঢুকতে দিয়েছে। এতে তাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি ২০১২ সাল ভারতের পক্ষে কেমন যাবে? নতুন বছর যে ভারতের
ইউপিএ সরকারের পক্ষে খুব ভালো যাবে না তা বলার জন্য জ্যোতিষীর কাছে যাওয়ার দরকার নেই। এ মুহূর্তে ভারতীয় টাকার মূল্য রোজ পড়ছে। আগে এক ডলারে পাওয়া যেত ৪৫ টাকা, এখন টাকার দাম হয়েছে ৫৪ টাকা। ফলে অনাবাসী ভারতীয়রা এখন প্রচুর ডলার ভারতে পাঠাচ্ছেন। এতে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ছে। আমদানির জন্য আরও বেশি ডলার কিনতে হচ্ছে বেশি টাকায়। রাতারাতি আন্তর্জাতিক বিমান টিকিট ও বিদেশে প্যাকেজ ট্যুরের দাম বেড়ে গেছে। ফলে বিদেশযাত্রার জন্য পর্যটন শিল্পে যে রমরমা ভাব ছিল সেটাও কেটে যাচ্ছে। তবে সুবিধা হবে বিদেশি পর্যটকদের, যারা ডলার নিয়ে এ দেশে বেড়াতে বা কাজে আসেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাংলাদেশিরা যারা ভারত ভ্রমণে আসবেন তাদের একটু লাভই হবে।
ভারতে খাদ্যবস্তুর দাম এ মুহূর্তে একটু কমেছে। এখন খাদ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার চলছে শতকরা ৬ ভাগ। উঠেছিল শতকরা ১০ ভাগের মতো। অন্যান্য ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত। অধিক ফলন হওয়াতে চাল-গমের দাম পড়ে যাওয়ায় চাষিদের মাথায় হাত। বেশি দামে সার কিনে, বর্ধিত হারে মজুরি দিয়ে তাদের হাতে কিছু থাকছে না। কর্মসংস্থানেরও কোনো ইতরবিশেষ ঘটেনি।
তবে ভারতের রাজনৈতিক আকাশ এখনও মেঘে ঢাকা। মনমোহন সিংয়ের সরকার চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সংসদে কংগ্রেস দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। শরিক দলগুলো এ সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করছে। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে বামরা ছিল ইউপিএর জোট শরিক। তারা নানাভাবে চাপ দিয়ে সরকারকে বাধ্য করত তাদের দাবি মানতে। শেষে বেঁকে বসেছিল যে, তারা কিছুতেই আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বিল সমর্থন করবে না। ওই বিল প্রত্যাহার না করলে তারা সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে সরকার ফেলে দেবে। কিন্তু সেবার মনমোহন সিং কিছুতেই তাদের দাবি মেনে নেননি। বামরা সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও সরকার পড়ে যায়নি। মনমোহন নানা কৌশলে অন্য দল থেকে সমর্থন জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান ইউপিএ সরকারের শরিক মমতার তৃণমূল দল। মমতাও নানাভাবে কেন্দ্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। তার চাপের ফলে মনমোহনকে শেষ পর্যন্ত খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি সংস্থাগুলোর প্রবেশের অনুমতিদানের বিলটি সরকারকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে। এর আগেও জমি অধিগ্রহণ বিল আটকে দিয়েছিলেন মমতা। শেষে মমতার অভিপ্রায় অনুসারে সরকার বিলটি আদ্যোপান্ত সংশোধন করেছে। মমতার আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত মনমোহন বাংলাদেশ সফরে গিয়ে তিস্তা জলচুক্তি স্বাক্ষর করে আসতে পারেননি।
লোকসভায় প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে পড়ছে মনমোহন সরকার। বিরোধীরা একাট্টা হয়ে সংসদের মধ্যে এমন হইচই বাধাচ্ছে যে, সংসদের কাজকর্মই হতে পারছে না। ২০১০ সালে মাত্র ১০০ দিন সংসদ চলেছিল। ২০১১ সালে আরও কম সময় সংসদ বসেছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে শীতকালীন অধিবেশন শুরু হওয়া মাত্র দুটি বিল নিয়ে তুমুল হইচই শুরু হয়। প্রথমটা ওই বিদেশি লগি্ন বিল নিয়ে। এ বিলের বিরুদ্ধে বাম ও বিজেপিরা একাট্টা। তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে মমতার তৃণমূলও, যারা কি-না সরকারের অন্যতম শরিক। প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউপিএর অন্যতম শরিক ডিএমকেও।
কংগ্রেস মনে করে, খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশিরা এলে ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রি হতো, ক্রেতা ও চাষির উপকার হতো। কিন্তু বিরোধীরা এমন প্রচার শুরু করল যে, খুচরা দোকানিদের মনে হতে লাগল বিদেশি লগি্ন হলে ছোট ব্যবসাদাররা লাটে উঠবে। কিন্তু কমিউনিস্টরা সম্ভবত জানে না যে, ১৫ বছর ধরে চীন খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগি্ন ঢুকতে দিয়েছে। এতে তাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি। এক-আধটা নয়, দুই হাজার ৪০০ বিদেশি কোম্পানি চীনে খুচরা ব্যবসা করছে। ২০০৯ সালের একটি তথ্য অনুযায়ী চীনে খুচরা ব্যবসায়ে ৫ হাজার কোটি টাকার লগি্ন করেছে বিদেশিরা। চীনের খুচরা বাজার ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। এটি চীনের বৃহত্তম খুচরা বাজারে লগি্নর ১২ শতাংশ মাত্র। সুতরাং ভারতের দরজা খুচরা বাজারের পুরোটাই বিদেশিরা দখল করে নেবে, তা হতে পারে না। তাছাড়া নানা রক্ষাকবচের ব্যবস্থাও থাকত; কিন্তু বিদেশি লগি্নর জুজুর ভয় দেখিয়ে জনগণের কাছে 'গরিবের বন্ধু' সাজার সুযোগ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো বঞ্চিত হতে রাজি নয়। তাই মমতাও পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের নির্মূল করতে কমিউনিস্টদের অস্ত্রই হাইজ্যাক করে নিলেন। তাতে মনমোহন সরকারের মুখ পুড়ল; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে মমতার মুখ উজ্জ্বল হলো।
যেমন বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিতে বাধা দিয়ে মমতা প্রমাণ করেছেন, তার কাছে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ আগে। এতে আমজনতার হাততালি পেলেও পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই খুশি নন। তারা মনে করেন, দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির স্বার্থেই মমতার মনমোহনের ঢাকা সফরের সঙ্গী হওয়া উচিত ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি শোভন ও সঙ্গতভাবেই ওই চুক্তি খতিয়ে দেখার জন্য আর কিছুদিন সময় নিতে পারতেন। কিন্তু ওইভাবে নাটক করায় মনমোহনের মুখ পুড়ল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগে লন্ডন সফরে যান। সে সময় সফররত বাংলাদেশ সরকারের এক পদস্থ কর্মকর্তা টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক আশীষ রায়কে বলেন, মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা নিয়ে যে চুক্তিটি সই হওয়ার কথা ছিল সেটি বিস্তারিত চূড়ান্ত চুক্তি নয়, শুধু একটি নীতিগত রূপরেখা, যার ভিত্তিতে দু'দেশের বিশেষজ্ঞরা বসে চূড়ান্ত চুক্তির খসড়া করবেন। আশীষ রায় টাইমস অব ইন্ডিয়ায় লিখেছেন, ডা. দীপু মনি যখন এরপর কলকাতায় আসেন তখন মমতা নাকি তাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জলচুক্তি হোক তিনিও তা চান। দীপু মনি তাকে বোঝান, জলচুক্তি না হওয়ায় ভারতবিরোধী শক্তি হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
ভারত সরকার এবং হাসিনা সরকার প্রাণপণে চেষ্টা করছে দু'দেশের অমীমাংসিত ইস্যুগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিষ্পত্তি করার। তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি অমীমাংসিত থাকায় ভারতবিরোধীদের হাতেই অস্ত্র তুলে দেওয়া হলো, অথচ এর জন্য ভারতের মনমোহন সরকার মোটেই দায়ী নয়। গত ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বর্ষ জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে অনেকগুলো অনুষ্ঠান হয়ে গেল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান করে ফোরাম ফর ইন্টিগ্রেটেড ন্যাশনাল সিকিউরিটি (ফিনস) নামে একটি সর্বভারতীয় সংস্থার কলকাতা শাখা। তারা কলকাতার বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সে একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করে। বিষয় :ডাইনামিক্স অব ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনশিপ। যোগ দিয়েছিলেন শতাধিক বিশিষ্ট নাগরিক ও বুদ্ধিজীবী। তার মধ্যে ছিলেন কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান। ভারতের বিশিষ্ট আইপিএস অফিসার ও বাংলাদেশ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনাধ্যক্ষরা। সেখানে গিয়ে আমি বাংলাদেশ যুদ্ধে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম।
ওই সেমিনারে সবাই একমত হন যে, বর্তমান হাসিনা সরকারের আমলে অনেক দিন পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও দৃঢ়তর হওয়ার যে সুযোগ এসেছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা এর জন্য দু'দেশের মধ্যে সব বকেয়া চুক্তি মিটিয়ে ফেলার ওপর জোর দেন। বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ভারত সে সময় যে সাহায্য করেছিল, তার জন্য বাংলাদেশবাসী কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের সঙ্গে বকেয়া চুক্তিগুলো মিটিয়ে ফেলে দু'দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চান মনমোহন। কিন্তু একের পর এক আরও গুরুতর ইস্যু তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
বিশেষ করে আন্না হাজারে নামে অরাজনৈতিক গান্ধীবাদী এই বৃদ্ধটি এখন কংগ্রেসের কাছে বিরাট 'থ্রেট'। তিনি প্রথমে লোকপাল বিল গ্রহণ করে দুর্নীতি দমনের স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ার দাবিতে দিলি্লতে অনশন শুরু করেন। এখন তিনি ধীরে ধীরে লোকপালের ক্ষমতার পরিসর বাড়াতে চাইছেন। প্রথমে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও বিচার বিভাগ এবং সরকারি আমলাদের এর আওতায় আনতে হবে। তারপর বলেন, সিবিআইকে স্বয়ংশাসিত সংস্থা করতে হবে। তারপর বললেন, সরকারের বিরুদ্ধে যাতে সাধারণ মানুষ অভিযোগ জানাতে পারেন তার জন্য একটি বিশেষ সেল করতে এবং তাকে লোকপালের আওতায় আনতে হবে।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতীয় সাংবাদিক
ভারতে খাদ্যবস্তুর দাম এ মুহূর্তে একটু কমেছে। এখন খাদ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার চলছে শতকরা ৬ ভাগ। উঠেছিল শতকরা ১০ ভাগের মতো। অন্যান্য ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত। অধিক ফলন হওয়াতে চাল-গমের দাম পড়ে যাওয়ায় চাষিদের মাথায় হাত। বেশি দামে সার কিনে, বর্ধিত হারে মজুরি দিয়ে তাদের হাতে কিছু থাকছে না। কর্মসংস্থানেরও কোনো ইতরবিশেষ ঘটেনি।
তবে ভারতের রাজনৈতিক আকাশ এখনও মেঘে ঢাকা। মনমোহন সিংয়ের সরকার চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সংসদে কংগ্রেস দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। শরিক দলগুলো এ সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করছে। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে বামরা ছিল ইউপিএর জোট শরিক। তারা নানাভাবে চাপ দিয়ে সরকারকে বাধ্য করত তাদের দাবি মানতে। শেষে বেঁকে বসেছিল যে, তারা কিছুতেই আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বিল সমর্থন করবে না। ওই বিল প্রত্যাহার না করলে তারা সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে সরকার ফেলে দেবে। কিন্তু সেবার মনমোহন সিং কিছুতেই তাদের দাবি মেনে নেননি। বামরা সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও সরকার পড়ে যায়নি। মনমোহন নানা কৌশলে অন্য দল থেকে সমর্থন জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান ইউপিএ সরকারের শরিক মমতার তৃণমূল দল। মমতাও নানাভাবে কেন্দ্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। তার চাপের ফলে মনমোহনকে শেষ পর্যন্ত খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি সংস্থাগুলোর প্রবেশের অনুমতিদানের বিলটি সরকারকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে। এর আগেও জমি অধিগ্রহণ বিল আটকে দিয়েছিলেন মমতা। শেষে মমতার অভিপ্রায় অনুসারে সরকার বিলটি আদ্যোপান্ত সংশোধন করেছে। মমতার আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত মনমোহন বাংলাদেশ সফরে গিয়ে তিস্তা জলচুক্তি স্বাক্ষর করে আসতে পারেননি।
লোকসভায় প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে পড়ছে মনমোহন সরকার। বিরোধীরা একাট্টা হয়ে সংসদের মধ্যে এমন হইচই বাধাচ্ছে যে, সংসদের কাজকর্মই হতে পারছে না। ২০১০ সালে মাত্র ১০০ দিন সংসদ চলেছিল। ২০১১ সালে আরও কম সময় সংসদ বসেছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে শীতকালীন অধিবেশন শুরু হওয়া মাত্র দুটি বিল নিয়ে তুমুল হইচই শুরু হয়। প্রথমটা ওই বিদেশি লগি্ন বিল নিয়ে। এ বিলের বিরুদ্ধে বাম ও বিজেপিরা একাট্টা। তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে মমতার তৃণমূলও, যারা কি-না সরকারের অন্যতম শরিক। প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউপিএর অন্যতম শরিক ডিএমকেও।
কংগ্রেস মনে করে, খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশিরা এলে ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রি হতো, ক্রেতা ও চাষির উপকার হতো। কিন্তু বিরোধীরা এমন প্রচার শুরু করল যে, খুচরা দোকানিদের মনে হতে লাগল বিদেশি লগি্ন হলে ছোট ব্যবসাদাররা লাটে উঠবে। কিন্তু কমিউনিস্টরা সম্ভবত জানে না যে, ১৫ বছর ধরে চীন খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি লগি্ন ঢুকতে দিয়েছে। এতে তাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি। এক-আধটা নয়, দুই হাজার ৪০০ বিদেশি কোম্পানি চীনে খুচরা ব্যবসা করছে। ২০০৯ সালের একটি তথ্য অনুযায়ী চীনে খুচরা ব্যবসায়ে ৫ হাজার কোটি টাকার লগি্ন করেছে বিদেশিরা। চীনের খুচরা বাজার ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। এটি চীনের বৃহত্তম খুচরা বাজারে লগি্নর ১২ শতাংশ মাত্র। সুতরাং ভারতের দরজা খুচরা বাজারের পুরোটাই বিদেশিরা দখল করে নেবে, তা হতে পারে না। তাছাড়া নানা রক্ষাকবচের ব্যবস্থাও থাকত; কিন্তু বিদেশি লগি্নর জুজুর ভয় দেখিয়ে জনগণের কাছে 'গরিবের বন্ধু' সাজার সুযোগ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো বঞ্চিত হতে রাজি নয়। তাই মমতাও পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের নির্মূল করতে কমিউনিস্টদের অস্ত্রই হাইজ্যাক করে নিলেন। তাতে মনমোহন সরকারের মুখ পুড়ল; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে মমতার মুখ উজ্জ্বল হলো।
যেমন বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিতে বাধা দিয়ে মমতা প্রমাণ করেছেন, তার কাছে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ আগে। এতে আমজনতার হাততালি পেলেও পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই খুশি নন। তারা মনে করেন, দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির স্বার্থেই মমতার মনমোহনের ঢাকা সফরের সঙ্গী হওয়া উচিত ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি শোভন ও সঙ্গতভাবেই ওই চুক্তি খতিয়ে দেখার জন্য আর কিছুদিন সময় নিতে পারতেন। কিন্তু ওইভাবে নাটক করায় মনমোহনের মুখ পুড়ল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগে লন্ডন সফরে যান। সে সময় সফররত বাংলাদেশ সরকারের এক পদস্থ কর্মকর্তা টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক আশীষ রায়কে বলেন, মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা নিয়ে যে চুক্তিটি সই হওয়ার কথা ছিল সেটি বিস্তারিত চূড়ান্ত চুক্তি নয়, শুধু একটি নীতিগত রূপরেখা, যার ভিত্তিতে দু'দেশের বিশেষজ্ঞরা বসে চূড়ান্ত চুক্তির খসড়া করবেন। আশীষ রায় টাইমস অব ইন্ডিয়ায় লিখেছেন, ডা. দীপু মনি যখন এরপর কলকাতায় আসেন তখন মমতা নাকি তাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জলচুক্তি হোক তিনিও তা চান। দীপু মনি তাকে বোঝান, জলচুক্তি না হওয়ায় ভারতবিরোধী শক্তি হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
ভারত সরকার এবং হাসিনা সরকার প্রাণপণে চেষ্টা করছে দু'দেশের অমীমাংসিত ইস্যুগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিষ্পত্তি করার। তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি অমীমাংসিত থাকায় ভারতবিরোধীদের হাতেই অস্ত্র তুলে দেওয়া হলো, অথচ এর জন্য ভারতের মনমোহন সরকার মোটেই দায়ী নয়। গত ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বর্ষ জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে অনেকগুলো অনুষ্ঠান হয়ে গেল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান করে ফোরাম ফর ইন্টিগ্রেটেড ন্যাশনাল সিকিউরিটি (ফিনস) নামে একটি সর্বভারতীয় সংস্থার কলকাতা শাখা। তারা কলকাতার বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সে একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করে। বিষয় :ডাইনামিক্স অব ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশনশিপ। যোগ দিয়েছিলেন শতাধিক বিশিষ্ট নাগরিক ও বুদ্ধিজীবী। তার মধ্যে ছিলেন কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান। ভারতের বিশিষ্ট আইপিএস অফিসার ও বাংলাদেশ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনাধ্যক্ষরা। সেখানে গিয়ে আমি বাংলাদেশ যুদ্ধে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম।
ওই সেমিনারে সবাই একমত হন যে, বর্তমান হাসিনা সরকারের আমলে অনেক দিন পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও দৃঢ়তর হওয়ার যে সুযোগ এসেছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা এর জন্য দু'দেশের মধ্যে সব বকেয়া চুক্তি মিটিয়ে ফেলার ওপর জোর দেন। বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ভারত সে সময় যে সাহায্য করেছিল, তার জন্য বাংলাদেশবাসী কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের সঙ্গে বকেয়া চুক্তিগুলো মিটিয়ে ফেলে দু'দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চান মনমোহন। কিন্তু একের পর এক আরও গুরুতর ইস্যু তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
বিশেষ করে আন্না হাজারে নামে অরাজনৈতিক গান্ধীবাদী এই বৃদ্ধটি এখন কংগ্রেসের কাছে বিরাট 'থ্রেট'। তিনি প্রথমে লোকপাল বিল গ্রহণ করে দুর্নীতি দমনের স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ার দাবিতে দিলি্লতে অনশন শুরু করেন। এখন তিনি ধীরে ধীরে লোকপালের ক্ষমতার পরিসর বাড়াতে চাইছেন। প্রথমে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও বিচার বিভাগ এবং সরকারি আমলাদের এর আওতায় আনতে হবে। তারপর বলেন, সিবিআইকে স্বয়ংশাসিত সংস্থা করতে হবে। তারপর বললেন, সরকারের বিরুদ্ধে যাতে সাধারণ মানুষ অভিযোগ জানাতে পারেন তার জন্য একটি বিশেষ সেল করতে এবং তাকে লোকপালের আওতায় আনতে হবে।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতীয় সাংবাদিক
No comments