বিএনপির ‘বিলুপ্তি’ (!) ও তার সম্ভাব্য পরিণতি by বদিউল আলম মজুমদার
সামন্তবাদী
যুগে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল রাজা-মহারাজাদের হাতে। এ ক্ষমতা ব্যবহার
করে তাঁরা প্রজাদের প্রায় সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতেন। আর এ কথা
বলার অপেক্ষা রাখে না যে অধিকারহীন মানুষ প্রায় দাসের সমতুল্য। তাই
সামন্তবাদের অবসান এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পেছনে মূল আকর্ষণ
ছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, যে অধিকারের অনেকগুলো তার জন্মগত।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও ক্ষমতা কুক্ষিগত এবং জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার ঘটে। তাই খ্রিষ্টপূর্ব গ্রিসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলনের পর থেকেই পণ্ডিতেরা ক্ষমতার বিভাজন ও নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পন্থা উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করেন। ফরাসি চিন্তাবিদ মন্টেস্কোর উদ্ভাবিত ‘প্রিন্সিপলস অব সেপারেশন অব পাওয়ারস’ বা ক্ষমতা বিভাজনের নীতি যার অন্যতম। এই নীতির আলোকে সরকারি ক্ষমতাকে বিভাজিত করে এর ভিন্ন ভিন্ন অংশ নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এ ধরনের ‘চেকস অ্যান্ড সায়েন্সেস’ স্কিমের উদ্দেশ্য হলো কোনো বিভাগ যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নাগরিকের অধিকার হরণ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। আর তা করা সম্ভব যদি এক বিভাগ অন্য বিভাগের ওপর নজরদারি রাখে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নজরদারির কাঠামো আরও জোরদার হয় আইনসভায় বিরোধী দলের উপস্থিতির মাধ্যমে। আইনসভায় একটি সক্রিয় ও শক্তিশালী বিরোধী দল নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার অন্যতম মাধ্যম অবশ্য আইনসভার বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী কমিটি।
আধুনিক রাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনেও নজরদারির ব্যবস্থা থাকে। রাজনৈতিক দল মূলত এ ভূমিকা পালন করে থাকে। আইনসভার বাইরে বিরোধী দল তাদের আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। মার্কিন জাতির পিতারা রাজনৈতিক দলকে ‘ইভিল’ বা অশুভ বলে আখ্যায়িত করলেও কালের পরিক্রমায় রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বস্তুত, রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কল্পনাই করা যায় না।
সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতার বিভাজনের পদ্ধতি এমনিতেই দুর্বল। আর বাংলাদেশে এ পদ্ধতি প্রায় ভেঙে পড়েছে। আমাদের বর্তমান অবস্থায় ‘অল পাওয়ারফুল’ বা সর্বশক্তিমান নির্বাহী বিভাগ অন্য দুই বিভাগের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। বস্তুত, সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও আমাদের আইনসভা সে ভূমিকা পালন করতে অপারগ। বিচার বিভাগও নানা কারণে প্রশাসনের প্রভাব বলয়ের বাইরে থাকতে পারছে না।
এ ছাড়া আমাদের সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। দশম জাতীয় সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে রয়েছে। তাদের দলের তিনজন সদস্য মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত। তাই তারা সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে অক্ষম। এ ছাড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারির কাঠামোর এ দুর্বলতার কারণে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল থাকা জরুরি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ দুটি দলই পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল এবং রয়েছে। উভয় দলই আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশের মতো ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু নির্বাচন বর্জনের কারণে দশম জাতীয় সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সংসদের বাইরেও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে দলটি তেমন কোনো অর্থবহ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন এর অন্যতম কারণ বলে অনেকেই মনে করেন।
এ বছরের প্রথম তিন মাসে সরকারবিরোধী সহিংস আন্দোলনে লিপ্ত হয়ে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো একেবারে ভেঙে পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন, যার প্রতিফলন ঘটেছে সরকার হটানোর আন্দোলনে দলের অনেক নেতা-কর্মীর নিষ্ক্রিয়তায়। তবে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো আগে থেকেই দুর্বল। প্রকট পরিবারতন্ত্রই এর মূল কারণ। বস্তুত, পরিবারতন্ত্রের কারণে দলটিতে মালিকানার সংকট রয়েছে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকের ধারণা যে দলীয় কাঠামোতে তাঁদের ভবিষ্যৎ মূলত নির্ভর করে বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার আজ্ঞার ওপর। সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতার আরেকটি কারণ হলো দলের সিদ্ধান্ত¦ গ্রহণের একাধিক উৎপত্তিস্থল। এ ছাড়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে—যে সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে—অদূর ভবিষ্যতে দলটির ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতার ফায়দা ভোগ করার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। তাই বিএনপির সরকার হটানোর আন্দোলনে জড়িত হয়ে জেল-জুলুম ও অন্যান্য হয়রানির ঝুঁকি নিতে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সারির নেতা সংগত কারণেই অনাগ্রহী।
বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো সরকারের দমন-পীড়ন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখী আচরণ। সরকার খালেদা জিয়াসহ দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকেই মামলার জালে আটকে ফেলেছে, যার বেশির ভাগই হয়রানিমূলক। অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে ইতিমধ্যে কারাগারে অন্তরীণ করা হয়েছে। যেমন, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে অন্তত ৭৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তিনি বহু মাস থেকেই কারাগারে অন্তরীণ রয়েছেন। এ ছাড়া লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসের সহিংস আন্দোলনের সময় বিএনপির প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপিকে সুস্পষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক, সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ ও শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আজ বেগম জিয়াকেই নিতে হবে। তাঁকেই পরিবারতন্ত্র পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলের জন্য সৎ ও নিষ্ঠাবান নতুন নেতৃত্ব ক্ষমতায়িত করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় দলের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব একজন এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্টের ওপর অর্পণ করার কথাও তিনি বিবেচনা করতে পারেন।
অনেকের আশঙ্কা, বিএনপিকে বিলুপ্ত করাই সরকারের দমন-পীড়নের অন্যতম লক্ষ্য। অনেককে বলতে শোনা যায় যে এ ধরনের দমন-পীড়ন অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দলটির কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়বে এবং বিএনপি যাবে বিলুপ্তির পথে। তবে অনেকেরই এ ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। তাঁরা মনে করেন যে নেতৃত্বের সংকট থাকলেও বিএনপির সমর্থকের অভাব নেই। কারণ, নানা অপকর্মের ফলে সরকারি দল যে জনসমর্থন হারিয়েছে, বিএনপির ঘরেই তার সুফল উঠছে, অনেকটা নাগরদোলার মতো। নাগরদোলার এক প্রান্ত নিচের দিকে গেলে যেমন আরেক প্রান্ত ওপরের দিকে উঠে যায়, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারালে বিএনপি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যদিও এটি বিএনপির কোনো কৃতিত্বের কারণে নয়।
অতীতের বহু অপকর্মের জন্য বিএনপির প্রতি অনেক চিন্তাশীল নাগরিকেরই সহানুভূতি নেই। তবু অনেকেই মনে করেন যে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপির বিলুপ্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। বরং একটি চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারের উত্থান রোধ করার লক্ষ্যে বিএনপিকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও শক্তিশালী দল হিসেবে বিকশিত হওয়া আজ জরুরি। এ ছাড়া বিএনপি বিলুপ্ত হলে তার অগণিত কর্মী-সমর্থকের অনেকেই সাম্প্রদায়িক দলগুলোতে ভিড়ে যেতে পারেন, এমনকি উগ্রবাদের দিকেও হাঁটতে পারেন, যা কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না। বস্তুত, এমন আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত, বিএনপির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হলেও অনেকের মতে, ক্ষমতাসীন দলের অবস্থাও দীর্ঘমেয়াদিভাবে তেমন ভালো নয়। প্রায় সাড়ে ছয় বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে প্রায় ‘বিলুপ্ত’ হয়ে গেছে। বস্তুত, সরকার অনেকটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাঁধে সওয়ার হয়ে পড়েছে। আর ফায়দাতন্ত্রের চেইনে আবদ্ধ ও পরিপুষ্ট অগণিত নেতা-কর্মী দলের প্রতি সমর্থন জোগাচ্ছেন। তাই ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে আওয়ামী লীগও যে খুব একটা শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে, তা অনেকেই মনে করেন না।
পরিশেষে, বিএনপিকে সুস্পষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক, সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ ও শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আজ বেগম জিয়াকেই নিতে হবে। তাঁকেই পরিবারতন্ত্র পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলের জন্য সৎ ও নিষ্ঠাবান নতুন নেতৃত্ব ক্ষমতায়িত করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় দলের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব একজন এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্টের ওপর অর্পণ করার কথাও তিনি বিবেচনা করতে পারেন। আর তিনি যদি প্রজ্ঞা ও সাহসিকতা প্রদর্শন করে প্রয়োজনীয় অপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগতা প্রদর্শন করেন, তাহলে তিনি নিজে এবং তাঁর দলকেই শুধু নয়, পুরো জাতিকেই এর মাশুল গুনতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)৷
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও ক্ষমতা কুক্ষিগত এবং জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার ঘটে। তাই খ্রিষ্টপূর্ব গ্রিসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলনের পর থেকেই পণ্ডিতেরা ক্ষমতার বিভাজন ও নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পন্থা উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করেন। ফরাসি চিন্তাবিদ মন্টেস্কোর উদ্ভাবিত ‘প্রিন্সিপলস অব সেপারেশন অব পাওয়ারস’ বা ক্ষমতা বিভাজনের নীতি যার অন্যতম। এই নীতির আলোকে সরকারি ক্ষমতাকে বিভাজিত করে এর ভিন্ন ভিন্ন অংশ নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এ ধরনের ‘চেকস অ্যান্ড সায়েন্সেস’ স্কিমের উদ্দেশ্য হলো কোনো বিভাগ যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নাগরিকের অধিকার হরণ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। আর তা করা সম্ভব যদি এক বিভাগ অন্য বিভাগের ওপর নজরদারি রাখে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নজরদারির কাঠামো আরও জোরদার হয় আইনসভায় বিরোধী দলের উপস্থিতির মাধ্যমে। আইনসভায় একটি সক্রিয় ও শক্তিশালী বিরোধী দল নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার অন্যতম মাধ্যম অবশ্য আইনসভার বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী কমিটি।
আধুনিক রাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনেও নজরদারির ব্যবস্থা থাকে। রাজনৈতিক দল মূলত এ ভূমিকা পালন করে থাকে। আইনসভার বাইরে বিরোধী দল তাদের আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। মার্কিন জাতির পিতারা রাজনৈতিক দলকে ‘ইভিল’ বা অশুভ বলে আখ্যায়িত করলেও কালের পরিক্রমায় রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বস্তুত, রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কল্পনাই করা যায় না।
সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতার বিভাজনের পদ্ধতি এমনিতেই দুর্বল। আর বাংলাদেশে এ পদ্ধতি প্রায় ভেঙে পড়েছে। আমাদের বর্তমান অবস্থায় ‘অল পাওয়ারফুল’ বা সর্বশক্তিমান নির্বাহী বিভাগ অন্য দুই বিভাগের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। বস্তুত, সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও আমাদের আইনসভা সে ভূমিকা পালন করতে অপারগ। বিচার বিভাগও নানা কারণে প্রশাসনের প্রভাব বলয়ের বাইরে থাকতে পারছে না।
এ ছাড়া আমাদের সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। দশম জাতীয় সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে রয়েছে। তাদের দলের তিনজন সদস্য মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত। তাই তারা সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে অক্ষম। এ ছাড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারির কাঠামোর এ দুর্বলতার কারণে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল থাকা জরুরি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ দুটি দলই পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল এবং রয়েছে। উভয় দলই আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশের মতো ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু নির্বাচন বর্জনের কারণে দশম জাতীয় সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সংসদের বাইরেও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে দলটি তেমন কোনো অর্থবহ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন এর অন্যতম কারণ বলে অনেকেই মনে করেন।
এ বছরের প্রথম তিন মাসে সরকারবিরোধী সহিংস আন্দোলনে লিপ্ত হয়ে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো একেবারে ভেঙে পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন, যার প্রতিফলন ঘটেছে সরকার হটানোর আন্দোলনে দলের অনেক নেতা-কর্মীর নিষ্ক্রিয়তায়। তবে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো আগে থেকেই দুর্বল। প্রকট পরিবারতন্ত্রই এর মূল কারণ। বস্তুত, পরিবারতন্ত্রের কারণে দলটিতে মালিকানার সংকট রয়েছে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকের ধারণা যে দলীয় কাঠামোতে তাঁদের ভবিষ্যৎ মূলত নির্ভর করে বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার আজ্ঞার ওপর। সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতার আরেকটি কারণ হলো দলের সিদ্ধান্ত¦ গ্রহণের একাধিক উৎপত্তিস্থল। এ ছাড়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে—যে সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে—অদূর ভবিষ্যতে দলটির ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতার ফায়দা ভোগ করার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। তাই বিএনপির সরকার হটানোর আন্দোলনে জড়িত হয়ে জেল-জুলুম ও অন্যান্য হয়রানির ঝুঁকি নিতে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সারির নেতা সংগত কারণেই অনাগ্রহী।
বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো সরকারের দমন-পীড়ন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখী আচরণ। সরকার খালেদা জিয়াসহ দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকেই মামলার জালে আটকে ফেলেছে, যার বেশির ভাগই হয়রানিমূলক। অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে ইতিমধ্যে কারাগারে অন্তরীণ করা হয়েছে। যেমন, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে অন্তত ৭৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তিনি বহু মাস থেকেই কারাগারে অন্তরীণ রয়েছেন। এ ছাড়া লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসের সহিংস আন্দোলনের সময় বিএনপির প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপিকে সুস্পষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক, সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ ও শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আজ বেগম জিয়াকেই নিতে হবে। তাঁকেই পরিবারতন্ত্র পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলের জন্য সৎ ও নিষ্ঠাবান নতুন নেতৃত্ব ক্ষমতায়িত করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় দলের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব একজন এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্টের ওপর অর্পণ করার কথাও তিনি বিবেচনা করতে পারেন।
অনেকের আশঙ্কা, বিএনপিকে বিলুপ্ত করাই সরকারের দমন-পীড়নের অন্যতম লক্ষ্য। অনেককে বলতে শোনা যায় যে এ ধরনের দমন-পীড়ন অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দলটির কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়বে এবং বিএনপি যাবে বিলুপ্তির পথে। তবে অনেকেরই এ ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। তাঁরা মনে করেন যে নেতৃত্বের সংকট থাকলেও বিএনপির সমর্থকের অভাব নেই। কারণ, নানা অপকর্মের ফলে সরকারি দল যে জনসমর্থন হারিয়েছে, বিএনপির ঘরেই তার সুফল উঠছে, অনেকটা নাগরদোলার মতো। নাগরদোলার এক প্রান্ত নিচের দিকে গেলে যেমন আরেক প্রান্ত ওপরের দিকে উঠে যায়, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারালে বিএনপি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যদিও এটি বিএনপির কোনো কৃতিত্বের কারণে নয়।
অতীতের বহু অপকর্মের জন্য বিএনপির প্রতি অনেক চিন্তাশীল নাগরিকেরই সহানুভূতি নেই। তবু অনেকেই মনে করেন যে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপির বিলুপ্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। বরং একটি চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারের উত্থান রোধ করার লক্ষ্যে বিএনপিকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও শক্তিশালী দল হিসেবে বিকশিত হওয়া আজ জরুরি। এ ছাড়া বিএনপি বিলুপ্ত হলে তার অগণিত কর্মী-সমর্থকের অনেকেই সাম্প্রদায়িক দলগুলোতে ভিড়ে যেতে পারেন, এমনকি উগ্রবাদের দিকেও হাঁটতে পারেন, যা কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না। বস্তুত, এমন আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত, বিএনপির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হলেও অনেকের মতে, ক্ষমতাসীন দলের অবস্থাও দীর্ঘমেয়াদিভাবে তেমন ভালো নয়। প্রায় সাড়ে ছয় বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে প্রায় ‘বিলুপ্ত’ হয়ে গেছে। বস্তুত, সরকার অনেকটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাঁধে সওয়ার হয়ে পড়েছে। আর ফায়দাতন্ত্রের চেইনে আবদ্ধ ও পরিপুষ্ট অগণিত নেতা-কর্মী দলের প্রতি সমর্থন জোগাচ্ছেন। তাই ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে আওয়ামী লীগও যে খুব একটা শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে, তা অনেকেই মনে করেন না।
পরিশেষে, বিএনপিকে সুস্পষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক, সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ ও শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আজ বেগম জিয়াকেই নিতে হবে। তাঁকেই পরিবারতন্ত্র পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলের জন্য সৎ ও নিষ্ঠাবান নতুন নেতৃত্ব ক্ষমতায়িত করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় দলের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব একজন এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্টের ওপর অর্পণ করার কথাও তিনি বিবেচনা করতে পারেন। আর তিনি যদি প্রজ্ঞা ও সাহসিকতা প্রদর্শন করে প্রয়োজনীয় অপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগতা প্রদর্শন করেন, তাহলে তিনি নিজে এবং তাঁর দলকেই শুধু নয়, পুরো জাতিকেই এর মাশুল গুনতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)৷
No comments