গদ্যকার্টুন- দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি by আনিসুল হক
আকাশ কালো। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। ভোরবেলায় ঠান্ডা পড়েছিল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি পাশের বাড়ির গাছগুলোর দিকে। কালচে সবুজ দেখাচ্ছে পাতাগুলো। নিমগাছের চিকন পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপছে। তারপর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এল। অঝোর বর্ষণ।
এমন দিনে কী লিখতে মন চায়?—বলেছিলেন, প্রমথ চৌধুরী।
আর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়। দুজনে মুখোমুখি বসতে হবে, গভীর দুখে দুখি হতে হবে, তারপর বলতে দু কথা, সমাজ-সংসার সব মিছে হয়ে যাবে, মিছে হয়ে যাবে জীবনের কলরব।
এভাবে মুখোমুখি বসে যদি তার সঙ্গে দুটো কথা বলেই ফেলি, তাতে কার কীই-বা এসে যায়! ভাবছি তাই করব। ঢাকায় ভালো কফিশপ হয়েছে, কোনো একটায় চলে যাব, কোনো এক দুখি হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে, বসব তার মুখোমুখি, বলব মনের কথা...
মনের কথা?
আচ্ছা, এই যে যুগলেরা পার্কে কিংবা রেস্তোরাঁয় কিংবা টেলিফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে, কী বলে!
ধরা যাক, তুমি আর আমি বসেছি ঢাকার কোনো কফিশপে। কফির অর্ডার দিয়েছি। আমার প্রিয় কাপাচিনো। তোমার লাটে। তারপর কথা শুরু হলো...কী কথা হতে পারে?
ইশ্, কী রকম জ্যাম...আসতে পনেরো মিনিটের রাস্তা লাগল এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। কোনো মানে হয়?
‘সেদিন ছিল মোদির জ্যাম, আজকে ছিল গদির জ্যাম!’
‘তুমি বানালে?’
‘না, আমাদের বন্ধু অনিকের স্ট্যাটাস।’
‘অযথা মোদিকে দুষছ। ঢাকার রাস্তায় কবে জ্যাম থাকে না?’
‘তা অবশ্য ঠিক। অবরোধ-হরতালের দিনেও থাকে, আর তো স্বাভাবিক দিন। তবে ঢাকার রাস্তায় ভিআইপি যত কম চলাচল করবেন, তত ভালো। অবশ্য প্রটোকল ছাড়া চললে তাঁরা বুঝবেন আসল বাস্তবতা। আর প্রটোকল নিয়ে চললে যা হয়, তাঁরা যে পথ দিয়ে যাবেন, সে পথে পাঁচ মিনিটের জন্যও যদি সাধারণের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়, পুরো ঢাকার পথগুলো লক হয়ে যায়।’
‘যেমন ধরা যাক, ফতুল্লা স্টেডিয়াম থেকে যখন ক্রিকেটারদের গাড়ি আসবে। উফ্, তাঁরা যদি বিশেষ
ব্যবস্থায় না আসেন, তাঁদের আসতে লাগবে তিন ঘণ্টা। আর যদি তাঁরা বিশেষ ব্যবস্থায় আসেন, তাহলে সাধারণের বেজে যাবে বারোটা।’
‘এই এই, মোদির বক্তৃতা শুনেছ? খুব ভালো বলেন না? আমি তো মুগ্ধ! আমার হৃদয় জয় করেছেন তিনি।’
‘নিশ্চয়ই ভালো বক্তা তিনি। তিনি হলেন রাজনীতির অমিতাভ। মানুষের চিত্ত জয় করতে জানেন।’
‘সেটা নিশ্চয়ই অনেক বড় কথা।’
তারপর জলবন্দী হয়ে পড়ব দুজন। ঢাকার রাস্তায় পানি আর পানি। দুই নবীন মেয়র জানালা দিয়ে সেই বৃষ্টির জলে ভেসে থাকা কোনো আবর্জনাকে কাগজের নৌকা ভেবে সান্ত্বনা খুঁজবেন এই সময় পাশের টেবিল থেকে ঠিকই একজন এগিয়ে আসবেন। বলবেন, ‘ভাইরে, আপনারা মিষ্টি কথায় কেন ভোলেন, বলেন তো? তিস্তা নিয়ে কোনো কথা হয়েছে? এই ডিল তো সিল করার কথা ছিল সেই মনমোহনের সফরের সময়ই। সেবার হলো না। এবারও হলো না। তবু আপনারা খুশি। পারেন বটে!’
আমাদের দুজনের আলাপের মধ্যে তৃতীয় পক্ষের উঁকি। অথচ কথা ছিল, রবিঠাকুরের গানের মতো আমরা থাকব এমন পরিবেশে, জগতে কিছু যেন নাহি আর। কী আর করা! এক বর্গকিলোমিটারে এখানে হাজার মানুষ বাস করে, ঢাকাতে নিশ্চয়ই করে এক লাখ, এখানে তো কফিশপে নিরিবিলি কথা বলা যাবেই না।
‘জি, আপনি ঠিক বলেছেন। তবে আশা করতে দোষ কী! হয়তো মমতার নির্বাচনের পরই সেটা হয়ে যাবে।’
‘আশা নিয়েই থাকেন।’
আরেকজন এগিয়ে এলেন, ‘ভাইরে, ছিটমহলের মানুষ হলে বুঝতেন এই সফরের তাৎপর্য। মোদির ম্যাজিক। যে মোদিকে নিয়ে সবারই ছিল সন্দেহ, যাঁকে আমেরিকানরা ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল গুজরাট-কাণ্ডের পর, সেই মোদিই কিনা স্থলসীমান্ত চুক্তি তাঁদের পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নিতে পারলেন। চিন্তা করুন, আপনি আছেন বাংলাদেশের পেটের ভেতরে, ইন্ডিয়াতে যাওয়ার কোনো পথ নেই আপনার, কিন্তু আপনি ইন্ডিয়ান, বা আপনি বাংলাদেশি, আছেন ভারতের ভেতরে, শিক্ষা নেই, হাসপাতাল নেই, পরিচয় নেই...সেসব শিশুর কথা ভাবুন...’
হায়! তুমি আর আমি ভেবেছিলাম বসে বসে হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব করব, এর মধ্যে এ কী আলাপ?
আরেকজন গলার স্বর উঁচু করে বললেন, ‘আপনারা শুধু ভারতের বাইরের উন্নতি চাকচিক্যই দেখছেন। আপনারা জানেন, ওরা যে টাকা দেবে বলেছে, তাতে কর্মসংস্থান হবে ৫০ হাজার ভারতীয়র, আর সেই রিপোর্ট বেরিয়েছে ভারতের কাগজেই? আপনারা শুধু টাটা, আদানি, রিলায়েন্সের উন্নতি দেখেন, কিন্তু কত ভারতীয় প্রান্তিক মানুষ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সিংগুরের মানুষ জানবাজি প্রতিরোধ গড়েছে টাটার ভূমি দখলের বিরুদ্ধে...সেসব তো আপনারা দেখবেন না। আপনারা রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসাবেন। বন ধ্বংস করবেন।’
আরেকজন তাঁর সিটে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলবেন, ‘কিন্তু মোদি বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে তাঁরা আর এগোচ্ছেন না। আসলে ওরা গত বছর ৮৬ লাখ গাছ কাটার অনুমতি চেয়েছিল টিপাইমুখে, দিল্লি বন বিভাগের টেকনিক্যাল কমিটি সেটা নাকচ করে দিয়েছে...তার মানে পৃথিবীজুড়ে পরিবেশবাদীদের নড়াচড়া-চেঁচামেচিতে কিছু না কিছু কাজ হচ্ছে...’
আমাদের আর কিছু বলতে হবে না। আশে-পাশের লোকজনই যা বলার বলবেন। আরেকজন বলে বসবেন, ‘আসল কথা হলো, সদিচ্ছা। আমরা প্রতিবেশী বেছে নিতে পারব না। প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলেমিশে থাকাটা লাভজনক বলেই তা করতে হবে। তবে দেখতে হবে, প্রতিটা ডিল থেকে কতটা লাভ দেশের জন্য আদায় করা যায়। বাংলাদেশ ভারতের এক নম্বর চাওয়াটা পূরণ করেছে। তা হলো, বাংলাদেশের মাটিকে ভারতের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত হতে না দেওয়া। যেটা বলতে গিয়ে মোদি একটা পলিটিক্যালি ভুল কথা মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হওয়া সত্ত্বেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অবস্থান নিয়েছেন। আমেরিকার কাগজগুলো ও সামাজিক মাধ্যমে তঁার এই পুরুষবাদী কথার খুব সমালোচনা হচ্ছে। এখন বাংলাদেশ থেকে গাড়ি নিয়ে ভুটান-নেপাল যাওয়া যাবে। আবার বাংলাদেশও দিক না যশোর থেকে আগরতলায় রেল যোগাযোগের সুবিধা। কিন্তু দেখতে হবে তা যেন বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হয়, বাংলাদেশের পরিবেশের ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর না হয়।’
নাহ্। আর পারি না। ভেবেছিলাম, এমন দিনেই তোমাকে বলে ফেলব সেই কথাটা, ‘যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে, সে কথা আজি যেন বলা যায়—এমন ঘনঘোর বরিষায়!’
ওপাশ থেকে একজন আধা গেলাস পানি নিয়ে বলবেন, ‘এই যে গেলাসটা, এর অর্ধেকটা খালি, এটা হলো হতাশাবাদীদের পর্যবেক্ষণ, অর্ধেকটা পূর্ণ, দাবি করবেন আশাবাদীরা। পুরোটাই পূর্ণ—অর্ধেকটায় পানি, অর্ধেকটায় বাতাস, বলবেন পদার্থবিজ্ঞানী। জলাতঙ্ক রোগী গেলাসটা দেখলেই চিৎকার করে পালাবেন, তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি ছুটে এসে পান করবেন...’
বিকট শব্দে বিজলি চমকাবে। তুমি বলবে, ‘চলো, আমরা বৃষ্টিতে ভিজি। আমি বলব, মাথা খারাপ?’
তারপর জলবন্দী হয়ে পড়ব দুজন। ঢাকার রাস্তায় পানি আর পানি। দুই নবীন মেয়র জানালা দিয়ে সেই বৃষ্টির জলে ভেসে থাকা কোনো আবর্জনাকে কাগজের নৌকা ভেবে সান্ত্বনা খুঁজবেন।
কিন্তু আসলে এসবের কিছুই হবে না। যানজটে আটকা পড়বে তুমি। যানজটে আটকা পড়ব আমি। আমাদের কোনো দিনও মুখোমুখি বসাই হয়ে উঠবে না এই শহরে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
এমন দিনে কী লিখতে মন চায়?—বলেছিলেন, প্রমথ চৌধুরী।
আর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়। দুজনে মুখোমুখি বসতে হবে, গভীর দুখে দুখি হতে হবে, তারপর বলতে দু কথা, সমাজ-সংসার সব মিছে হয়ে যাবে, মিছে হয়ে যাবে জীবনের কলরব।
এভাবে মুখোমুখি বসে যদি তার সঙ্গে দুটো কথা বলেই ফেলি, তাতে কার কীই-বা এসে যায়! ভাবছি তাই করব। ঢাকায় ভালো কফিশপ হয়েছে, কোনো একটায় চলে যাব, কোনো এক দুখি হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে, বসব তার মুখোমুখি, বলব মনের কথা...
মনের কথা?
আচ্ছা, এই যে যুগলেরা পার্কে কিংবা রেস্তোরাঁয় কিংবা টেলিফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে, কী বলে!
ধরা যাক, তুমি আর আমি বসেছি ঢাকার কোনো কফিশপে। কফির অর্ডার দিয়েছি। আমার প্রিয় কাপাচিনো। তোমার লাটে। তারপর কথা শুরু হলো...কী কথা হতে পারে?
ইশ্, কী রকম জ্যাম...আসতে পনেরো মিনিটের রাস্তা লাগল এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। কোনো মানে হয়?
‘সেদিন ছিল মোদির জ্যাম, আজকে ছিল গদির জ্যাম!’
‘তুমি বানালে?’
‘না, আমাদের বন্ধু অনিকের স্ট্যাটাস।’
‘অযথা মোদিকে দুষছ। ঢাকার রাস্তায় কবে জ্যাম থাকে না?’
‘তা অবশ্য ঠিক। অবরোধ-হরতালের দিনেও থাকে, আর তো স্বাভাবিক দিন। তবে ঢাকার রাস্তায় ভিআইপি যত কম চলাচল করবেন, তত ভালো। অবশ্য প্রটোকল ছাড়া চললে তাঁরা বুঝবেন আসল বাস্তবতা। আর প্রটোকল নিয়ে চললে যা হয়, তাঁরা যে পথ দিয়ে যাবেন, সে পথে পাঁচ মিনিটের জন্যও যদি সাধারণের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়, পুরো ঢাকার পথগুলো লক হয়ে যায়।’
‘যেমন ধরা যাক, ফতুল্লা স্টেডিয়াম থেকে যখন ক্রিকেটারদের গাড়ি আসবে। উফ্, তাঁরা যদি বিশেষ
ব্যবস্থায় না আসেন, তাঁদের আসতে লাগবে তিন ঘণ্টা। আর যদি তাঁরা বিশেষ ব্যবস্থায় আসেন, তাহলে সাধারণের বেজে যাবে বারোটা।’
‘এই এই, মোদির বক্তৃতা শুনেছ? খুব ভালো বলেন না? আমি তো মুগ্ধ! আমার হৃদয় জয় করেছেন তিনি।’
‘নিশ্চয়ই ভালো বক্তা তিনি। তিনি হলেন রাজনীতির অমিতাভ। মানুষের চিত্ত জয় করতে জানেন।’
‘সেটা নিশ্চয়ই অনেক বড় কথা।’
তারপর জলবন্দী হয়ে পড়ব দুজন। ঢাকার রাস্তায় পানি আর পানি। দুই নবীন মেয়র জানালা দিয়ে সেই বৃষ্টির জলে ভেসে থাকা কোনো আবর্জনাকে কাগজের নৌকা ভেবে সান্ত্বনা খুঁজবেন এই সময় পাশের টেবিল থেকে ঠিকই একজন এগিয়ে আসবেন। বলবেন, ‘ভাইরে, আপনারা মিষ্টি কথায় কেন ভোলেন, বলেন তো? তিস্তা নিয়ে কোনো কথা হয়েছে? এই ডিল তো সিল করার কথা ছিল সেই মনমোহনের সফরের সময়ই। সেবার হলো না। এবারও হলো না। তবু আপনারা খুশি। পারেন বটে!’
আমাদের দুজনের আলাপের মধ্যে তৃতীয় পক্ষের উঁকি। অথচ কথা ছিল, রবিঠাকুরের গানের মতো আমরা থাকব এমন পরিবেশে, জগতে কিছু যেন নাহি আর। কী আর করা! এক বর্গকিলোমিটারে এখানে হাজার মানুষ বাস করে, ঢাকাতে নিশ্চয়ই করে এক লাখ, এখানে তো কফিশপে নিরিবিলি কথা বলা যাবেই না।
‘জি, আপনি ঠিক বলেছেন। তবে আশা করতে দোষ কী! হয়তো মমতার নির্বাচনের পরই সেটা হয়ে যাবে।’
‘আশা নিয়েই থাকেন।’
আরেকজন এগিয়ে এলেন, ‘ভাইরে, ছিটমহলের মানুষ হলে বুঝতেন এই সফরের তাৎপর্য। মোদির ম্যাজিক। যে মোদিকে নিয়ে সবারই ছিল সন্দেহ, যাঁকে আমেরিকানরা ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল গুজরাট-কাণ্ডের পর, সেই মোদিই কিনা স্থলসীমান্ত চুক্তি তাঁদের পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নিতে পারলেন। চিন্তা করুন, আপনি আছেন বাংলাদেশের পেটের ভেতরে, ইন্ডিয়াতে যাওয়ার কোনো পথ নেই আপনার, কিন্তু আপনি ইন্ডিয়ান, বা আপনি বাংলাদেশি, আছেন ভারতের ভেতরে, শিক্ষা নেই, হাসপাতাল নেই, পরিচয় নেই...সেসব শিশুর কথা ভাবুন...’
হায়! তুমি আর আমি ভেবেছিলাম বসে বসে হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব করব, এর মধ্যে এ কী আলাপ?
আরেকজন গলার স্বর উঁচু করে বললেন, ‘আপনারা শুধু ভারতের বাইরের উন্নতি চাকচিক্যই দেখছেন। আপনারা জানেন, ওরা যে টাকা দেবে বলেছে, তাতে কর্মসংস্থান হবে ৫০ হাজার ভারতীয়র, আর সেই রিপোর্ট বেরিয়েছে ভারতের কাগজেই? আপনারা শুধু টাটা, আদানি, রিলায়েন্সের উন্নতি দেখেন, কিন্তু কত ভারতীয় প্রান্তিক মানুষ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সিংগুরের মানুষ জানবাজি প্রতিরোধ গড়েছে টাটার ভূমি দখলের বিরুদ্ধে...সেসব তো আপনারা দেখবেন না। আপনারা রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসাবেন। বন ধ্বংস করবেন।’
আরেকজন তাঁর সিটে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলবেন, ‘কিন্তু মোদি বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে তাঁরা আর এগোচ্ছেন না। আসলে ওরা গত বছর ৮৬ লাখ গাছ কাটার অনুমতি চেয়েছিল টিপাইমুখে, দিল্লি বন বিভাগের টেকনিক্যাল কমিটি সেটা নাকচ করে দিয়েছে...তার মানে পৃথিবীজুড়ে পরিবেশবাদীদের নড়াচড়া-চেঁচামেচিতে কিছু না কিছু কাজ হচ্ছে...’
আমাদের আর কিছু বলতে হবে না। আশে-পাশের লোকজনই যা বলার বলবেন। আরেকজন বলে বসবেন, ‘আসল কথা হলো, সদিচ্ছা। আমরা প্রতিবেশী বেছে নিতে পারব না। প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলেমিশে থাকাটা লাভজনক বলেই তা করতে হবে। তবে দেখতে হবে, প্রতিটা ডিল থেকে কতটা লাভ দেশের জন্য আদায় করা যায়। বাংলাদেশ ভারতের এক নম্বর চাওয়াটা পূরণ করেছে। তা হলো, বাংলাদেশের মাটিকে ভারতের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত হতে না দেওয়া। যেটা বলতে গিয়ে মোদি একটা পলিটিক্যালি ভুল কথা মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হওয়া সত্ত্বেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অবস্থান নিয়েছেন। আমেরিকার কাগজগুলো ও সামাজিক মাধ্যমে তঁার এই পুরুষবাদী কথার খুব সমালোচনা হচ্ছে। এখন বাংলাদেশ থেকে গাড়ি নিয়ে ভুটান-নেপাল যাওয়া যাবে। আবার বাংলাদেশও দিক না যশোর থেকে আগরতলায় রেল যোগাযোগের সুবিধা। কিন্তু দেখতে হবে তা যেন বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হয়, বাংলাদেশের পরিবেশের ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর না হয়।’
নাহ্। আর পারি না। ভেবেছিলাম, এমন দিনেই তোমাকে বলে ফেলব সেই কথাটা, ‘যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে, সে কথা আজি যেন বলা যায়—এমন ঘনঘোর বরিষায়!’
ওপাশ থেকে একজন আধা গেলাস পানি নিয়ে বলবেন, ‘এই যে গেলাসটা, এর অর্ধেকটা খালি, এটা হলো হতাশাবাদীদের পর্যবেক্ষণ, অর্ধেকটা পূর্ণ, দাবি করবেন আশাবাদীরা। পুরোটাই পূর্ণ—অর্ধেকটায় পানি, অর্ধেকটায় বাতাস, বলবেন পদার্থবিজ্ঞানী। জলাতঙ্ক রোগী গেলাসটা দেখলেই চিৎকার করে পালাবেন, তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি ছুটে এসে পান করবেন...’
বিকট শব্দে বিজলি চমকাবে। তুমি বলবে, ‘চলো, আমরা বৃষ্টিতে ভিজি। আমি বলব, মাথা খারাপ?’
তারপর জলবন্দী হয়ে পড়ব দুজন। ঢাকার রাস্তায় পানি আর পানি। দুই নবীন মেয়র জানালা দিয়ে সেই বৃষ্টির জলে ভেসে থাকা কোনো আবর্জনাকে কাগজের নৌকা ভেবে সান্ত্বনা খুঁজবেন।
কিন্তু আসলে এসবের কিছুই হবে না। যানজটে আটকা পড়বে তুমি। যানজটে আটকা পড়ব আমি। আমাদের কোনো দিনও মুখোমুখি বসাই হয়ে উঠবে না এই শহরে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments