স্মরণ- 'চিত্রা ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি' by মালেকা বেগম

ই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের প্রিয় চিত্রা ভট্টাচার্য (২৯ নভেম্বর, ভোর সোয়া চারটায়)। বিজয়ার প্রণাম পাঠিয়েছিলাম মুঠোফোনে, ভাইফোঁটার দিনও ফোনে জানালাম এই দিনটির সূত্রে বাঁধা তিনি এবং প্রয়াত দাদা দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। ততটা ভালো না থাকলেও মনে তো হয়েছিল ভালো আছেন কিছুটা! তবে বলেছিলেন, শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। ভেবেছিলাম, দেখা হবে আবার।
সামনাসামনি বসে পুরোনো স্মৃতির ডালি খুলে বসব দুজনে এবং সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের বার্তা বিনিময় করতে পারব। সেই শুভক্ষণ আর আসবে না কখনো, ভাবলেই চোখ ভরে ওঠে কান্নায়।
তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদের সদস্য, নিয়মিত নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ছিলেন সামাজিক কয়েকটি সমিতি-সংগঠনের দায়িত্বশীল নেত্রী। আরও ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসভানেত্রী। নারী আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা অবশ্যস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এসবের ঊর্ধ্বে অথবা বলা যায়, এসব কাজের পাশাপাশি তাঁর প্রিয় জগৎ ভরে ছিল সংসার, স্বামী, পুত্র, পুত্রবধূ, কন্যা, কন্যা-জামাতা ও নাতনিদের প্রতি ভালোবাসা-স্নেহ, যত্নে।
একে একে মনে পড়ছে সেই শৈশবের স্মৃতি থেকে শুরু করে বয়সকালের এই সাম্প্রতিক স্মৃতিমধুর নানা কথা। ওয়ারীপাড়ায় আমরা থাকতাম খুবই কাছাকাছি বাড়িতে। ১০ বছর বয়স থেকে দেবেশদা ও চিত্রা বৌদির বাড়িতে আমার আনাগোনা। আমার বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া ও ভাবি নাদেরা বেগমের সূত্রে ওই বাড়িতে আমাদের যাতায়াত ছিল নিয়মিত। সেই ১৯৫৪ সালের কথা বলছি, তখন পাড়াজুড়েই একে অন্যের খোঁজখবর রাখা, এবাড়ি-ওবাড়ি যাওয়া-আসা ছিল খুবই সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ। ডা. মন্মথনাথ নন্দী, শান্তি নন্দী, ভবেশ নন্দী, সুখেন্দু শেখর হালদার, মানিক ঘোষ, দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং চিত্রা ভট্টাচার্য—এঁরা ছিলেন ওয়ারীপাড়ার স্বনামধন্য মধ্যমণি। ওয়ারীতে থাকতেন শিল্পী কামরুল হাসান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রমুখ প্রগতিবাদী সামাজিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তারা। দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন স্বনামধন্য উকিল, পরে বিচারপতির পদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী চিত্রা ভট্টাচার্য কঠিন কষ্টের জীবন কাটিয়েছিলেন বিয়ের পর পর। ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর স্বামী রাজনৈতিক কারণে কারাবন্দী ছিলেন ময়মনসিংহ জেলে। সেখান থেকে ঢাকা জেলে স্থানান্তরিত হলেন দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। সে সময়ের অর্থকষ্ট, জীবনযাপনের একাকিত্বের কথা বলেছিলেন তিনি। টাঙ্গাইলে শ্বশুরবাড়ি থেকে ময়মনসিংহ বা ঢাকা জেলে স্বামীর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করা সম্ভব না হওয়ায় চিত্রা বৌদি ময়মনসিংহ শহরের রাধাসুন্দরী স্কুলে পড়ানোর চাকরি নিলেন। আইএ পাস করেছিলেন। আর পড়া সম্ভব হয়নি সে সময়।
স্বামী জেল থেকে চিঠি লিখতেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৬৮ সালে সেই চিঠিগুলো পড়ার। সেসব তো সাহিত্যরসে পূর্ণ ছিল। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ারের লেখার উদ্ধৃতি, নায়ক-নায়িকার জীবনরস-সিক্ত ভালোবাসায় রাঙানো ছিল চিঠিগুলো। সেসব চিঠি পড়ে পড়ে আমার, দেবেশদা ও চিত্রা বৌদির অনেক সন্ধ্যার চায়ের আসর হয়েউঠেছিল মধুময়। কী ভয়ংকর কষ্ট পেয়েছিলেন, নিঃস্ব মনে হয়েছিল বৌদির যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় ছেড়ে যাওয়া পরিত্যক্ত বাড়িতে স্বাধীনতার পর ফিরে দেখলেন সবকিছু লুট-ধ্বংস হয়ে গেছে, সেই প্রেমময় চিঠিগুলোও নিখোঁজ হয়ে গেছে।
চিত্রা বৌদি ১৯৬৮ সালে প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে এমএ প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব পড়ে ১৯৭১ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁকে ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে পড়তে দেখে কী যে আনন্দ পেয়েছিলাম। এরপর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্দোলন-সংগ্রাম-কর্মকাণ্ডে তিনি নিয়মিত নেতৃত্ব দিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত মহিলা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা টাঙ্গাইলে সাংসদ হিসেবে অনেক কাজ করেছেন। সেই চিত্রা ভট্টাচার্য স্বনির্ভর, সক্রিয়, কর্মী, রাজনীতিবিদ। তাঁর সেই স্বরূপটাই তাঁকে বহুজনের মনের কোঠায় দেদীপ্যমান করে রেখেছে এবং রাখবে।
চিত্রা বৌদি আমার বন্ধু, শিক্ষাগুরু, মাতৃসমা। আমার বিয়ের আগে-পরে তাঁর সঙ্গে পরামাত্মীয় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের। দেবেশদা-চিত্রা বৌদির মেয়ে দেবলীনা, দুই ছেলে দেবপ্রিয় ও দীপেন তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের পারিবারিক বন্ধুর মতো ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্কে আবদ্ধ। ওরা হারিয়েছে তাদের মা-বাবা; আমরা হারিয়েছি আমাদের পরমাত্মীয় দাদা-বৌদিকে। দেশ ও সমাজ হারিয়েছে প্রগতিশীল প্রগতিকামী, সমাজসেবী দুজন দেশপ্রেমিককে। তাঁদের আরব্ধ কাজ করে যাবেন তাঁদের উত্তরসূরিরা। শ্রদ্ধা জানাই অমর এই প্রয়াত দম্পতিকে।
===========================
রাজনৈতিক আলোচনা- 'আওয়ামী লীগে মিলন ও বিচ্ছেদের নাটকখবর- উইকিলিকসের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র  রাজনৈতিক আলোচনা- 'প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের প্রত্যাশা আলোচনা- 'পায়ে পড়ি বাঘ মামা, বেঁচে থাকো'  আন্তর্জাতিক- 'পুরনো বন্ধুকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত চীন  আমরাই পারি 'দ্বিতীয় রাজধানী' গড়তে  খবর- পুলিশি হরতাল  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'উপদেশের খেসারত'  গল্প- 'স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্ত'  স্মরণ- 'জগদীশচন্দ্র বসুর কথা বলি'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'প্রধানমন্ত্রী কি হরতাল চান?  ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা রাজনীতির নতুমাত্রা  খবর, বিএনপি কর্মীদের দাঁড়াতে দেয়নি পুলিশ  গল্প- 'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসারে'  গল্প- 'মহামানুষের গল্প' by রাসেল আহমেদ  গল্পালোচনা- 'যেভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়!' by আলী হবিব  জলবায়ু সম্মেলনঃ আমি কেন কানকুনে যাচ্ছি? by মেরি রবিনস  ভ্রমণ- 'মেঘনায় যায় মেঘনা রানী' by সালেক খোকন  ভ্রমণ- 'গন্তব্য নাফাখুম' by জাকারিয়া সবুজ  আলোচনা- 'এখনো একটি গ্রেট গেইম অস্বস্তিকরভাবে প্রাসঙ্গিক' by এম আবদুল আজিজ  গল্পসল্প- জীবন ঢেকে যাচ্ছে বালুতে  প্রকৃতি- কোপেনহেগেন থেকে কানকুনঃ সময় এসেছে মুহূর্তটিকে কাজে লাগানোর by জেমস এফ মরিয়ার্টি  আলোচনা- দরিদ্র মানুষের পাঁজরের ওপর দুর্দান্ত পাজেরো  বিএনপির মিছিলে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের পিটুন


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মালেকা বেগম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.