চিকিৎসকদের জেল-জরিমানার বিধান বাতিল মন্ত্রিসভায় উঠছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন
চিকিৎসকদের জেল-জরিমানার বিধান বাতিল করে নতুনভাবে মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালের এ সংক্রান্ত পুরনো আইনে অপরাধী চিকিৎসকদের আইন ভঙ্গের শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ সাত বছর ও সর্বনিম্ন তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। সঙ্গে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধানও ছিল। চিকিৎসকরা আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে এই শাস্তির সঙ্গে চিকিৎসক হিসেবে তাদের রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্স বাতিল করার বিধানও ছিল। নতুন আইনে শুধুমাত্র রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্স বাতিল করার বিধান রাখা হয়েছে। এভাবেই অপরাধী চিকিৎসকদের শাস্তি কমিয়ে নতুনভাবে মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ২০১৫ এর খসড়া চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। আজ সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে আইনটি নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উঠবে। একই সঙ্গে মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯ বাতিলের প্রস্তাবও থাকছে। খসড়া আইন অনুযায়ী, সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গ্রহণ নিষিদ্ধ। অনাত্মীয়কে আত্মীয় পরিচয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও প্রতিস্থাপন বন্ধে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেইন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ থাকছে এ আইনে। মূলত ওই ব্যক্তির বা তার উত্তরাধিকারের সম্মতিতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যকে দান করা যাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে খসড়া আইনটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে নীতিগত অনুমোদন দিয়ে আরও যাচাই-বাছাই করতে বলা হয়। কিন্তু ভেটিং- এর জন্য সংশোধন প্রস্তাবটি গেলে নতুন আইন তৈরির কথা বলা হয়। এজন্য নতুনভাবে আইনটি তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন খসড়া আইনে শাস্তি ছাড়াও অঙ্গপ্রতঙ্গ সংযোজনের জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করার পদ্ধতি, মেডিক্যাল বোর্ডের দায়িত্ব, মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ, মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনে জাতীয় কমিটি, সংযোজন কমিটি ও তাদের কার্যক্রম, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন সম্পর্কিত ডাটাবেইস সংরক্ষণ ও মিথ্যা তথ্য প্রদানকারীর শাস্তির বিধান রয়েছে। খসড়া আইন অনুযায়ী মিথ্যা তথ্য দিলে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খসড়া আইন কার্যকর হলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আদান- প্রদান জটিল হবে। কারণ, আইনে এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জড়িত করা হয়েছে। এতে করে কেউ সহজে এ জটিল প্রক্রিয়ায় যেতে চাইবে না। এ ছাড়া এত প্রক্রিয়া থাকায় অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। এবারের আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি নিষিদ্ধ বহাল রাখার পাশাপাশি বিষয়টিকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। খসড়া আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল বা ইনস্টিটিউট বা ক্লিনিককে অনুমতি নিতে হবে। তবে কোন ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম ২০ শয্যার দুটি ইউনিট না থাকলে সরকার এ-সংক্রান্ত অনুমতি দেবে না। এ ছাড়া এ ধরনের ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যসেবী প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম দুটি অপারেশন থিয়েটার, আট শয্যার ট্রান্সপ্লান্ট আইসিইউ, কিডনি সংযোজনের জন্য ন্যূনতম ছয় শয্যার ডায়ালিসিস ইউনিট, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একজন অধ্যাপক, দুইজন সহযোগী বা সহকারী অধ্যাপক বা সমমানের চিকিৎসক থাকতে হবে। খসড়া আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করার পদ্ধতিতে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি তার নিকটাত্মীয়কে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিতে চাইলে সরকারের কাছে আবেদন করবে। আবেদন পাওয়ার পর আত্মীয়তা যাচাই-বাছাই করা হবে। দাতা-গ্রহীতার জন্ম নিবন্ধনপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। উভয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্ট্যাম্পে হলফনামা দেবে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন, প্রয়োজনে বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এসব তথ্য যাচাই করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে অথেনটিফিকেশন বোর্ডে পাঠানো হবে। এই বোর্ড গঠন করা হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালক ও দুইজন উপ-পরিচালকের সমন্বয়ে। দাতা-গ্রহীতার আত্মীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর বোর্ড অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এসব খুব দীর্ঘ ও রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ক্যাডাভেরিক (মৃত) ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনে জাতীয় কমিটি থাকবে। এ কমিটির কার্যক্রম পরিচালনা করবে ১৯ সদস্যের জাতীয় কমিটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এ কমিটির প্রধান হবেন। কমিটিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিনিধি, বিএমডিসির সভাপতি, বিএমএ সভাপতি বা তার প্রতিনিধি, সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা থাকবেন। এ কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক। এ কমিটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ-সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয়কারীর কার্যক্রম তদারকি করবে এবং ক্যাডাভেরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন সহজ করার পরামর্শ দেবে। এই কমিটি মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে মৃত ব্যক্তি থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও সংযোজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এ কমিটি বিভিন্ন ধরনের উপকমিটি গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের জন্য ট্রান্সপ্লান্ট কমিটি থাকবে। তবে প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কেউ এ কমিটিতে থাকতে পারবে না। খসড়া আইন অনুযায়ী যেসব আইসিইউতে কোন রোগীর ব্রেন ডেথ হয়েছে বলে ঘোষণা করা হবে, তাদের সঙ্গে সমন্বয়কারীর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে। বিযুক্ত অঙ্গপ্রতঙ্গ সচল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর আগে তার কোন আত্মীয়কে তার অঙ্গ দান করে গেলে সেটা অগ্রাধিকার দেয়া হবে। তুলনামূলকভাবে কম বয়সীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
No comments