কবিতায় দশক বিভাজন ও অন্যান্য by মুহম্মদ নূরুল হুদা
কবিতায় দশক বিভাজনের বিষয়টি হালে সুবিধাজনক বিবেচিত হলেও কবিতার সামগ্রিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই বিভাজন অপরিহার্য নয়। বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যে যে নতুন সমালোচনার ধারা সৃষ্টি হয়েছে, তার সূত্র ধরেই দশক বিভাজনের আবির্ভাব। এর আগে কবিতার যুগ বিভাগ হতো মূলত যুগের প্রতিনিধিত্বশীল কবি বা সংশ্লিষ্ট যুগের শাসক বা প্রবণতার নামে।
যেমন শেক্সপিরিয়ান অ্যাজ (কবির নামে), ভিক্টোরিয়ার পিরিয়ড (রানী তথা শাসকের নামে), রোমান্টিক রিভাইভ্যাল (প্রবণতার নামে) ইত্যাদি। আধুনিক ইংরেজি কবিতার অব্যবহিত আগেও ছিল জর্জিয়ান কবিগোষ্ঠী। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রবল প্রতাপান্বিত কবিত্রয় পাউন্ড-এলিয়ট-ইয়েটসের প্রভাব বলয় থেকে মুক্তির জন্য তাদেরই অব্যাহত উত্তরসূরি অডেন-স্পেন্ডার-লিউস সূচনা করেছিলেন এই দশক বিভাজন। এই বিভাজন যতটা প্রবণতাগত, তার চেয়ে অনেক বেশি কৌশলগত। বাংলা কবিতায়ও এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন তিরিশের কবিসংঘ, যারা রবীন্দ্র-নজরুল বলয়ের সুস্পষ্ট বিরোধী। ইংরেজ কবিদের মতো বাঙালি কবিরাও ঘোষণা দিয়ে নিজ নিজ মেনিফেস্টো উঁচিয়ে দশক ঘোষণা করেছিলেন। বাংলা কবিতায় তিরিশের দশকের পর ষাটের দশকই এক্ষেত্রে সবচেয়ে উচ্চকিত কালপরিধি। চল্লিশ, পঞ্চাশ বা পরবর্তীকালের অন্য কোনো দশকের ঘোষিত মেনিফেস্টো তেমন একটা সূত্রবদ্ধ নয়। কাজেই এক্ষেত্রে দশক বিভাজন না করলেও ক্ষতি আছে বলে মনে হয় না। যা হোক, অন্তত দশ বছর পর পর নতুন এক কবিসংঘের আবির্ভাব শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এই বিভাজন সুবিধাজনক বিবেচিত হতে পারে। দশক মানে নতুন কবিসংঘ ও তাদের নতুন প্রবণতার সূত্রপাত মাত্র; তার বিকাশ বা পরিণতি নয়। সাহিত্যের ভাষিক, প্রাকরণিক বা বিষয়গত প্রবণতা দশক বিভাজন দিয়ে চিহ্নিত করা সুকঠিন। তার জন্য কখনও কখনও প্রয়োজন হয় একটি শতাব্দী। বাংলা কবিতার ভাষিক অভিব্যক্তি তেমন একটি প্রবণতা। তিরিশের পর বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় যে ভাষিক বদল সূচিত হয়েছিল তার জের চলছে এখনও। রবীন্দ্র-নজরুলের অসম্ভব স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত ভাষাভঙ্গির চেয়ে তিরিশের পরিশীলিত চলতি বাংলা ও তার কাব্যিক ব্যবহার আলাদা। কিন্তু তারপর? না, তারপর আমাদের কাব্যভাষা খুব আলাদা হয়েছে কিনা সন্দেহ। কেননা এই একবিংশ শতাব্দীর নতুন কবির গদ্যভাষ্যেও সেই তিরিশি পরিশীলনের সমপ্রসারণ পরিলক্ষিত লক্ষ্য করা যায়। ভাষা পাল্টাতে সময় লাগে অথবা মাইকেল-রবীন্দ্র-নজরুলের মতো যুগন্ব্দর প্রতিভা লাগে। শ্রমবিভাগের মতো দশক বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ বা মুখ্য কবিদের জন্যও সুপ্রযুক্ত, কিন্তু মৌলিক ও মহত্ কবিদের জন্য নয়। তারা মাত্র বছর কয়েকের সৃষ্টিসম্ভারে শতক ছাড়িয়ে সহস্রাব্দের দিকে পা বাড়ান। যেমন মাইকেল, যেমন নজরুল। ওরা যেমন দশকে বন্দি নন, তেমন নন শতকেও। ওদের কাল আদপেই প্রান্তমুক্ত। সামষ্টিক যাত্রার স্বার্থে দশক বিভাজন গ্রহণযোগ্য বিধায় এই পদ্ধতি চলছে এবং চলবে। কেননা এই ডিকনস্ট্রাকশনের যুগে আমরা গ্রান্ড চাই না, বরং ফ্যাগমেন্টেডেই তৃপ্ত হই। ক্ষুদ্র বৃহেক ঈর্ষা করে, কিন্তু বৃহত্ ক্ষুদ্রকে সাদরে বুকে বরণ করে।
আর ঠিক একারণেই সাম্প্রতিক সময়ের নতুন কবিতা ও নতুন কবিদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গেলে বিশেষ সতর্কতা আবশ্যক। সাম্প্র্রতিক বাংলা কবিতা বলতে আমি আশি, নব্বই ও শূন্যদশকের কবিতার বাঁকফেরার কথা বলতে চাই। তবে আরও তন্বিষ্ট পঠনপাঠন ছাড়া এ সম্পর্কে ঢালাও কোনো মন্তব্য করা সঙ্গত মনে করি না। আমি শুধু এটুকু লক্ষ্য করেছি, সাম্প্রতিকতম কবিরা যতটা বিষয়সচেতন, তার চেয়ে অনেক বেশি আঙ্গিকসচেতন। কবিতায় বোধগম্য বক্তব্যের বদলে ইশারা আর তাত্পর্য সৃষ্টিতেই তারা অধিক আগ্রহী। লিরিকের তাত্পর্যপূর্ণ নবনিরীক্ষার পাশাপাশি গদ্যবয়ান, প্রতীকময়তা, কোলাজ, অন্তর্গামিতা ও বস্লস্বরপ্রবণতা নব্বইয়ের পর শূন্যদশকের কবিতায় তাত্পর্যপূর্ণ বাঁকবদলের সূচনা করছে।
হালের বাংলা কবিতার মূল্যায়নের স্বার্থে দুই বাংলার কবিতার বিদ্যমান পার্থক্য চিহ্নিত করা জরুরি।
এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে মত্সস্পাদিত ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত কবিতা’ শীর্ষক সঙ্কলনের ভূমিকায়। আমার প্রথম প্রবন্ব্দগ্রন্থ ‘শর্তহীন শর্তে’ মুদ্রিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের কবিতা’ শীর্ষক আমার আরেকটি প্রবন্ব্দ। এখানেও দুই বাংলার কবিতার সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আমার ধারণা, পার্থক্যটি মূলত বিষয়ের। বাংলাদেশের কবিতায় বাংলাদেশের ভাষাযুদ্ধ, স্বাধিকার চেতনা, অস্তিত্বের লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রতিক্রিয়ার কৃষ্ণমূর্তির অশুভ উত্থান, প্রগতির সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব, গণমানুষের স্বপ্নভঙ্গ, সামরিক স্বৈরাচারের উত্থান, গণতন্ত্রের বিপর্যস্ত যাত্রা ইত্যাকার সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ের শিল্পিত বয়ান এ কবিতাকে সমগ্র বাংলা কবিতার ধারায় আলাদা স্রোত হিসেবে শনাক্ত করেছে। ‘আসলে বাংলাদেশের কবিতা মানেই এই সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রসম্বলিত এক উন্মাতাল বাণীভুবন। পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা কবিতার সঙ্গে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার মৌলিক পার্থক্য এখানেই।’ (ভূমিকা, আজকের কবিতা, ঢাকা ১৯৮৮)। দু’দশক আগে আমার এ মন্তব্যের সঙ্গে আমি এখনও বস্ললাংশে একমত। আমি মনে করি, ভাষাগত নিরীক্ষায়, বিশেষত আঞ্চলিক ভাষা ও বাকভঙ্গির ব্যবহারে বাংলাদেশের কবিরা এগিয়ে। তবে প্রকরণগত নিরীক্ষায় উভয় বাংলার কবিতা সমরূপীয় তলে অবস্থান করছে মনে হয়। কবিতার সনাতন বিষয়াবলি কিংবা আন্তর্জাতিক প্রবণতাগুলো স্বীকরণে উভয় অঞ্চলের কবিতা প্রায় সমগোত্রীয়। পঞ্চাশোত্তর বাংলা কবিতা মানে নানা বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও এ সময়ে লিখিত বাংলাদেশের বাংলা কবিতা, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতা এবং পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে (যেখানে অভিবাসী বাঙালি কবি আছেন) রচিত বাংলা কবিতার মিলিত প্রবাহ। দশক বা অঞ্চল বিভাজনের ঊর্ধ্বে বাংলা কবিতার এই ভাষিক সমগ্রত্বের দাবি সর্বাগ্রে বিবেচ্য বলে মনে করি।
লেখক : কবি, প্রফেসর; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ও বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি
আর ঠিক একারণেই সাম্প্রতিক সময়ের নতুন কবিতা ও নতুন কবিদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গেলে বিশেষ সতর্কতা আবশ্যক। সাম্প্র্রতিক বাংলা কবিতা বলতে আমি আশি, নব্বই ও শূন্যদশকের কবিতার বাঁকফেরার কথা বলতে চাই। তবে আরও তন্বিষ্ট পঠনপাঠন ছাড়া এ সম্পর্কে ঢালাও কোনো মন্তব্য করা সঙ্গত মনে করি না। আমি শুধু এটুকু লক্ষ্য করেছি, সাম্প্রতিকতম কবিরা যতটা বিষয়সচেতন, তার চেয়ে অনেক বেশি আঙ্গিকসচেতন। কবিতায় বোধগম্য বক্তব্যের বদলে ইশারা আর তাত্পর্য সৃষ্টিতেই তারা অধিক আগ্রহী। লিরিকের তাত্পর্যপূর্ণ নবনিরীক্ষার পাশাপাশি গদ্যবয়ান, প্রতীকময়তা, কোলাজ, অন্তর্গামিতা ও বস্লস্বরপ্রবণতা নব্বইয়ের পর শূন্যদশকের কবিতায় তাত্পর্যপূর্ণ বাঁকবদলের সূচনা করছে।
হালের বাংলা কবিতার মূল্যায়নের স্বার্থে দুই বাংলার কবিতার বিদ্যমান পার্থক্য চিহ্নিত করা জরুরি।
এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে মত্সস্পাদিত ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত কবিতা’ শীর্ষক সঙ্কলনের ভূমিকায়। আমার প্রথম প্রবন্ব্দগ্রন্থ ‘শর্তহীন শর্তে’ মুদ্রিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের কবিতা’ শীর্ষক আমার আরেকটি প্রবন্ব্দ। এখানেও দুই বাংলার কবিতার সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আমার ধারণা, পার্থক্যটি মূলত বিষয়ের। বাংলাদেশের কবিতায় বাংলাদেশের ভাষাযুদ্ধ, স্বাধিকার চেতনা, অস্তিত্বের লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রতিক্রিয়ার কৃষ্ণমূর্তির অশুভ উত্থান, প্রগতির সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব, গণমানুষের স্বপ্নভঙ্গ, সামরিক স্বৈরাচারের উত্থান, গণতন্ত্রের বিপর্যস্ত যাত্রা ইত্যাকার সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ের শিল্পিত বয়ান এ কবিতাকে সমগ্র বাংলা কবিতার ধারায় আলাদা স্রোত হিসেবে শনাক্ত করেছে। ‘আসলে বাংলাদেশের কবিতা মানেই এই সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্রসম্বলিত এক উন্মাতাল বাণীভুবন। পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা কবিতার সঙ্গে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার মৌলিক পার্থক্য এখানেই।’ (ভূমিকা, আজকের কবিতা, ঢাকা ১৯৮৮)। দু’দশক আগে আমার এ মন্তব্যের সঙ্গে আমি এখনও বস্ললাংশে একমত। আমি মনে করি, ভাষাগত নিরীক্ষায়, বিশেষত আঞ্চলিক ভাষা ও বাকভঙ্গির ব্যবহারে বাংলাদেশের কবিরা এগিয়ে। তবে প্রকরণগত নিরীক্ষায় উভয় বাংলার কবিতা সমরূপীয় তলে অবস্থান করছে মনে হয়। কবিতার সনাতন বিষয়াবলি কিংবা আন্তর্জাতিক প্রবণতাগুলো স্বীকরণে উভয় অঞ্চলের কবিতা প্রায় সমগোত্রীয়। পঞ্চাশোত্তর বাংলা কবিতা মানে নানা বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও এ সময়ে লিখিত বাংলাদেশের বাংলা কবিতা, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতা এবং পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে (যেখানে অভিবাসী বাঙালি কবি আছেন) রচিত বাংলা কবিতার মিলিত প্রবাহ। দশক বা অঞ্চল বিভাজনের ঊর্ধ্বে বাংলা কবিতার এই ভাষিক সমগ্রত্বের দাবি সর্বাগ্রে বিবেচ্য বলে মনে করি।
লেখক : কবি, প্রফেসর; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ও বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি
No comments